বুদ্ধ পূর্ণিমার শিক্ষা :বৌদ্ধ ধর্ম ও মানবতাবাদ by সুকোমল বড়ূয়া
আজ শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। ২৫৫৫ বুদ্ধবর্ষ। আড়াই হাজার বছরেরও অধিক আগে এমনই এক শুভ তিথিতে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ মহামানবের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬২৪ অব্দে। বুদ্ধত্ব লাভ খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৯ অব্দে এবং তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪ অব্দে।
সিদ্ধার্থ গৌতমের এ তিনটি মহান ঘটনা বুদ্ধ জীবনকে করেছে মহিমান্বিত এবং গৌরবমণ্ডিত। তাঁর জন্ম ও বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে এমন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার বাণী ছিল আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ_ যা সম্পূর্ণ অহিংস ও মানবতাবাদী এবং যা বিশ্বের জীবজগৎ ও সব মানবগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য আহ্বান জানায়। তাই বলতেই হয়, বৌদ্ধ ধর্ম একটি সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন অহিংস, সাম্য ও মানবতাবাদী ধর্ম_ যে ধর্মের বাণীগুলো চিরন্তন, শাশ্বত এবং সম্পূর্ণ মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ। এখানে ধর্মের কোনো দোহাই নেই, বাড়াবাড়ি নেই। মানবতা এবং মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশই এ ধর্মের বিশেষত্ব।
বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল। এর একটি হচ্ছে মুক্তির জন্য ঈশ্বর বা পরনির্ভরশীল না হওয়া, অন্যটি হলো নিজের ওপর আত্মনির্ভরশীল হওয়া। তাই তিনি সবসময় তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ''হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না। অত্তাহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিয়া/অত্তনা'ব সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং। অর্থাৎ নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।'' শিষ্যদের তিনি আরও বলতেন, 'মুক্তির জন্য কোনো গুরু নয়, কোনো দেবতা নয়, অথবা কোনো ঈশ্বর প্রার্থনাও নয়, কেবল স্বীয় কর্মসাধনার ওপরই নির্ভর করো।' আজকের বিশ্বের রাজনীতিতে অথবা বিশ্বজুড়ে যখন আগ্রাসনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ঠিক তখনই চীন, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ কিংবা এ উপমহাদেশের ক্ষমতাবানরা অন্য দেশ বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, ধর্ম ও রাষ্ট্রশক্তি নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আমাদের চিন্তার মুক্তির প্রশ্নটি নিয়ে। আড়াই হাজার বছর আগেও মহামানব বুদ্ধ সেই সামগ্রিক মুক্তিটি চেয়েছিলেন সবার জন্য। এমনকি মহামতি বুদ্ধ অধ্যাত্ম বা বৈরাগ্য জীবনের মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বিশ্বজনীন মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। বস্তুত বুদ্ধের এ মুক্তিদর্শন আধ্যাত্মিক জগৎ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণতাসহ জাগতিক সব সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পূর্ণ করে। তাই বিশ্বের সাম্যবাদীরা বুদ্ধের সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির এ চেতনাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধ চেয়েছিলেন জীবনের সবক্ষেত্রে সমঅধিকার, সমন্যায্যতা, সব মানুষের পূর্ণ গণতন্ত্র এবং কর্মশক্তির প্রতিফলন ও সামগ্রিক মূল্যায়ন। এছাড়া তিনি চেয়েছিলেন সব মানুষের বাকস্বাধীনতার নিরঙ্কুশ মর্যাদা। তাই বৌদ্ধ সমাজ-দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার লাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তিনি কখনও উদ্বিগ্ন, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা চাননি। তাঁর জীবন-দর্শনে চিন্তা ও মননের অপরিমিত স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সব বিষয়ের অমিত প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি সমাজের বহু আক্রান্ত মূল্যবোধকে বল্গাহীনভাবে দেখেননি। তাঁর জীবন-দর্শনে ও শিক্ষামূলক আদর্শে তিনি কখনও অতি মানবীয় কিংবা অতি প্রাকৃতিক জীবনকে গ্রহণ করেননি। তাঁর উন্নততর জীবনে অনাড়ম্বর ও সংযত আচরণ, আদর্শ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং সংবেদনশীল নিয়মনীতি ও সামগ্রিক জীবনের উচ্চ আদর্শ এবং শিক্ষাই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি।
