সমকালীন প্রসঙ্গ-সংবিধান সংশোধন ও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা by বদিউল আলম মজুমদার
বিরাজমান ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি অনির্বাচিত সরকারের কাছে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর করে, যা অনেকের মতেই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূলনীতির এবং মৌলিক কাঠামোর অংশ।
তাই আদালত এটিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করাই স্বাভাবিক এবং যা করা সঙ্গত বলেই আমরা মনে করি। বস্তুত আমরা মনে করি যে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আদালত সঠিক রায়ই দিয়েছেন
গত ২১ জুলাই ২০১০ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ধারা ২৬৬-এর অধীনে সরকার সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন এবং সংসদীয় আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে ১৫ সদস্যের একটি 'সংসদীয় বিশেষ কমিটি' গঠন করে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ১২ জনই আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। বাকিরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরীক দলগুলোর প্রতিনিধি। কমিটিতে বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে তাদের প্রতিনিধির নাম প্রেরণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
আমাদের জানা মতে, সংসদীয় বিশেষ কমিটির জন্য লিখিতভাবে কোনো কার্যপরিধি বা 'টার্মস অব রেফারেন্স' (টিওআর) নির্ধারিত করা হয়নি। তবে কমিটি গঠনের প্রস্তাব সংসদে উত্থাপনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন : উচ্চ আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলার রায় বাস্তবায়ন ও কঠোর শাস্তি বিধানের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখল রোধ। এ দুটি উদ্দেশ্য সংবলিত প্রস্তাবই সংসদে গৃহীত হয়েছে এবং এগুলোই কমিটির জন্য নির্ধারিত কার্যপরিধি বলে আমরা মনে করি। প্রসঙ্গত, আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ মে ভবিষ্যতে অপশক্তির ক্ষমতায় আসা বন্ধ করতে সংবিধান সংশোধন হচ্ছে বলে আবারও দাবি করেন, যদিও অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সাংবিধানিক বিধান পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জোর করে ক্ষমতা দখল প্রতিহত করতে পারেনি।
সাল্ফপ্রতিককালে আমাদের উচ্চ আদালত আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় ঘোষণা করেছেন, যা আমলে নেওয়াও কমিটির জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যেমন, গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ হয়ে পড়েছে। আদালত অবশ্য সময়ের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার বিবেচনায় এ পদ্ধতি আরও দুই টার্ম অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছেন। একইসঙ্গে আদালত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে দূরে রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, অনেকেই এ রায়কে স্ববিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, আদালত একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অবৈধ ঘোষণা করতে এবং একইসঙ্গে এটি আরও দুই টার্ম রাখার পক্ষে মত দিতে পারেন না। তবে আমরা মনে করি না যে, রায়টি স্ববিরোধী। কারণ এখানে দুটি প্রশ্ন জড়িত রয়েছে_ একটি আইনি, আরেকটি রাজনৈতিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বৈধতার প্রশ্নটি আইন সম্পর্কিত। অন্যটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
বিরাজমান ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি অনির্বাচিত সরকারের কাছে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর করে, যা অনেকের মতেই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূলনীতির এবং মৌলিক কাঠামোর অংশ। তাই আদালত এটিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করাই স্বাভাবিক এবং যা করা সঙ্গত বলেই আমরা মনে করি। বস্তুত আমরা মনে করি যে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আদালত সঠিক রায়ই দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে সাময়িকভাবে, আগামী দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখা একটি রাজনৈতিক বিষয়, যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রাজনীতিবিদদের। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আদালত এটিকে বৈধতা দিতেই পারেন, যদিও এটি রাখা আইনগতভাবে সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। স্মরণ করা প্রয়োজন, বাস্তবতা হলো যে, আদালত নির্ধারিত অ্যামিকাস কিউরিদের প্রায় সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এছাড়াও আমাদের ধারণা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছাড়া প্রায় সকল নাগরিকই বর্তমান বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষে। আনেকেই মনে করেন, এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলে আগামী নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং আমরা একটি ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হবো। তাই আমরা মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখার আদালতের সুপারিশ সুবিবেচনাপ্রসূত।
আমি নিজেও গত ৩ মে আদালতের রায় ঘোষণার আগে, সংসদীয় বিশেষ কমিটির সামনে আগামী দুই টার্মের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ লিখিতভাবে উত্থাপন করেছি। আমি আরও সুপারিশ করেছি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেন নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঠিক তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি, ফায়দাতন্ত্র ও প্রশাসনে দলীয়করণের অবসানসহ আরও অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ছাড়াই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হবে।
বলা বাহুল্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে শুধু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভবপর নয়। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে আরও অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বাধা রয়েছে। যেমন, রাজনৈতিক দল ও দলের মনোনীত প্রার্থীদের ছলে-বলে-কলে-কৌশলে নির্বাচনে জেতার মানসিকতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতাহীনতা, কালো টাকার অশুভ প্রভাব ইত্যাদি। তাই বর্তমান সময়ে অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করা দুরাশা মাত্র।