ভারতকে ট্রানজিট দিতে নৌ প্রটোকলের পরিধি বাড়ছে! by রাহীদ এজাজ
অবকাঠামোর অভাব এবং আইনি-প্রক্রিয়া শেষ না হলেও সরকারের দায়িত্বশীল একটি মহল ভারতকে নৌ-পথে ট্রানজিট (পণ্য পারাপার) দিতে উদ্যোগী রয়েছে। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার সুবিধার্থে দুই দেশের বিদ্যমান বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ অতিক্রম ও জলবাণিজ্য প্রটোকল বা পিআইডব্লিউটিটি পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নৌ-প্রটোকলের আওতায় সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নেই। কেননা, এ প্রটোকল অনুযায়ী শুধু নৌ-পথেই ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য আনা-নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নৌ-প্রটোকলকে আন্তদেশ পরিবহন চুক্তিতে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই চুক্তিটির নতুন নাম হবে আন্তদেশ পরিবহন চুক্তি। এতে নৌ, সড়ক, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ রাখা হতে পারে।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে কার্যত ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিই নিশ্চিত করা হবে।
জানা গেছে, আজ সোমবার থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ-সচিবদের বৈঠকে নৌ-পথে ট্রানজিটের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। ট্রানজিটের বিষয়ে সুরাহা না হলে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ অতিক্রম ও জলবাণিজ্য প্রটোকল বা পিআইডব্লিউটিটি তিন বছরের জন্য নবায়নের সিদ্ধান্ত হতে পারে।
হোটেল সোনারগাঁওয়ে আজ থেকে দুই দিনের বৈঠকে বাংলাদেশের ১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন নৌ-পরিবহনসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার। ভারতের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন সে দেশের নৌ-সচিব প্রদীপ কুমার সিনহা।
এদিকে দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ট্রানজিট বাস্তবায়নের বিষয়টিতে গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো অনুরোধ জানায়নি ভারত। তবে ভারতের পক্ষ থেকে আভাস দেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ সামগ্রিকভাবে ট্রানজিট বাস্তবায়নে বাংলাদেশ দেরি করলে মিয়ানমারের সঙ্গে নির্মাণাধীন কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পে তাদের অগ্রাধিকার থাকবে।
গত মে মাসে মিয়ানমার সফরের সময় এ প্রকল্পটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
ঢাকায় নৌ-সচিবদের বৈঠক: নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ-পরিবহনসচিবদের বৈঠকে প্রটোকলসংশ্লিষ্ট নিয়মিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ইতিমধ্যেই বৈঠকের আলোচ্যসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আলোচ্যসূচির মধ্যে রয়েছে: গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পর্যালোচনা, যৌথ কারিগরি কমিটির সুপারিশ মূল্যায়ন, প্রটোকলের প্রয়োজনীয় সংশোধন, মাশুলের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিদ্যমান নৌ-রুটের সমস্যা, প্রয়োজনে রুট বাড়ানো, শুল্কায়নসহ অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা করবেন।
ভারতকে নৌ-পথে ট্রানজিট দিতে প্রটোকল সংশোধনের মাধ্যমে এর পরিধি বাড়ানো হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার গতকাল মুঠোফোনে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। বর্তমানে বিদ্যমান প্রটোকল অনুযায়ী ভারত যেভাবে পণ্য পরিবহন করে তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ হয় নৌ-পথে। কাজেই এ অবস্থায় দুই পক্ষ রাজি থাকলে বাকি অংশে সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
নৌ-প্রটোকলের মেয়াদ বাড়বে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, দুই দিনের আলোচনা কাল শুরু হচ্ছে। দুই পক্ষের ওপর এটি নির্ভর করছে। গত এপ্রিলে এটির মেয়াদ এক বছরের জন্য বেড়েছে। যেহেতু এটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আওতাধীন। তাই বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সংগতি রেখে পিআইডব্লিউটিটির মেয়াদও ২০১৫ সাল পর্যন্ত করতে কোনো বাধা নেই।
ট্রানজিটের সমন্বয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে: পিআইডব্লিউটিটিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে আলাদা করতে সক্রিয় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তাঁর যুক্তি, প্রটোকলটি দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তির ১১ ও ১২ (১০) ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, অন্যান্য খাতে আন্তদেশীয় বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ উৎসাহিত হয় না।