প্রকৃত জীবন গঠনের মানসে শীলের গুরুত্ব বৌদ্ধ ধর্মে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং জীবনের সব অবস্থায় তাই সংযত ও সংহত আচরণকে তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ জন্য বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীলে আছে কোনো প্রাণীকে বধ করা থেকে বিরত থাকা এবং কোনো প্রাণীকে হিংসা না করা, কোনো ধরনের চৌর্যবৃত্তি না করা, কোনো ধরনের মিথ্যা কথা না বলা, কোনো ধরনের ব্যভিচার বা যৌনাচার না করা এবং কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন না করা। এগুলোই হলো সব মানুষের জন্য সুন্দর আচরণবিধি যা সৌজন্যতা, ভদ্রতা ও সর্বজনীন মানবতা শেখায়। এছাড়া উচ্চ আদর্শে পেঁৗছার জন্য এ নীতিগুলো মানুষকে শীলাচার, মার্জিত রুচি ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় এবং সৃজনশীল কর্মে, সাম্য, মৈত্রী ও আত্মজয়ের আদর্শে মানুষকে উজ্জীবিত ও সম্পূর্ণ মানবিক গুণাবলি অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে। আজ বিশ্বের সর্বত্র মানুষের মানবিক গুণাবলি ভূলুণ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সব স্থানে একটা উত্তেজনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিরাজ করছে ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের লেলিহান শিখা। এ কারণে আজ বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। আজ এ অস্থিরতা ও উত্তেজনা কাটানোর জন্যই বুদ্ধের অহিংস ও সাম্যনীতি অনুসরণ করা আমাদের জরুরি। তাই আজ বুদ্ধ পূর্ণিমার এ শুভ দিনে, শুভ তিথিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়সহ বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে আহ্বান জানাই সাম্য ও অহিংস আদর্শে উজ্জীবিত হতে। চিত্তের সব হিংসা, দ্বেষ, বৈরিতা পরিহার করি, চিত্তকে পরিশুদ্ধ করি, চিত্তকে নির্মল করি। 'সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু'_ জগতের সকল জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ সুখী ও সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বর্ষণ হোক। 'ভবতু সব্ব মঙ্গলং'_ সকলের মঙ্গল লাভ হোক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ূয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল। এর একটি হচ্ছে মুক্তির জন্য ঈশ্বর বা পরনির্ভরশীল না হওয়া, অন্যটি হলো নিজের ওপর আত্মনির্ভরশীল হওয়া। তাই তিনি সবসময় তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ''হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না। অত্তাহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিয়া/অত্তনা'ব সুদন্তেন নাথং লভতি দুল্লভং। অর্থাৎ নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।'' শিষ্যদের তিনি আরও বলতেন, 'মুক্তির জন্য কোনো গুরু নয়, কোনো দেবতা নয়, অথবা কোনো ঈশ্বর প্রার্থনাও নয়, কেবল স্বীয় কর্মসাধনার ওপরই নির্ভর করো।' আজকের বিশ্বের রাজনীতিতে অথবা বিশ্বজুড়ে যখন আগ্রাসনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ঠিক তখনই চীন, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ কিংবা এ উপমহাদেশের ক্ষমতাবানরা অন্য দেশ বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, ধর্ম ও রাষ্ট্রশক্তি নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আমাদের চিন্তার মুক্তির প্রশ্নটি নিয়ে। আড়াই হাজার বছর আগেও মহামানব বুদ্ধ সেই সামগ্রিক মুক্তিটি চেয়েছিলেন সবার জন্য। এমনকি মহামতি বুদ্ধ অধ্যাত্ম