অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন-সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অপেক্ষায়
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও রহস্যজনক। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জারি করাটা অসম্মানজনক। এ কথা জানিয়ে বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাদের পুনর্বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করব।’
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পদ্মা সেতু বিষয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে সরকারের বক্তব্য’ তুলে ধরে এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ইকবাল মাহমুদ, দুই অতিরিক্ত ইআরডি সচিব আরাস্তু খান ও শফিকুল আজম উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে তারা পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি দস্তখত করেছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে, একটি দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এতে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চেয়েও তারা পায়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘শনিবার আমি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রদানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছি এবং সে জন্য তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। আমি আরও বলেছি, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিইনি’—এ কথাটিও সঠিক নয়। এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য রাখার জন্য আমি আজকে আপনাদের ডেকেছি।’
আজ সোমবার জাতীয় সংসদে বিস্তারিত বক্তব্য রাখার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির ফলে সংবাদমাধ্যমে নানা ধরনের আধা-তথ্য অথবা অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে। তাই আমার মনে হলো, বিষয়টিকে খানিকটা প্রাঞ্জল করার দায়িত্ব আমার রয়েছে। সে জন্য আজকে আপনাদের আমন্ত্রণ করেছি এবং সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্য পেশ করছি।’
বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম সংস্থা আখ্যায়িত করে অর্থমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে এক হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে এবং এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩৫টি প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান রয়েছে, যাতে মোট ৪৯৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংক সড়ক ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অর্থায়ন করলেও পরে (২০০৭-০৮ সাল থেকে) তারা এ খাতে বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে অর্থায়নে বিরত থাকে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক আবার সড়ক ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধান সহ-অর্থায়নকারী হিসেবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিলে সম্পাদন করে। কিন্তু প্রকল্পে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে এ বিষয়ে নয় মাস ধরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের আলোচনা এবং চিঠিপত্র আদান-প্রদান হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ নিরসনে আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের আগ্রহের কথা বাজেট-বিষয়ক সমাপনী বক্তব্যেও বিশদভাবে তুলে ধরেছি। সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে, যখন বিশ্বব্যাংক আমাদের নির্মাণ-প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা নিয়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের জন্য জারিজুরি করতে থাকে। এই চীনা প্রতিষ্ঠানের জারিজুরি সমস্তই এই প্রতিষ্ঠানের বাঙালি সহকারীর জালিয়াতি বলে ধরা পড়ে। তা ধরা পড়লে বিশ্বব্যাংক পাঁচটি নির্মাণ-প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা অনুমোদন করে দেয়। কিন্তু সেতুর কাজ অগ্রগতিতে বিলম্ব-প্রক্রিয়া অবলম্বন করে বলে আমাদের মনে হয়। তার পর থেকেই শুরু হয় আমাদের গত নয় মাসের দুর্দিন।’
বিশ্বব্যাংকের প্রথম লিখিত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর সে সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বাজেট-বক্তব্যে আমি জানিয়েছি, বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশে ছয়টি দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে তাদের সুপারিশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আমাদের কাছে পাঠায়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ রাখা হয়নি। সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমি গত অক্টোবরে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং তদন্ত প্রক্রিয়া আলাদা করার জন্য বিশ্বব্যাংককে পরামর্শ দিই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সেটি গ্রহণ করেনি।’