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারকদের বাদ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না, যদিও এর ফলে বিচার বিভাগে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং মাননীয় বিচারপতিদের পক্ষ থেকে সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে দলের কাছে দাসত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে বিচারকদের বাইরে সমাজে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আগামী দুই টার্মের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পদ পূরণের লক্ষ্যে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সামনে আমি একটি ভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। আমি আমাদের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করার এবং ওই প্যানেল থেকে তারা নিজেরাই ঐকমত্য বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আগামী দুই টার্মের জন্য কে প্রধান উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করবেন তা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছি। আপিল বিভাগের সকল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকেও এ প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কম প্রাধান্য পাবে বলে আমি মনে করি।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা ছাড়াও উচ্চ আদালত আরও কয়েকটি বিষয়ে সল্ফপ্রতি রায় দিয়েছেন। গত ১১ মে আদালত পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করেন। আদালতের এ রায়ের ফলে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া ১৫ মে প্রদত্ত আরেকটি রায়ে আপিল বিভাগ সপ্তম সংশোধনী, যা জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিয়েছে, বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। এগুলো আদালতের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ রায় এবং এগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এসব জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনী সুপারিশ করাও সংসদীয় বিশেষ কমিটির দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বলে আমরা মনে করি।
আরেকটি বিষয়েও কমিটির সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক। ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। আগামী কয়েক বছর পরই এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়েও কমিটিকে সুপারিশ করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার দিনবদলের সনদ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে সারাদেশে একটি জনমতও বর্তমানে বিরাজ করছে। এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১০০টি আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করার পক্ষে।
এটি সুস্পষ্ট যে, অনেকগুলো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব সংসদীয় বিশেষ কমিটির কাঁধে এসে চেপেছে। এর অনেকগুলোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এবং এগুলো, বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। আমাদেরকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে। দেশে ভয়াবহ রকমের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ ধরনের সংশোধন ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষে এককভাবে করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। এ জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে দ্রুত একত্রে বসে কতকগুলো বিষয়ে সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে। বস্তুত সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া জাতিকে ঐকবদ্ধ করার অংশ হতে পারে। আমরা আশা করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং সম্ভাব্য সংকট এড়াতে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদরা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে এমনি একটি একতা সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়াই অবলম্বন করবেন।
১৭ মে ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, 'সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক'
গত ২১ জুলাই ২০১০ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ধারা ২৬৬-এর অধীনে সরকার সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন এবং সংসদীয় আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপারসন করে ১৫ সদস্যের একটি 'সংসদীয় বিশেষ কমিটি' গঠন করে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ১২ জনই আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। বাকিরা ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরীক দলগুলোর প্রতিনিধি। কমিটিতে বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে তাদের প্রতিনিধির নাম প্রেরণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
আমাদের জানা মতে, সংসদীয় বিশেষ কমিটির জন্য লিখিতভাবে কোনো কার্যপরিধি বা 'টার্মস অব রেফারেন্স' (টিওআর) নির্ধারিত করা হয়নি। তবে কমিটি গঠনের প্রস্তাব সংসদে উত্থাপনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন : উচ্চ আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলার রায় বাস্তবায়ন ও কঠোর শাস্তি বিধানের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখল রোধ। এ দুটি উদ্দেশ্য সংবলিত প্রস্তাবই সংসদে গৃহীত হয়েছে এবং এগুলোই কমিটির জন্য নির্ধারিত কার্যপরিধি বলে আমরা মনে করি। প্রসঙ্গত, আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ মে ভবিষ্যতে অপশক্তির ক্ষমতায় আসা বন্ধ করতে সংবিধান সংশোধন হচ্ছে বলে আবারও দাবি করেন, যদিও অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সাংবিধানিক বিধান পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জোর করে ক্ষমতা দখল প্রতিহত করতে পারেনি।
সাল্ফপ্রতিককালে আমাদের উচ্চ আদালত আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় ঘোষণা করেছেন, যা আমলে নেওয়াও কমিটির জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যেমন, গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ হয়ে পড়েছে। আদালত অবশ্য সময়ের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার বিবেচনায় এ পদ্ধতি আরও দুই টার্ম অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছেন। একইসঙ্গে আদালত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে দূরে রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, অনেকেই এ রায়কে স্ববিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, আদালত একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অবৈধ ঘোষণা করতে এবং একইসঙ্গে এটি আরও দুই টার্ম রাখার পক্ষে মত দিতে পারেন না। তবে আমরা মনে করি না যে, রায়টি স্ববিরোধী। কারণ এখানে দুটি প্রশ্ন জড়িত রয়েছে_ একটি আইনি, আরেকটি রাজনৈতিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বৈধতার প্রশ্নটি আইন সম্পর্কিত। অন্যটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
