পদ্মা সেতু : ঋণচুক্তি বাতিল-বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত দুঃখজনক

অবশেষে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি বা সম্ভাব্য দুর্নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলে জানিয়েছে। প্রায় ১৪ মাস ঝুলিয়ে রাখার পর মালয়েশিয়ার বিকল্প প্রস্তাব প্রদানের এক দিন পর বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিল তাকে বিশিষ্টজনদের অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন।


অনেকে আবার বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট না করার জন্য দায়ী করেছেন সরকারকে। তাঁরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পুনরায় আলাপ-আলোচনা শুরু করারও তাগিদ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সবাই স্বীকার করেছেন, বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আঘাত। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বা মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের তিন কোটিরও বেশি মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এই পদ্মা সেতু। সরকারের ব্যর্থতার জন্যই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত এই তিন কোটি মানুষের স্বপ্নভঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে তারা সেসব তথ্য দিয়েছে বলে দাবি করলেও না বাংলাদেশ সরকার না বিশ্বব্যাংক- কেউই সেই তথ্যাদি প্রকাশ করেনি। এদিকে কানাডার কম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তারও তদন্ত শেষ হয়নি। কানাডার পুলিশ এখনো সেই তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা বাংলাদেশেও ঘুরে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি জোয়েলিক তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে হঠাৎ করেই ঋণচুক্তিটি বাতিল করে দিলেন। এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশের প্রতিক্রিয়াটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, 'তাদের কাছে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তাহলে তারা তা প্রকাশ করুক। তাদের দুর্নীতির অভিযোগ তো সরকার আমলে নিয়ে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। তদন্ত চলছে। প্রকল্পের কাজও চলতে পারত। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের জন্য পুরো জাতিকে শাস্তি দেওয়া যায় না।'
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের একটি সদস্য রাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিশ্বব্যাংকেরও জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন। তাই তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই সেতু প্রকল্পের কাজ একেবারে বন্ধ না রেখে এবং চুক্তিটি বাতিল না করে বিশ্বব্যাংক আনুষঙ্গিক কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারত। তাও তারা করেনি। জানা যায়, বিশ্বব্যাংক যে পাঁচটি শর্ত দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার এর তিনটি শর্ত মেনেও নিয়েছিল এবং চার দিন আগে চিঠি দিয়ে বিশ্বব্যাংককে তা জানানোও হয়েছিল। তার পরও হঠাৎ করে এই চুক্তি বাতিল করাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্যদিকে ঋণচুক্তি বাতিল ও বিদ্যমান জটিলতার বিষয়ে জানার অধিকার নাগরিক হিসেবে এ দেশের প্রত্যেক মানুষের রয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে যে নীরবতা পালন করেছে, তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। কোন শর্তগুলো মানা হয়েছিল এবং কোন শর্তগুলো মানা যায়নি অথবা কেন মানা যায়নি- সেসব জানতে পারলে সচেতন নাগরিকরা নানাভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারত। ব্যর্থতার দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রেও নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারত। যেহেতু সরকার তা করেনি, তাই এ ব্যর্থতার সব দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। আমরা মনে করি, এখনো এ ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার আশ্রয় নিতে পারে। সরকারের একজন মন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে 'রহস্যজনক' বলে উল্লেখ করেছেন। সেই রহস্যটি কী অথবা পর্দার অন্তরালে কিছু আছে কি না, তাও এ দেশের মানুষকে জানতে দেওয়া উচিত।
অর্থমন্ত্রী আজ সোমবার এ প্রসঙ্গে সংসদে যে বিবৃতি দেবেন, তাতে তিনি পুরো বিষয়টি জনগণের সামনে স্পষ্ট করবেন বলেই আমরা আশা করছি।

No comments

Powered by Blogger.