পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা আছে

বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করলেও পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়বে না, বরং বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে না- এ বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার গত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই বিকল্প অর্থায়নের জন্য তৎপরতা শুরু করেছিল।


কারণ একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান আগেই আঁচ করতে পেরে সরকার বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকে। প্রতিশ্রুত সময়েই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হবে। গতকাল রবিবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ ছাড়া গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, যেভাবেই হোক চলতি অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের অর্থেই নির্মাণ করা সম্ভব এ সেতুটি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, 'পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ প্রস্তুতিতে আমরা পিছিয়ে নেই। ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই নির্মাণকাজ শুরুর ব্যাপারে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত 'আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত' নয় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, 'সরকার পূর্বেই আঁচ করতে পেরে এ সেতু নির্মাণে বিকল্প অর্থায়নের প্রস্তুতি নিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া প্রস্তাব দিয়েছে এবং আরো দুটি দেশও আগ্রহ দেখিয়েছে।'
মালয়েশিয়ার অর্থায়নে সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে। জনস্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও দেশের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই এ প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।
জানা গেছে, প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক গত বছর অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে গত বছরের নভেম্বরে। গত ৩১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মালয়েশিয়া সরকারের একটি প্রতিনিধিদল সেতু নির্মাণে তাদের আগ্রহের কথা জানায়। এক পর্যায়ে গত ১০ এপ্রিল মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সরকার। চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে সর্বশেষ ২৮ জুন খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া।
বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর খরচ বাড়বে কি না, জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতু হলে খরচ কমও হতে পারে। এতে জনগণের ওপর আর্থিক চাপ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, যা হবে সারপ্রাইজ।
অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী সোমবার বক্তব্য দেবেন। বিশ্বব্যাংক নিজেদের দরজা নিজেরাই বন্ধ করেছে, আমরা বন্ধ করিনি।'
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করায় সরকার এখন বিকল্প উপায় খুঁজছে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ। গতকাল সচিবালয়ে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) প্রধান সমন্বয়কারীর (লিড এজেন্সি) ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ ছাড়া জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাকে সহকারী ভূমিকা পালন করতে প্রস্তাব দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে এ তিন সংস্থার সঙ্গে পুনরায় ঋণচুক্তি করতে হবে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংককে (আইডিবি) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে তিনি আগামী ১৩ জুলাই জেদ্দা যাচ্ছেন।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় স্বাভাবিকভাবেই অন্য তিন সংস্থার সঙ্গে বহাল থাকা ঋণচুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। তাই ওই তিন সংস্থার সঙ্গে পুনরায় ঋণচুক্তি করতে হবে।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়। গত বছর এপ্রিলে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ২৯০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে তাদের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির 'বিশ্বাসযোগ্য' প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
দেশীয় অর্থেই সম্ভব : পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন দেশীয় অর্থেই সম্ভব। ১৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সভাশেষে পরিকল্পনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে পদ্মা সেতুর জন্য ৮০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫৭২ কোটি টাকা এবং জাপান ঋণ মওকুফ তহবিল (জেডিসিএফ) থেকে ২৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সচিব আবদুল মজিদ বলেন, '২০০৭ সাল থেকেই জাতীয় বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। এই সেতু নিয়ে অনেক বছর কথা হচ্ছে। আগে থেকেই যদি প্রতিবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হতো, তা হলে পুরো অর্থের সংস্থান এত দিনে হয়ে যেত। বাস, ট্রেন, সিনেমার টিকিটে সারচার্জ ধরলে দেশের মানুষের মালিকানার অনুভূতি হয়। এ ছাড়া সিকিউরিটাইজেশন বা বন্ড ছেড়ে প্রবাসীদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। আমরা আসলে চাই কি না সেটিই প্রশ্ন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি চায় তা হলে স্থানীয়ভাবে অর্থের যোগান অবশ্যই সম্ভব।'
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এ ফারুকী অবশ্য মনে করেন সরকার চাইলেও অনেক সময় হয় না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের কারণেই তা সম্ভব হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রয়োজনে সরকার বা দেশের স্বার্থের বাইরে যেতেও রাজি আছেন, তবু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথার বাইরে যেতে চান না। কারণ তাদের সামনে থাকে বিদেশ ভ্রমণ ও কনসালট্যান্সির হাতছানি।'
তিনি প্রশ্ন করেন, যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা ৫ মাসে ১০ শতাংশও খরচ হয় না, সেখানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা খরচ করা হয় না কেন? বাজেটে এর জন্য তিন হাজার কোটি টাকার বেশিও রাখা যেত। পদ্মা সেতুর জন্য পরিবহন বা বিনোদনের টিকিটে লেভি বসানো যায়। বঙ্গবন্ধু সেতু, মেঘনা সেতু সিকিউরিটাইজেশন করে শেয়ারবাজার থেকেও অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। সরকারের সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা থাকলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, 'পুঁজিবাজার থেকেই টাকা সংগ্রহ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। এক্ষেত্রে গ্রিন ফিল্ড প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর নামে একটি কম্পানি গঠন করে দিক সরকার। এরপর এই কম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিক বাজারে। এ দেশে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ও স্কয়ার গ্রিন ফিল্ড প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে বিকশিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রচুর নন-রেসিডেন্সিয়াল বাংলাদেশির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকায় আমার কথা হয়েছে। যাঁরা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। এ ছাড়া দেশের মধ্যে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছেন যাঁরা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে এটা করতে হলে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।'

No comments

Powered by Blogger.