তবে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দুটি মন্ত্রণালয় এ প্রক্রিয়ার পক্ষে নয়। তাঁরা মনে করেন, অবকাঠামো প্রস্তুতি শেষ করার পাশাপাশি আইনি-প্রক্রিয়া শেষ করার আগে ট্রানজিট চালু করা ঠিক হবে না।
এ অবস্থায় উপদেষ্টার আগ্রহে ট্রানজিটের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে। এ ব্যাপারে গত ২০ মে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ২৪ মে মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ওই প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে অবহিত নয় বলে জানানো হয়। পাশাপাশি ওই তিন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা এটাও জানতে চান যে এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির সুযোগ আছে কি না। এ পরিস্থিতিতে উপদেষ্টা বৈঠকে জানান, এ ধরনের প্রজ্ঞাপন অন্য কোনো মন্ত্রণালয় জারি করতে পারে কি না, সে ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করবে। পাশাপাশি তিনি নৌ-প্রটোকলকে উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তির আওতায় একটি স্বতন্ত্র প্রটোকল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেন।
কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্প: সম্প্রতি দিল্লি সফরের সময় ভারতের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের এবং ভারতের সঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ বাড়াতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রবর্তী ভারতীয় বন্দরগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সিট্টওয়ে বন্দরের যোগাযোগ ঘটাবে এবং তারপর মিজোরামের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে নদী ও সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ করাবে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের এবং এশিয়ার বাকি অংশের বিকল্প পথ তৈরি হবে।
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে এ প্রকল্পের কাঠামোগত চুক্তি; ট্রানজিট পরিবহনের সুবিধা-সংক্রান্ত প্রটোকল এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক প্রটোকল সই হয়েছে। পুরো প্রকল্পে অর্থায়ন করবে ভারত। আর বিনা মূল্যে জমি দিচ্ছে মিয়ানমার। ভারতের অভ্যন্তরীণ জলনির্মাণ কর্তৃপক্ষ (আইডব্লিউএআই) বন্দরের সার্বিক প্রকল্পের ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন) কাজের উপাদানের উন্নয়ন পরামর্শক।
২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর সিট্টওয়েতে মিয়ানমার-ভারত কালাদান বহুমুখী মডেল ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ২০১০-এর ডিসেম্বরে সিট্টওয়ে নির্মাণ কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ প্রকল্পে সিট্টওয়েতে একটি সমন্বিত বন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন টার্মিনাল নির্মাণ, সিট্টওয়ে থেকে পালেটোয়া (১৫৮ কি.মি.) পর্যন্ত কালাদান নদীর নৌ-চালনযোগ্য পথ উন্নয়ন, পালেটোয়ায় একটি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন-মহাসড়ক ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনাল নির্মাণ এবং সিট্টওয়ে ও পালেটোয়ার মধ্যে মাল পরিবহনের জন্য ছয়টি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন বজরা (৩০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন) নির্মাণ। এর পাশাপাশি এ প্রকল্পে পালেটোয়া থেকে মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত (১২৯ কি.মি.) মহাসড়ক নির্মাণ।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের একজন কূটনীতিক জানান, নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে এবং ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে। পালেটোয়ায় প্রস্তাবিত অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন টার্মিনালের জন্য মিয়ানমার সরকার জমি হস্তান্তর করেছে।
এদিকে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে ভারতের অংশে মিজোরাম রাজ্য সরকার ৫৪ নম্বর জাতীয় মহাসড়ক এবং ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যেকার ৯৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার সড়কপথ উন্নয়ন করছে এবং এই কাজ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র মনে করে, কালাদান প্রকল্প নিয়ে ভারত এগুলেও বাংলাদেশের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে তাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ভারতের আগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ।