বা বৈরাগ্য জীবনের মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বিশ্বজনীন মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। বস্তুত বুদ্ধের এ মুক্তিদর্শন আধ্যাত্মিক জগৎ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণতাসহ জাগতিক সব সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পূর্ণ করে। তাই বিশ্বের সাম্যবাদীরা বুদ্ধের সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির এ চেতনাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধ চেয়েছিলেন জীবনের সবক্ষেত্রে সমঅধিকার, সমন্যায্যতা, সব মানুষের পূর্ণ গণতন্ত্র এবং কর্মশক্তির প্রতিফলন ও সামগ্রিক মূল্যায়ন। এছাড়া তিনি চেয়েছিলেন সব মানুষের বাকস্বাধীনতার নিরঙ্কুশ মর্যাদা। তাই বৌদ্ধ সমাজ-দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার লাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তিনি কখনও উদ্বিগ্ন, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা চাননি। তাঁর জীবন-দর্শনে চিন্তা ও মননের অপরিমিত স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সব বিষয়ের অমিত প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি সমাজের বহু আক্রান্ত মূল্যবোধকে বল্গাহীনভাবে দেখেননি। তাঁর জীবন-দর্শনে ও শিক্ষামূলক আদর্শে তিনি কখনও অতি মানবীয় কিংবা অতি প্রাকৃতিক জীবনকে গ্রহণ করেননি। তাঁর উন্নততর জীবনে অনাড়ম্বর ও সংযত আচরণ, আদর্শ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং সংবেদনশীল নিয়মনীতি ও সামগ্রিক জীবনের উচ্চ আদর্শ এবং শিক্ষাই আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি।
প্রকৃত জীবন গঠনের মানসে শীলের গুরুত্ব বৌদ্ধ ধর্মে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং জীবনের সব অবস্থায় তাই সংযত ও সংহত আচরণকে তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ জন্য বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীলে আছে কোনো প্রাণীকে বধ করা থেকে বিরত থাকা এবং কোনো প্রাণীকে হিংসা না করা, কোনো ধরনের চৌর্যবৃত্তি না করা, কোনো ধরনের মিথ্যা কথা না বলা, কোনো ধরনের ব্যভিচার বা যৌনাচার না করা এবং কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য সেবন না করা। এগুলোই হলো সব মানুষের জন্য সুন্দর আচরণবিধি যা সৌজন্যতা, ভদ্রতা ও সর্বজনীন মানবতা শেখায়। এছাড়া উচ্চ আদর্শে পেঁৗছার জন্য এ নীতিগুলো মানুষকে শীলাচার, মার্জিত রুচি ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় এবং সৃজনশীল কর্মে, সাম্য, মৈত্রী ও আত্মজয়ের আদর্শে মানুষকে উজ্জীবিত ও সম্পূর্ণ মানবিক গুণাবলি অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে। আজ বিশ্বের সর্বত্র মানুষের মানবিক গুণাবলি ভূলুণ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সব স্থানে একটা উত্তেজনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিরাজ করছে ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের লেলিহান শিখা। এ কারণে আজ বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। আজ এ অস্থিরতা ও উত্তেজনা কাটানোর জন্যই বুদ্ধের অহিংস ও সাম্যনীতি অনুসরণ করা আমাদের জরুরি। তাই আজ বুদ্ধ পূর্ণিমার এ শুভ দিনে, শুভ তিথিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়সহ বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে আহ্বান জানাই সাম্য ও অহিংস আদর্শে উজ্জীবিত হতে। চিত্তের সব হিংসা, দ্বেষ, বৈরিতা পরিহার করি, চিত্তকে পরিশুদ্ধ করি, চিত্তকে নির্মল করি। 'সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু'_ জগতের সকল জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ সুখী ও সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বর্ষণ হোক। 'ভবতু সব্ব মঙ্গলং'_ সকলের মঙ্গল লাভ হোক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ূয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
No comments