আরও পদক্ষেপের মধ্যে সেতু প্রকল্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক মনে হয় সেসব বিষয় আমলে নেয়নি। এর পরিবর্তে তারা তখন নির্মাণ ঠিকাদারদের বিষয়টি অতিরিক্ত তদন্ত করতে সুপারিশ করে এবং তাদের দৃষ্টি নির্মাণ পরামর্শক ঠিকাদারের দিকে নিবদ্ধ করে। তারা গত এপ্রিলে আমাদের এ বিষয়ে তাদের অভিমত জানায় এবং কানাডীয় কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি বিবেচনা করে তদন্ত জোরদার করতে বলে। আসলে কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই তদন্ত শুরু করে। দুদক নির্মাণ ঠিকাদার সম্বন্ধে তদন্ত প্রতিবেদনও বিশ্বব্যাংককে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক সে ক্ষেত্রেও তাদের অধিকতর তদন্ত করতে সুপারিশ করে। এই বিষয়াবলি দুদকের আওতায় বলে আমরা এ ব্যাপারে মাথা গলাইনি। শুধু মাঝে মাঝে আমরা তদন্তের অগ্রগতি সম্বন্ধে তথ্য চাই। আমরা জানতে পারি যে, বিশ্বব্যাংক এসব বিষয়ে যে নালিশ করেছে, সে সম্বন্ধে অতিরিক্ত কোনো সাক্ষী-সাবুদ দেয়নি এবং দুদক তার নিজস্ব উপায়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই সময়ে আমাদের আমন্ত্রণে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় ইআরডি এবং স্বতন্ত্রভাবে দুদকের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের সঙ্গে ৪ জুন বিস্তৃত আলোচনা হয় এবং আমরা আবারও বলি যে তদন্ত-প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া আলাদা করা হোক। বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় যেহেতু উন্নয়ন-সহযোগীদের অনাপত্তি ছাড়া কখনো কোনো দরপত্র গ্রহণ করা হয় না, সে জন্য বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় এবং বিশেষ করে ক্রয় কার্যক্রমে তাদের অধিকতর ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করি। পরদিন ৫ জুন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে কিছু বিষয়ে আমাদের সম্মতি চায়। এক সপ্তাহ পর ১২ জুন আমাদের মতামত ও পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিই এবং চূড়ান্ত আলোচনার জন্য তাদের আহ্বান করি। আলোচনার জন্য এরপর বিশ্বব্যাংক ২৩ জুন ঢাকায় আরেকটি দল পাঠায়।’ অর্থমন্ত্রী জানান, এই দলের সঙ্গে ইআরডি ও দুদকের আবারও স্বতন্ত্র বৈঠক হয়।
মুহিত বলেন, বিশ্বব্যাংক এই সময়ে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) দাবি করে তারা। তারা আরও দাবি করে, দুদকের কাজের বিষয়ে বিদেশি উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটি টার্মস অব রেফারেন্সে (টিওআর) দুদককে সম্মতি দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার খাতিরে এবং পদ্মা সেতুতে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি বিতাড়নের জন্য অনেক বিষয়ে তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, এমনভাবে বিষয়টির সমাধান হবে, যাতে সম্ভাব্য দুর্নীতির জন্য অসম্মানজনক কোনো এমওইউ সম্পাদন এবং দুদকের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কোনো বিদেশি প্যানেলের সঙ্গে টিওআর গ্রহণ না করতে হয়।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নির্বাহী পরিচালক এখনো বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নানা রকম অহেতুক এবং অযাচিত মন্তব্য যাতে না হয়, সে জন্য আমরা দুর্নীতির বিষয়ে যেসব চিঠিপত্র লিখেছি, সেগুলো সবই আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। আমাদের পদক্ষেপ সম্বন্ধে অন্যান্য অর্থায়নকারীদের অবহিত রেখেছি। আশা করছি, তারা বিশ্বব্যাংকের এই পদক্ষেপটি বিশ্লেষণ করে দেখবে।’
বক্তব্য শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো ছয়টি চিঠি সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করা হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্ব: অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতির প্রমাণের কথা বিশ্বব্যাংক যে বলছে, সেই প্রমাণ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইনে তখনই তা গ্রহণযোগ্য হবে, যখন সাক্ষী পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের কেন, বিশ্বের কোনো আইনেই এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।’
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার বলেছিলেন, বিকল্প অর্থায়নে আরও কম খরচে পদ্মা সেতু করা যেতে পারে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ নিয়েও গণমাধ্যম “দুষ্টু শিরোনাম” করেছে। এটাই হচ্ছে গণমাধ্যম। মাঝে মাঝে ঘাপলা করে ফেলে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর দুটি নকশা রয়েছে। একটি সুদৃশ্য, আরেকটি সাধারণ। সুদৃশ্যটি করতে গেলে ২৯০ কোটি ডলার খরচ পড়বে। আর অন্যটি ২৬০ কোটি ডলারে করা যাবে। যোগাযোগমন্ত্রী এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কম খরচে পদ্মা সেতুর কথা বলেছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ এ অর্থবছরে শুরু হবে। এর বাইরে কিছু বলব না।’
ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হিলারি ক্লিনটনের প্রভাব রয়েছে কি না, এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমি জানি না।’
বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে দুর্নীতির জন্য সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়ী করেছে—এ প্রশ্নটি করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চুরি করা কাগজ নিয়ে করা রিপোর্টের উত্তর আমি দিতে রাজি নই।’
অর্থমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠিগুলো সাংবাদিকদের ভালোভাবে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘চিঠিগুলো পড়ুন, দেখুন, দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, কোনোমতেই সেগুলো সঠিক নয়। আশা করব, আপনারা নিজের দেশের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকবেন।’
লিখিত বক্তব্যের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে তারা পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি দস্তখত করেছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে, একটি দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এতে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চেয়েও তারা পায়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘শনিবার আমি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রদানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছি এবং সে জন্য তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। আমি আরও বলেছি, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিইনি’—এ কথাটিও সঠিক নয়। এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য রাখার জন্য আমি আজকে আপনাদের ডেকেছি।’
আজ সোমবার জাতীয় সংসদে বিস্তারিত বক্তব্য রাখার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির ফলে সংবাদমাধ্যমে নানা ধরনের আধা-তথ্য অথবা অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে। তাই আমার মনে হলো, বিষয়টিকে খানিকটা প্রাঞ্জল করার দায়িত্ব আমার রয়েছে। সে জন্য আজকে আপনাদের আমন্ত্রণ করেছি এবং সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্য পেশ করছি।’
বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম সংস্থা আখ্যায়িত করে অর্থমন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে এক হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে এবং এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩৫টি প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান রয়েছে, যাতে মোট ৪৯৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংক সড়ক ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অর্থায়ন করলেও পরে (২০০৭-০৮ সাল থেকে) তারা এ খাতে বিগত সরকারের সময়ে দুর্নীতির কারণে অর্থায়নে বিরত থাকে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক আবার সড়ক ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধান সহ-অর্থায়নকারী হিসেবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিলে সম্পাদন করে। কিন্তু প্রকল্পে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে এ বিষয়ে নয় মাস ধরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের আলোচনা এবং চিঠিপত্র আদান-প্রদান হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ নিরসনে আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের আগ্রহের কথা বাজেট-বিষয়ক সমাপনী বক্তব্যেও বিশদভাবে তুলে ধরেছি। সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে, যখন বিশ্বব্যাংক আমাদের নির্মাণ-প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা নিয়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের জন্য জারিজুরি করতে থাকে। এই চীনা প্রতিষ্ঠানের জারিজুরি সমস্তই এই প্রতিষ্ঠানের বাঙালি সহকারীর জালিয়াতি বলে ধরা পড়ে। তা ধরা পড়লে বিশ্বব্যাংক পাঁচটি নির্মাণ-প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা অনুমোদন করে দেয়। কিন্তু সেতুর কাজ অগ্রগতিতে বিলম্ব-প্রক্রিয়া অবলম্বন করে বলে আমাদের মনে হয়। তার পর থেকেই শুরু হয় আমাদের গত নয় মাসের দুর্দিন।’
বিশ্বব্যাংকের প্রথম লিখিত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর সে সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বাজেট-বক্তব্যে আমি জানিয়েছি, বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশে ছয়টি দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে তাদের সুপারিশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আমাদের কাছে পাঠায়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ রাখা হয়নি। সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমি গত অক্টোবরে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং তদন্ত প্রক্রিয়া আলাদা করার জন্য বিশ্বব্যাংককে পরামর্শ দিই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সেটি গ্রহণ করেনি।’
