সাইবার অপরাধ-অ্যামেজিং অনুসন্ধান :একটি বিপদ সংকেত... by রাশেদ মেহেদী
বাস্তবে কেউ যদি একটি চমৎকার সাজানো-গোছানো ফুলের বাগান তৈরি করে তার মধ্যে একটি আফিম কিংবা হেরোইনের দোকান বসিয়ে দেয়, তাকে আপনি কী বলবেন? ফুলের বাগান করার জন্য তাকে ধন্যবাদ দেবেন, না ফুলের বাগানের আড়ালে আফিমের দোকান দেওয়ার জন্য তিরস্কার করবেন? অ্যামেজিং আড্ডার মতো এ ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড অনলাইন ফোরামকে তুলনা করা যায় আফিমের দোকানসহ একটি ফুলের বাগান হিসেবে।
এদের প্রচ্ছদে দেখবেন বেশকিছু চিত্তাকর্ষক আহামরি শব্দ। কিন্তু তার আড়ালে সবচেয়ে বড় এবং প্রধান যে অংশটি তা হচ্ছে 'হট এরিয়া'। সাইবার জগতের আফিম হচ্ছে এসব হট এরিয়া। অনেকে বলেছেন, অনলাইনে অ্যাডাল্ট সাইট তো অনেক আছে। অ্যামেজিং আড্ডার দোষ এত বড় করে দেখা হচ্ছে কেন? এর কারণ হচ্ছে, এই অনলাইন ফোরামের হট এরিয়াজুড়ে রয়েছে আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশের বাঙালি তরুণীদের অসংখ্য গোপন ভিডিও চিত্র। এরা প্রতি সপ্তাহে প্রতি পার্বণে ঘোষণা দিয়ে বাঙালি মেয়েদের গোপন ভিডিও চিত্র আপলোড করছে। গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি কিংবা যৌন হয়রানির দৃশ্য সংবলিত ভিডিও চিত্র এই ফোরাম সবচেয়ে বেশি আপলোড করেছে। গত ঈদুল ফিতরে একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীর প্রেমিকের সঙ্গে একান্ত মুহূর্তের ভিডিও চিত্র, বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে একজন টেলিভিশন উপস্থাপিকার গোপন ভিডিও চিত্র, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নোংরা সংলাপসহ রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে গণধর্ষণের চিত্র এরা ঘোষণা দিয়ে উপহার (!) দিয়েছে। যখন আমার রিপোর্টটি প্রকাশ হলো তার দু'তিন দিন পর এক স্কুলছাত্রী, আর একজন মডেলের গোপন ভিডিও ক্লিপও এরা আপলোড করার ঘোষণা দিয়েছে। এদের অ্যাডাল্ট পিকচার কর্নারে বিভিন্ন নাটক এবং চলচ্চিত্রের শুটিং চলাকালে অভিনেত্রীদের বিব্রতকর কিছু মুহূর্তের অসংখ্য ছবি এরা আপলোড করেছে। এমন কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ আছে, যেখানে রাস্তায় জোর করে পথ আটকে একটা মেয়েকে যৌন হয়রানি করছে কয়েকজন বখাটে; ব্যস্ত মার্কেটের ভিড়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন একজন মাঝবয়সী মহিলা, সেই দৃশ্যও গোপনে ভিডিও করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকানাবিহীন অনলাইন ফোরামগুলো এসব কী ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজে? মার্কেটের ভিড়ে একজন নারীর পথচলাও এখন নিরাপদ নয়। ভিড়ের মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে সেই মুহূর্তের ছবি ভিডিও হয়ে চলে যাবে অনলাইনে! যৌন হয়রানি নিয়ে এত সমালোচনা, এত আতঙ্ক চারদিকে, সেই যৌন হয়রানিকে ফান হিসেবে প্রমোট করা হচ্ছে অ্যামেজিং আড্ডার নামে! কী জঘন্য রুচি! কী ভয়ঙ্কর ব্যবসা! এরা এত ভিডিও ক্লিপ পাচ্ছে কোথায়? এমন সন্দেহ অস্বাভাবিক নয় যে, এরা একটি পেশাদার গ্রুপকে গোপন ক্যামেরা হাতে দেশের ভেতরে ছড়িয়ে দিয়েছে, যারা বিভিন্ন কৌশলে স্কুল-কলেজের টিনএজ ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করে একান্ত মুহূর্তের ছবি তোলার কাজ করছে! আর সেই ছবি আপলোড করে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদেছে অ্যামেজিং আড্ডা! এ ধরনের আরও অনলাইন ফোরাম আছে। কিন্তু এদের বিশেষত্ব হচ্ছে গোপন ভিডিও চিত্র এবং বাঙালি তরুণী। হয়তো এদের সঙ্গে প্যাকেজ নির্মাতা কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাতা কোনো প্রতিষ্ঠানও জড়িত থাকতে পারে! না হলে এরা নাটকের বিভিন্ন শুটিং চলাকালে অভিনেত্রীদের বাথরুমে গোসল করাসহ বিব্রতকর মুহূর্তের এত ছবি পাচ্ছে কোথায়? এরাই একমাত্র অনলাইন ফোরাম যারা আগাম ঘোষণা দিয়ে এসব ভিডিও চিত্র আপলোড করছে। সন্দেহটা এখানেই, এরা শুধু অনলাইনে নয়, বাস্তব জগতেও ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে জড়িত! সাধারণ যুক্তির বিচারে এই সন্দেহ যদি সত্য হয় তাহলে বিষয়টি কত ভয়ঙ্কর ভাবা যায়? যুক্তির খাতিরে যদি বাস্তবে তারা ব্ল্যাকমেইল নাও করে তাহলেও এভাবে ঘোষণা দিয়ে দেশের শত শত তরুণীর গোপন দৃশ্যের ভিডিও চিত্র আপলোড করাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া যায়? তাদের এই গোপন চিত্র নীরবে-নিভৃতে কত নারীর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে, কতজন অভিমানে অকালে চলে যাচ্ছে তার খোঁজ কি আমরা রাখতে পারছি? এই তো বছরখানেক আগে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে তার আপত্তিকর ছবি অনলাইনে প্রকাশ হওয়ার পর। পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, 'সাইবার ক্রাইম কেড়ে নিল প্রাণ'। আরও কত অজানা ঘটনা আছে, সব কি শিরোনামে আসছে? তাহলে কি অ্যামেজিং আড্ডার মতো ফোরামগুলো হত্যার সমান অপরাধ করছে না? যে অভিনেত্রীর প্রেমিক তার একান্ত ভিডিও চিত্র ধারণ করে অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছে, সে কি প্রেমিকার মুখে এসিড ছুড়ে দেওয়ার মতো অপরাধ করেনি? আর অ্যামেজিং আড্ডার মতো সাইটগুলো সেই অবৈধ এসিড কেনাবেচার ব্যবসাই করছে। বাস্তবে অবৈধ এসিড কেনাবেচা যেমন অপরাধ, তেমনি এই ফোরামগুলোর গোপন ভিডিও আপলোড করার বিষয়টিও একই সমান অপরাধ। মাদক যেমন তরুণ সমাজকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়, জীবনীশক্তি ধ্বংস করে দেয়, তেমনি অনলাইনে অ্যামেজিং আড্ডাসহ নীল নির্জনে, বাংলায় চটি ডট কম, পরদেশি মামু, যৌবনযাত্রার মতো 'ভদ্রবেশী নোংরা' সাইটগুলো তরুণ সমাজকে বিকৃত রুচির, অমানবিক করে তুলছে। মাদকদ্রব্য প্রকাশ্যে বিক্রি এবং বহন যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, তাহলে এই সাইটগুলো সেই অপরাধই করছে।
ভয়ঙ্কর এসব সাইট যে কোনো মুহূর্তে যে কারও চরিত্র হননে ব্যবহার হতে পারে। যারা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ আছে, তারাও কি এই শঙ্কার বাইরে? তা মোটেও নয়। যে কোনো সময় যে কারও মুখ যে কোনো ছবির সঙ্গে জোড়া দিয়ে যে কাউকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে এ ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড সাইট। এদের তৎপরতা বন্ধ করতে বাধা কোথায়? একটা আইসিটি নীতিমালা আছে এখানেও। সেখানে অনলাইনে চরিত্র হনন করা হয় এমন সাইট পরিচালনা বন্ধের ব্যাপারে কিছু নীতিবাক্য আছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় পর্নোগ্রাফি বন্ধে একটা খসড়া আইনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। আইন চূড়ান্ত করার সময় দুটি বিষয়ে নজর রাখা দরকার। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশি সাইট দাবি করা হলে সেখানে ওয়েব পেজে কন্ট্রাক্ট অংশে এবং ডোমেইনে অ্যাডমিন কন্ট্রাক্ট অংশে এর পরিচালকদের পরিষ্কার নাম-ঠিকানা দিতে হবে। অ্যামেজিং আড্ডার সারভার সাইপ্রাসে। কিন্তু এর ডোমেইনে বাহামার একটি ঠিকানা এবং নম্বর দেওয়া হয়েছে। কোনো পরিচালকের নাম কিংবা কার্যকর আছে এমন ই-মেইল অ্যাড্রেসও নেই। আমাদের দেশে এর আগে অনেক ভালো আইন হয়েছে, কিন্তু শুরু থেকেই অপপ্রয়োগের কারণে সেই আইন শেষ পর্যন্ত মানুষের কাঁধে বোঝা হয়ে গেছে। এ কারণে এই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ কিংবা এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হলে সে জন্যও অপপ্রয়োগকারীর শাস্তির বিধান রাখাটা খুব জরুরি।
রাশেদ মেহেদী : সাংবাদিক
ভয়ঙ্কর এসব সাইট যে কোনো মুহূর্তে যে কারও চরিত্র হননে ব্যবহার হতে পারে। যারা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ আছে, তারাও কি এই শঙ্কার বাইরে? তা মোটেও নয়। যে কোনো সময় যে কারও মুখ যে কোনো ছবির সঙ্গে জোড়া দিয়ে যে কাউকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে এ ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড সাইট। এদের তৎপরতা বন্ধ করতে বাধা কোথায়? একটা আইসিটি নীতিমালা আছে এখানেও। সেখানে অনলাইনে চরিত্র হনন করা হয় এমন সাইট পরিচালনা বন্ধের ব্যাপারে কিছু নীতিবাক্য আছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় পর্নোগ্রাফি বন্ধে একটা খসড়া আইনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। আইন চূড়ান্ত করার সময় দুটি বিষয়ে নজর রাখা দরকার। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশি সাইট দাবি করা হলে সেখানে ওয়েব পেজে কন্ট্রাক্ট অংশে এবং ডোমেইনে অ্যাডমিন কন্ট্রাক্ট অংশে এর পরিচালকদের পরিষ্কার নাম-ঠিকানা দিতে হবে। অ্যামেজিং আড্ডার সারভার সাইপ্রাসে। কিন্তু এর ডোমেইনে বাহামার একটি ঠিকানা এবং নম্বর দেওয়া হয়েছে। কোনো পরিচালকের নাম কিংবা কার্যকর আছে এমন ই-মেইল অ্যাড্রেসও নেই। আমাদের দেশে এর আগে অনেক ভালো আইন হয়েছে, কিন্তু শুরু থেকেই অপপ্রয়োগের কারণে সেই আইন শেষ পর্যন্ত মানুষের কাঁধে বোঝা হয়ে গেছে। এ কারণে এই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ কিংবা এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হলে সে জন্যও অপপ্রয়োগকারীর শাস্তির বিধান রাখাটা খুব জরুরি।
রাশেদ মেহেদী : সাংবাদিক
No comments