তবে দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের জন্য ট্রানজিট জরুরি, এটা বাংলাদেশও জানে। আর ট্রানজিট দিতে বাংলাদেশ রাজি আছে। তবে অবকাঠামোগত প্রস্তুতির অভাবের পাশাপাশি তিস্তার মতো অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়ায়, ট্রানজিট বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা দ্বিধায় রয়েছে। আবার ট্রানজিট বাস্তবায়ন দেরি হলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও ভাবছে বাংলাদেশ।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে কার্যত ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিই নিশ্চিত করা হবে।
জানা গেছে, আজ সোমবার থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ-সচিবদের বৈঠকে নৌ-পথে ট্রানজিটের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। ট্রানজিটের বিষয়ে সুরাহা না হলে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ অতিক্রম ও জলবাণিজ্য প্রটোকল বা পিআইডব্লিউটিটি তিন বছরের জন্য নবায়নের সিদ্ধান্ত হতে পারে।
হোটেল সোনারগাঁওয়ে আজ থেকে দুই দিনের বৈঠকে বাংলাদেশের ১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন নৌ-পরিবহনসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার। ভারতের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন সে দেশের নৌ-সচিব প্রদীপ কুমার সিনহা।
এদিকে দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ট্রানজিট বাস্তবায়নের বিষয়টিতে গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো অনুরোধ জানায়নি ভারত। তবে ভারতের পক্ষ থেকে আভাস দেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ সামগ্রিকভাবে ট্রানজিট বাস্তবায়নে বাংলাদেশ দেরি করলে মিয়ানমারের সঙ্গে নির্মাণাধীন কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পে তাদের অগ্রাধিকার থাকবে।
গত মে মাসে মিয়ানমার সফরের সময় এ প্রকল্পটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
ঢাকায় নৌ-সচিবদের বৈঠক: নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ-পরিবহনসচিবদের বৈঠকে প্রটোকলসংশ্লিষ্ট নিয়মিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ইতিমধ্যেই বৈঠকের আলোচ্যসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আলোচ্যসূচির মধ্যে রয়েছে: গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পর্যালোচনা, যৌথ কারিগরি কমিটির সুপারিশ মূল্যায়ন, প্রটোকলের প্রয়োজনীয় সংশোধন, মাশুলের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ ছাড়া বিদ্যমান নৌ-রুটের সমস্যা, প্রয়োজনে রুট বাড়ানো, শুল্কায়নসহ অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা করবেন।
ভারতকে নৌ-পথে ট্রানজিট দিতে প্রটোকল সংশোধনের মাধ্যমে এর পরিধি বাড়ানো হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার গতকাল মুঠোফোনে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। বর্তমানে বিদ্যমান প্রটোকল অনুযায়ী ভারত যেভাবে পণ্য পরিবহন করে তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ হয় নৌ-পথে। কাজেই এ অবস্থায় দুই পক্ষ রাজি থাকলে বাকি অংশে সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
নৌ-প্রটোকলের মেয়াদ বাড়বে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, দুই দিনের আলোচনা কাল শুরু হচ্ছে। দুই পক্ষের ওপর এটি নির্ভর করছে। গত এপ্রিলে এটির মেয়াদ এক বছরের জন্য বেড়েছে। যেহেতু এটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আওতাধীন। তাই বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সংগতি রেখে পিআইডব্লিউটিটির মেয়াদও ২০১৫ সাল পর্যন্ত করতে কোনো বাধা নেই।
ট্রানজিটের সমন্বয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে: পিআইডব্লিউটিটিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে আলাদা করতে সক্রিয় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তাঁর যুক্তি, প্রটোকলটি দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তির ১১ ও ১২ (১০) ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, অন্যান্য খাতে আন্তদেশীয় বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ উৎসাহিত হয় না।
তবে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দুটি মন্ত্রণালয় এ প্রক্রিয়ার পক্ষে নয়। তাঁরা মনে করেন, অবকাঠামো প্রস্তুতি শেষ করার পাশাপাশি আইনি-প্রক্রিয়া শেষ করার আগে ট্রানজিট চালু করা ঠিক হবে না।