আরও পদক্ষেপের মধ্যে সেতু প্রকল্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক মনে হয় সেসব বিষয় আমলে নেয়নি। এর পরিবর্তে তারা তখন নির্মাণ ঠিকাদারদের বিষয়টি অতিরিক্ত তদন্ত করতে সুপারিশ করে এবং তাদের দৃষ্টি নির্মাণ পরামর্শক ঠিকাদারের দিকে নিবদ্ধ করে। তারা গত এপ্রিলে আমাদের এ বিষয়ে তাদের অভিমত জানায় এবং কানাডীয় কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি বিবেচনা করে তদন্ত জোরদার করতে বলে। আসলে কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই তদন্ত শুরু করে। দুদক নির্মাণ ঠিকাদার সম্বন্ধে তদন্ত প্রতিবেদনও বিশ্বব্যাংককে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক সে ক্ষেত্রেও তাদের অধিকতর তদন্ত করতে সুপারিশ করে। এই বিষয়াবলি দুদকের আওতায় বলে আমরা এ ব্যাপারে মাথা গলাইনি। শুধু মাঝে মাঝে আমরা তদন্তের অগ্রগতি সম্বন্ধে তথ্য চাই। আমরা জানতে পারি যে, বিশ্বব্যাংক এসব বিষয়ে যে নালিশ করেছে, সে সম্বন্ধে অতিরিক্ত কোনো সাক্ষী-সাবুদ দেয়নি এবং দুদক তার নিজস্ব উপায়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই সময়ে আমাদের আমন্ত্রণে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় ইআরডি এবং স্বতন্ত্রভাবে দুদকের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের সঙ্গে ৪ জুন বিস্তৃত আলোচনা হয় এবং আমরা আবারও বলি যে তদন্ত-প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া আলাদা করা হোক। বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় যেহেতু উন্নয়ন-সহযোগীদের অনাপত্তি ছাড়া কখনো কোনো দরপত্র গ্রহণ করা হয় না, সে জন্য বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় এবং বিশেষ করে ক্রয় কার্যক্রমে তাদের অধিকতর ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করি। পরদিন ৫ জুন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে কিছু বিষয়ে আমাদের সম্মতি চায়। এক সপ্তাহ পর ১২ জুন আমাদের মতামত ও পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিই এবং চূড়ান্ত আলোচনার জন্য তাদের আহ্বান করি। আলোচনার জন্য এরপর বিশ্বব্যাংক ২৩ জুন ঢাকায় আরেকটি দল পাঠায়।’ অর্থমন্ত্রী জানান, এই দলের সঙ্গে ইআরডি ও দুদকের আবারও স্বতন্ত্র বৈঠক হয়।
মুহিত বলেন, বিশ্বব্যাংক এই সময়ে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) দাবি করে তারা। তারা আরও দাবি করে, দুদকের কাজের বিষয়ে বিদেশি উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটি টার্মস অব রেফারেন্সে (টিওআর) দুদককে সম্মতি দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার খাতিরে এবং পদ্মা সেতুতে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি বিতাড়নের জন্য অনেক বিষয়ে তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, এমনভাবে বিষয়টির সমাধান হবে, যাতে সম্ভাব্য দুর্নীতির জন্য অসম্মানজনক কোনো এমওইউ সম্পাদন এবং দুদকের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কোনো বিদেশি প্যানেলের সঙ্গে টিওআর গ্রহণ না করতে হয়।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নির্বাহী পরিচালক এখনো বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নানা রকম অহেতুক এবং অযাচিত মন্তব্য যাতে না হয়, সে জন্য আমরা দুর্নীতির বিষয়ে যেসব চিঠিপত্র লিখেছি, সেগুলো সবই আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। আমাদের পদক্ষেপ সম্বন্ধে অন্যান্য অর্থায়নকারীদের অবহিত রেখেছি। আশা করছি, তারা বিশ্বব্যাংকের এই পদক্ষেপটি বিশ্লেষণ করে দেখবে।’
বক্তব্য শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো ছয়টি চিঠি সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করা হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্ব: অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতির প্রমাণের কথা বিশ্বব্যাংক যে বলছে, সেই প্রমাণ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইনে তখনই তা গ্রহণযোগ্য হবে, যখন সাক্ষী পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের কেন, বিশ্বের কোনো আইনেই এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।’
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার বলেছিলেন, বিকল্প অর্থায়নে আরও কম খরচে পদ্মা সেতু করা যেতে পারে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ নিয়েও গণমাধ্যম “দুষ্টু শিরোনাম” করেছে। এটাই হচ্ছে গণমাধ্যম। মাঝে মাঝে ঘাপলা করে ফেলে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর দুটি নকশা রয়েছে। একটি সুদৃশ্য, আরেকটি সাধারণ। সুদৃশ্যটি করতে গেলে ২৯০ কোটি ডলার খরচ পড়বে। আর অন্যটি ২৬০ কোটি ডলারে করা যাবে। যোগাযোগমন্ত্রী এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কম খরচে পদ্মা সেতুর কথা বলেছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ এ অর্থবছরে শুরু হবে। এর বাইরে কিছু বলব না।’
ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হিলারি ক্লিনটনের প্রভাব রয়েছে কি না, এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমি জানি না।’
বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে দুর্নীতির জন্য সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়ী করেছে—এ প্রশ্নটি করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চুরি করা কাগজ নিয়ে করা রিপোর্টের উত্তর আমি দিতে রাজি নই।’
অর্থমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠিগুলো সাংবাদিকদের ভালোভাবে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘চিঠিগুলো পড়ুন, দেখুন, দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, কোনোমতেই সেগুলো সঠিক নয়। আশা করব, আপনারা নিজের দেশের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকবেন।’
No comments