বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৪৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. দেলাওয়ার হোসেন, বীর প্রতীক দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে একদল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা অপারেশন করে মোগলহাট রেললাইনে।
তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মো. দেলাওয়ার হোসেন। এই অপারেশনের বর্ণনা শোনা যাক তাঁর বয়ান থেকে।
‘একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পড়ছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সেনা আসত। দিনটি ছিল যত দূর সম্ভব ১৫ সেপ্টেম্বর। ভোর পাঁচটায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের কাছে অবস্থান নিই।
‘রেললাইনের ওপর অ্যান্টিট্যাংক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন ও পিইকে ঠিকমতো বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রুট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক সময়েই ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগিতে বালু এবং অন্যান্য জিনিস ভর্তি করে আসে। পেছনের বগিতে ছিল পাকিস্তানি সেনারা।
‘আমাদের অ্যান্টিট্যাংক মাইনের আঘাতে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি ধ্বংস হয়। পাকিস্তানি সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিন দিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দিই।
‘আমার কাছে একটা হালকা মেশিনগান ছিল। সেটা দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাই। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে দুজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও চারজন আহত হন। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের পাঁচজন নিহত ও অনেকে আহত হয়।
‘এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীনবাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয় এবং এর জন্যই বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীকালে আমাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে।’
মো. দেলাওয়ার হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান)। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। প্রথমে কিছুদিন সেক্টর হেডকোয়ার্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মোগলহাট সাবসেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পান।
এই সাবসেক্টর আওতাধীন এলাকা ছিল লালমনিরহাট জেলার (তখন মহকুমা) দক্ষিণ অংশ। লালমনিরহাট সদর, রায়গঞ্জ, কাউনিয়া ও আদিতমারিসহ বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান।
মো. দেলাওয়ার হোসেন অনেক যুদ্ধ ও গেরিলা অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাগেশ্বরীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ, কম্বলপুর সেতু অপারেশন, কুলাহাট পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে হামলা, পাটেশ্বরীতে পাকিস্তানি গোলন্দাজ অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. দেলাওয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪।
মো. দেলাওয়ার হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে জিয়া (জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হত্যা ঘটনায় কথিত অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। বাবার নাম সিকান্দার আলী, মা মকিমুন নেছা। স্ত্রী নূরজাহান দেলাওয়ার। তাঁদের তিন মেয়ে।
সূত্র: নূরজাহান দেলাওয়ার, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
‘একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পড়ছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সেনা আসত। দিনটি ছিল যত দূর সম্ভব ১৫ সেপ্টেম্বর। ভোর পাঁচটায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের কাছে অবস্থান নিই।
‘রেললাইনের ওপর অ্যান্টিট্যাংক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন ও পিইকে ঠিকমতো বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রুট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক সময়েই ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগিতে বালু এবং অন্যান্য জিনিস ভর্তি করে আসে। পেছনের বগিতে ছিল পাকিস্তানি সেনারা।
‘আমাদের অ্যান্টিট্যাংক মাইনের আঘাতে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি ধ্বংস হয়। পাকিস্তানি সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিন দিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দিই।
‘আমার কাছে একটা হালকা মেশিনগান ছিল। সেটা দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাই। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা পেছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে দুজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও চারজন আহত হন। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের পাঁচজন নিহত ও অনেকে আহত হয়।
‘এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীনবাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয় এবং এর জন্যই বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীকালে আমাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে।’
মো. দেলাওয়ার হোসেন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান)। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। প্রথমে কিছুদিন সেক্টর হেডকোয়ার্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মোগলহাট সাবসেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পান।
এই সাবসেক্টর আওতাধীন এলাকা ছিল লালমনিরহাট জেলার (তখন মহকুমা) দক্ষিণ অংশ। লালমনিরহাট সদর, রায়গঞ্জ, কাউনিয়া ও আদিতমারিসহ বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান।
মো. দেলাওয়ার হোসেন অনেক যুদ্ধ ও গেরিলা অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাগেশ্বরীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ, কম্বলপুর সেতু অপারেশন, কুলাহাট পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে হামলা, পাটেশ্বরীতে পাকিস্তানি গোলন্দাজ অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. দেলাওয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪।
মো. দেলাওয়ার হোসেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে জিয়া (জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হত্যা ঘটনায় কথিত অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। বাবার নাম সিকান্দার আলী, মা মকিমুন নেছা। স্ত্রী নূরজাহান দেলাওয়ার। তাঁদের তিন মেয়ে।
সূত্র: নূরজাহান দেলাওয়ার, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments