পদ্মা সেতু : বিশ্বব্যাংকের না by মোহাম্মদ আবদুর রহমান খান
অবশেষে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে দিল। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার গভীর রাতে বিশ্বব্যাংক এ সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞসহ বিশিষ্টজনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই বিব্রতকর অবস্থায় আমাদের কী করণীয়?
বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির ধুয়া তুলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তি করেও যখন পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বব্যাংকের মনে যদি কোনো দুরভিসন্ধি থাকে, তাহলে কী করে বাংলাদেশ সরকার তা বুঝবে এবং তাদের অন্যায্য ও অযৌক্তিক দাবিদাওয়া পূরণ করবে? এখন তো বাতাসে অনেক কথাই ভেসে বেড়ায়, আর এসব কথার শেষ নেই। অনেকেই বলে থাকেন, বিশ্বব্যাংক একটি রাজনৈতিক ব্যাংক, তাই বিশ্বব্যাংকের অন্যায্য ও অযৌক্তিক শর্তগুলো পূরণ করলেই পদ্মা সেতুর জন্য তারা অর্থ ছাড় করবে, আর তা যত দিন পূরণ করা না হবে, তত দিন অর্থ ছাড়ের বিষয়টি ঝুলেই থাকবে। এখানে আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বব্যাংকে কতটুকু চাঁদা প্রদান করে থাকে? এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের দেশের চেয়ে উন্নত বিশ্বের কিছু প্রভাবশালী দেশের চাঁদা দেওয়ার হার অনেক বেশি। কাজেই ওসব দেশ তো চাইবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর প্রভাব খাটাতে। আর এ জন্যই পদ্মা সেতুতে অর্থ জোগানদাতা অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যেমন- এডিবি, জাইকা ও আইডিবির কোনো সাহসই নেই বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করার। সুতরাং বিশ্বব্যাংক যে পথে হাঁটবে তারা সে পথই অনুসরণ করবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার আর কত দিন অপেক্ষা করবে? দিন যতই যাবে, সেতু প্রকল্পের ব্যয় ততই বৃদ্ধি পাবে। কারণ সেতু নির্মাণের সামগ্রী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ব্যয়, সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যেসব প্রকৌশলী, উপদেষ্টাপ্রতিষ্ঠান, নির্মাণ তদারকিপ্রতিষ্ঠান নিয়োগ পাবে, পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের সম্মানী ও বেতন-ভাতাদি এবং প্রকল্পসংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। ফলে সেতুর বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। সেতুর ব্যয় তখন আরো বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ পড়বে। বাড়বে দেশের মানুষের ওপর ঋণের বোঝা।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে, এই কয়েক বছর আগে (সম্ভবত ২০০৮ সালের প্রথম দিকে) বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে মূল অর্থ জোগানদাতা (Lead Donor) হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা সেতু বিভাগে এসে কত অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ বিশ্বব্যাংকের ধারণা ছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) যদি মাতব্বরিটা করে, তবে তাদের মূল্য থাকে কোথায়? কেননা জাইকা কর্তৃক পদ্মা সেতুর বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর পরবর্তী সময় সেতুর নকশা প্রণয়ন ও অন্যান্য সমীক্ষা পরিচালনার জন্য অর্থঋণ সহায়তা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), তখন বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসেনি।
কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে পদ্মা সেতুর মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এবং এ সেতু বাস্তবায়নের স্টিয়ারিংটা তাদের কবজায় নেওয়ার জন্য তখন ঘন ঘন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বনানীর সেতু বিভাগে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে যায়। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ও আমেরিকার নাগরিক, বিশ্বব্যাংকের পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ মাসুদ আহমেদ, ভারতের কলকাতার অরুণ ব্যানার্জি, ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংক অফিসের কর্মকর্তা, বাংলাদেশি সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার মহিউজ্জামান কাজী ও প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট রিফাত সুলতানা। মাসুদ আহমেদ সেতু বিভাগে এলেই এবং তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলতেন, 'তোমার সচিবকে বোঝাও, বিশ্বব্যাংককে যেন মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, আর তা করা হলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য যা অর্থ লাগবে, বিশ্বব্যাংক তা দেবে। আরো যদি কোনো সমীক্ষা পরিচালনার জন্য অর্থ লাগে, সে অর্থও বিশ্বব্যাংক দেবে।' আর এখন এগুলোর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে বিশ্বব্যাংক প্রস্তুত। বিশ্বব্যাংকের মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার এমন অভিলাষের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা কর্তৃক দেওয়া প্রস্তাবটি সে সময়কার সেতু বিভাগে নিয়োজিত সচিব সি কে কিউ মুশতাককে (বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত) অবহিত করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো অভিমত ব্যক্ত না করে বরং বলতেন, 'এটা সরকারের বিষয়। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সেতু বিভাগ বাস্তবায়ন করবে।'
কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করবে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার। ৩৪ বছরে তারা উঠিয়ে নেবে এক হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। মালয়েশিয়া দুবাইয়ের অন্যান্য অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ তহবিল সংগ্রহ করে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করবে এবং তাদের সুদের হার নূ্যনতম ৮ শতাংশ অথবা আরো বেশি হতে পারে। অন্যদিকে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান বিষয়ে চুক্তি করে সরকার। ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ জুন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে চার হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা (৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। দাতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সুদের হার অনেক কম। এ হার হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের ঋণের সার্ভিস চার্জ বা সেবা ব্যয়ের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সুদের হার দেড় শতাংশ, জাইকার সুদের হার দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং আইডিবির সুদের হার প্রায় ৩ শতাংশ।
গত ২৮ মে ২০১২ পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এদিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সামি ভেলু বনানীর সেতু ভবনে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হাতে এ প্রস্তাব হস্তান্তর করেন। প্রস্তাবটি হস্তান্তরের পর মালয়েশিয়ার দলটির সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই পক্ষই তিন-চার মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়েছে। জানা গেছে, মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে আছে বিভিন্ন বিষয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কত দিনে সেতু নির্মাণ করা হবে, নির্মাণকাজ কারা বাস্তবায়ন করবে, কত টাকা খরচ হতে পারে এবং টোল কী হতে পারে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া তাদের প্রস্তাবে বলেছে প্রকল্পের জন্য অর্থ জোগাড়, মূল সেতু নির্মাণ, পাইলিং, নদীশাসনসহ বিভিন্ন কাজের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কথা। সামি ভেলুর প্রতিনিধিদলে ছিল ক্যাপিটাল ট্রাস্ট গ্রুপ নামে একটি অর্থ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। আরো ছিলেন কোরিয়ার স্যামসাং কম্পানির প্রতিনিধিরাও।
উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আরো ৩৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। তা ছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিশ্রুত আরো প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার। তাই এই ইস্যুটি স্পর্শকাতর। একদিকে মালয়েশিয়ার উচ্চ সুদের হার, অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিলের স্পর্শকাতর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আর যাই হোক, উচ্চ হারের সুদে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে বিভিন্ন শর্তে ঋণ নেওয়া কতটা সুবিধাজনক হবে, অবশ্যই তা বাংলাদেশ সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। এমনিতেই বিদেশি ঋণ আর এর সুদ পরিশোধ করতে করতে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন রীতিমতো কাহিল। পদ্মা সেতু নির্মাণে অবশ্যই বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজতে হবে, তবে সব স্বার্থ রক্ষা করেই।
আমাদেরও কথা- আর নয়, পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। আর যে করেই হোক আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
লেখক : সেতু বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে, এই কয়েক বছর আগে (সম্ভবত ২০০৮ সালের প্রথম দিকে) বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে মূল অর্থ জোগানদাতা (Lead Donor) হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা সেতু বিভাগে এসে কত অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ বিশ্বব্যাংকের ধারণা ছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) যদি মাতব্বরিটা করে, তবে তাদের মূল্য থাকে কোথায়? কেননা জাইকা কর্তৃক পদ্মা সেতুর বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর পরবর্তী সময় সেতুর নকশা প্রণয়ন ও অন্যান্য সমীক্ষা পরিচালনার জন্য অর্থঋণ সহায়তা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), তখন বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসেনি।
কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে পদ্মা সেতুর মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এবং এ সেতু বাস্তবায়নের স্টিয়ারিংটা তাদের কবজায় নেওয়ার জন্য তখন ঘন ঘন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বনানীর সেতু বিভাগে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে যায়। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ও আমেরিকার নাগরিক, বিশ্বব্যাংকের পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ মাসুদ আহমেদ, ভারতের কলকাতার অরুণ ব্যানার্জি, ঢাকাস্থ বিশ্বব্যাংক অফিসের কর্মকর্তা, বাংলাদেশি সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার মহিউজ্জামান কাজী ও প্রজেক্ট অ্যানালিস্ট রিফাত সুলতানা। মাসুদ আহমেদ সেতু বিভাগে এলেই এবং তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলতেন, 'তোমার সচিবকে বোঝাও, বিশ্বব্যাংককে যেন মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, আর তা করা হলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য যা অর্থ লাগবে, বিশ্বব্যাংক তা দেবে। আরো যদি কোনো সমীক্ষা পরিচালনার জন্য অর্থ লাগে, সে অর্থও বিশ্বব্যাংক দেবে।' আর এখন এগুলোর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে বিশ্বব্যাংক প্রস্তুত। বিশ্বব্যাংকের মূল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার এমন অভিলাষের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা কর্তৃক দেওয়া প্রস্তাবটি সে সময়কার সেতু বিভাগে নিয়োজিত সচিব সি কে কিউ মুশতাককে (বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত) অবহিত করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো অভিমত ব্যক্ত না করে বরং বলতেন, 'এটা সরকারের বিষয়। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সেতু বিভাগ বাস্তবায়ন করবে।'
কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করবে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার। ৩৪ বছরে তারা উঠিয়ে নেবে এক হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। মালয়েশিয়া দুবাইয়ের অন্যান্য অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ তহবিল সংগ্রহ করে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করবে এবং তাদের সুদের হার নূ্যনতম ৮ শতাংশ অথবা আরো বেশি হতে পারে। অন্যদিকে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান বিষয়ে চুক্তি করে সরকার। ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ১৪ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তাবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৬ জুন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে চার হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা (৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। দাতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সুদের হার অনেক কম। এ হার হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের ঋণের সার্ভিস চার্জ বা সেবা ব্যয়ের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সুদের হার দেড় শতাংশ, জাইকার সুদের হার দশমিক শূন্য ১ শতাংশ এবং আইডিবির সুদের হার প্রায় ৩ শতাংশ।
গত ২৮ মে ২০১২ পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এদিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সামি ভেলু বনানীর সেতু ভবনে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হাতে এ প্রস্তাব হস্তান্তর করেন। প্রস্তাবটি হস্তান্তরের পর মালয়েশিয়ার দলটির সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই পক্ষই তিন-চার মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়েছে। জানা গেছে, মালয়েশিয়ার প্রস্তাবে আছে বিভিন্ন বিষয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কত দিনে সেতু নির্মাণ করা হবে, নির্মাণকাজ কারা বাস্তবায়ন করবে, কত টাকা খরচ হতে পারে এবং টোল কী হতে পারে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া তাদের প্রস্তাবে বলেছে প্রকল্পের জন্য অর্থ জোগাড়, মূল সেতু নির্মাণ, পাইলিং, নদীশাসনসহ বিভিন্ন কাজের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কথা। সামি ভেলুর প্রতিনিধিদলে ছিল ক্যাপিটাল ট্রাস্ট গ্রুপ নামে একটি অর্থ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। আরো ছিলেন কোরিয়ার স্যামসাং কম্পানির প্রতিনিধিরাও।
উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আরো ৩৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। তা ছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিশ্রুত আরো প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার। তাই এই ইস্যুটি স্পর্শকাতর। একদিকে মালয়েশিয়ার উচ্চ সুদের হার, অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিলের স্পর্শকাতর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আর যাই হোক, উচ্চ হারের সুদে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে বিভিন্ন শর্তে ঋণ নেওয়া কতটা সুবিধাজনক হবে, অবশ্যই তা বাংলাদেশ সরকারের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। এমনিতেই বিদেশি ঋণ আর এর সুদ পরিশোধ করতে করতে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন রীতিমতো কাহিল। পদ্মা সেতু নির্মাণে অবশ্যই বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজতে হবে, তবে সব স্বার্থ রক্ষা করেই।
আমাদেরও কথা- আর নয়, পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। আর যে করেই হোক আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
লেখক : সেতু বিভাগের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
No comments