বিরাজমান ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি অনির্বাচিত সরকারের কাছে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তর করে, যা অনেকের মতেই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূলনীতির এবং মৌলিক কাঠামোর অংশ। তাই আদালত এটিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করাই স্বাভাবিক এবং যা করা সঙ্গত বলেই আমরা মনে করি। বস্তুত আমরা মনে করি যে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আদালত সঠিক রায়ই দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে সাময়িকভাবে, আগামী দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখা একটি রাজনৈতিক বিষয়, যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রাজনীতিবিদদের। বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আদালত এটিকে বৈধতা দিতেই পারেন, যদিও এটি রাখা আইনগতভাবে সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। স্মরণ করা প্রয়োজন, বাস্তবতা হলো যে, আদালত নির্ধারিত অ্যামিকাস কিউরিদের প্রায় সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এছাড়াও আমাদের ধারণা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছাড়া প্রায় সকল নাগরিকই বর্তমান বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষে। আনেকেই মনে করেন, এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলে আগামী নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং আমরা একটি ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হবো। তাই আমরা মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অব্যাহত রাখার আদালতের সুপারিশ সুবিবেচনাপ্রসূত।
আমি নিজেও গত ৩ মে আদালতের রায় ঘোষণার আগে, সংসদীয় বিশেষ কমিটির সামনে আগামী দুই টার্মের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ লিখিতভাবে উত্থাপন করেছি। আমি আরও সুপারিশ করেছি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেন নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঠিক তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি, ফায়দাতন্ত্র ও প্রশাসনে দলীয়করণের অবসানসহ আরও অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যাতে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ছাড়াই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হবে।
বলা বাহুল্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে শুধু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভবপর নয়। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে আরও অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বাধা রয়েছে। যেমন, রাজনৈতিক দল ও দলের মনোনীত প্রার্থীদের ছলে-বলে-কলে-কৌশলে নির্বাচনে জেতার মানসিকতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতাহীনতা, কালো টাকার অশুভ প্রভাব ইত্যাদি। তাই বর্তমান সময়ে অনেকগুলো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করা দুরাশা মাত্র।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারকদের বাদ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না, যদিও এর ফলে বিচার বিভাগে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং মাননীয় বিচারপতিদের পক্ষ থেকে সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে দলের কাছে দাসত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে বিচারকদের বাইরে সমাজে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আগামী দুই টার্মের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পদ পূরণের লক্ষ্যে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সামনে আমি একটি ভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। আমি আমাদের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করার এবং ওই প্যানেল থেকে তারা নিজেরাই ঐকমত্য বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আগামী দুই টার্মের জন্য কে প্রধান উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করবেন তা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছি। আপিল বিভাগের সকল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকেও এ প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কম প্রাধান্য পাবে বলে আমি মনে করি।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা ছাড়াও উচ্চ আদালত আরও কয়েকটি বিষয়ে সল্ফপ্রতি রায় দিয়েছেন। গত ১১ মে আদালত পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করেন। আদালতের এ রায়ের ফলে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া ১৫ মে প্রদত্ত আরেকটি রায়ে আপিল বিভাগ সপ্তম সংশোধনী, যা জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিয়েছে, বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। এগুলো আদালতের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ রায় এবং এগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এসব জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনী সুপারিশ করাও সংসদীয় বিশেষ কমিটির দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বলে আমরা মনে করি।
আরেকটি বিষয়েও কমিটির সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক। ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। আগামী কয়েক বছর পরই এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়েও কমিটিকে সুপারিশ করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার দিনবদলের সনদ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে সারাদেশে একটি জনমতও বর্তমানে বিরাজ করছে। এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১০০টি আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করার পক্ষে।
এটি সুস্পষ্ট যে, অনেকগুলো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব সংসদীয় বিশেষ কমিটির কাঁধে এসে চেপেছে। এর অনেকগুলোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এবং এগুলো, বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। আমাদেরকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে। দেশে ভয়াবহ রকমের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ ধরনের সংশোধন ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষে এককভাবে করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। এ জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে দ্রুত একত্রে বসে কতকগুলো বিষয়ে সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে। বস্তুত সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া জাতিকে ঐকবদ্ধ করার অংশ হতে পারে। আমরা আশা করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং সম্ভাব্য সংকট এড়াতে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদরা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে এমনি একটি একতা সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়াই অবলম্বন করবেন।
১৭ মে ২০১১
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, 'সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক'
No comments