এ অবস্থায় উপদেষ্টার আগ্রহে ট্রানজিটের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে। এ ব্যাপারে গত ২০ মে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ২৪ মে মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ওই প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে অবহিত নয় বলে জানানো হয়। পাশাপাশি ওই তিন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা এটাও জানতে চান যে এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির সুযোগ আছে কি না। এ পরিস্থিতিতে উপদেষ্টা বৈঠকে জানান, এ ধরনের প্রজ্ঞাপন অন্য কোনো মন্ত্রণালয় জারি করতে পারে কি না, সে ব্যাপারে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করবে। পাশাপাশি তিনি নৌ-প্রটোকলকে উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তির আওতায় একটি স্বতন্ত্র প্রটোকল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেন।
কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্প: সম্প্রতি দিল্লি সফরের সময় ভারতের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের এবং ভারতের সঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ বাড়াতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রবর্তী ভারতীয় বন্দরগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সিট্টওয়ে বন্দরের যোগাযোগ ঘটাবে এবং তারপর মিজোরামের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে নদী ও সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ করাবে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের এবং এশিয়ার বাকি অংশের বিকল্প পথ তৈরি হবে।
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে এ প্রকল্পের কাঠামোগত চুক্তি; ট্রানজিট পরিবহনের সুবিধা-সংক্রান্ত প্রটোকল এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক প্রটোকল সই হয়েছে। পুরো প্রকল্পে অর্থায়ন করবে ভারত। আর বিনা মূল্যে জমি দিচ্ছে মিয়ানমার। ভারতের অভ্যন্তরীণ জলনির্মাণ কর্তৃপক্ষ (আইডব্লিউএআই) বন্দরের সার্বিক প্রকল্পের ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন) কাজের উপাদানের উন্নয়ন পরামর্শক।
২০১০ সালের ১৯ ডিসেম্বর সিট্টওয়েতে মিয়ানমার-ভারত কালাদান বহুমুখী মডেল ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ২০১০-এর ডিসেম্বরে সিট্টওয়ে নির্মাণ কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ প্রকল্পে সিট্টওয়েতে একটি সমন্বিত বন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন টার্মিনাল নির্মাণ, সিট্টওয়ে থেকে পালেটোয়া (১৫৮ কি.মি.) পর্যন্ত কালাদান নদীর নৌ-চালনযোগ্য পথ উন্নয়ন, পালেটোয়ায় একটি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন-মহাসড়ক ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনাল নির্মাণ এবং সিট্টওয়ে ও পালেটোয়ার মধ্যে মাল পরিবহনের জন্য ছয়টি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন বজরা (৩০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন) নির্মাণ। এর পাশাপাশি এ প্রকল্পে পালেটোয়া থেকে মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত (১২৯ কি.মি.) মহাসড়ক নির্মাণ।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের একজন কূটনীতিক জানান, নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে এবং ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে। পালেটোয়ায় প্রস্তাবিত অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন টার্মিনালের জন্য মিয়ানমার সরকার জমি হস্তান্তর করেছে।
এদিকে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে ভারতের অংশে মিজোরাম রাজ্য সরকার ৫৪ নম্বর জাতীয় মহাসড়ক এবং ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যেকার ৯৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার সড়কপথ উন্নয়ন করছে এবং এই কাজ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র মনে করে, কালাদান প্রকল্প নিয়ে ভারত এগুলেও বাংলাদেশের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে তাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ভারতের আগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ।
তবে দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের জন্য ট্রানজিট জরুরি, এটা বাংলাদেশও জানে। আর ট্রানজিট দিতে বাংলাদেশ রাজি আছে। তবে অবকাঠামোগত প্রস্তুতির অভাবের পাশাপাশি তিস্তার মতো অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়ায়, ট্রানজিট বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা দ্বিধায় রয়েছে। আবার ট্রানজিট বাস্তবায়ন দেরি হলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও ভাবছে বাংলাদেশ।
No comments