সমকালীন প্রসঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পালাবদল by বদরুদ্দীন উমর
তৃণমূলের নির্বাচন জয় ও সরকার গঠনের পর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এবার কর্মসূচির সন্ধান করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের সমালোচনা করে ও বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন সেটা চরিতার্থ করা কংগ্রেসীদের কর্ম নয়।
কাজেই তার 'মা মাটি মানুষের' অবস্থা তার সরকারের আমলে কী দাঁড়াবে ভবিষ্যতে সেটিই দেখার কথা
৩৪ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পর বামফ্রন্ট সরকার তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের কাছে পরাজিত হয়েছে। তৃণমূল-কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল হলেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তারা সরকারি দল। এই সত্যটির দিকে তাকালে ২০১১ সালে গঠিত নতুন সরকার জনস্বার্থে কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে কতখানি দুধেভাতে রাখবে তার একটা ধারণা করা কঠিন নয়।
গত শতাব্দীর সত্তর দশকের গোড়া থেকে কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধী ও পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায় ক্ষমতায় থাকার সময় পশ্চিমবঙ্গে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল, জনগণের ওপর যে ব্যাপক ও নির্মম নির্যাতন জারি হয়েছিল তার হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্যই ১৯৭৭ সালে সেখানকার জনগণ কংগ্রেসকে হটিয়ে বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গকে সন্ত্রাসমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি বামফ্রন্ট রক্ষা করেছিল। ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে তারা কৃষকদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা তারা সাধ্যমতো পালন করেছিল। সাধ্যমতো এ কারণে যে, তাদের সরকার ছিল ভারতীয় সংবিধানের অধীন এবং কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ছিল তাদের ভূমি সংস্কার কর্মসূচির বিরোধী। যাই হোক সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ডানপন্থিদের জমি থেকে উচ্ছেদের পথ বন্ধের জন্য আইন করেছিল, তাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল। তারা শিক্ষার সম্প্রসারণ ও শিক্ষকদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছিল, যদিও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তারা কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেনি। উপরন্তু স্কুল পর্যায়ে বেশ কয়েক বছর ইংরেজি শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। পরে তারা এই নীতি পরিবর্তন করলেও ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছিল তা সামাল দেওয়া বা তার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর বিরুদ্ধে মধ্য শ্রেণীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সিপিএমের প্রকৃত কোনো কমিউনিস্ট চরিত্র না থাকলেও তারা সে সময়ে একটি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি হিসেবে যেমন কিছু ইতিবাচক কাজ করেছিল, তেমনি তারা কিছুদিনের মধ্যেই এমন কিছু কাজ শুরু করেছিল যার কোনো সমর্থন জনগণের মধ্যে থাকেনি। সবকিছুর দলীয়করণ ছিল এ ধরনেরই এক কাজ।
১৯৭৭ সাল থেকে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট পরপর সাতটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সাতবার সরকার গঠন করেছিল। যে কোনো দল বা জোটের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় কৃতিত্ব। তবে এর কারণ ছিল পশ্চিমবঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি বা পার্টির অনুপস্থিতি। প্রথম থেকেই সিপিএম বামফ্রন্ট গঠন করে সব বামপন্থি দলকে নিজেদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিল। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বামপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী দল আর গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৯৭৭ সালে প্রায় উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর তারা আর সেখানে মাজা খাড়া করে দাঁড়াতে পারেনি। এই নির্বাচনেও তারা যে সাফল্য অর্জন করেছে তাতে তাদের নিজেদের কৃতিত্ব সামান্য। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে যে ঢেউ উঠেছে সেই ঢেউয়ের মাথায় চড়ে তারা ৪২টি আসন পেয়েছে, নিজেদের একক শক্তির জোরে যার কাছাকাছি যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
একদিকে বামফ্রন্টের মধ্যে সব উল্লেখযোগ্য বামপন্থি দল একত্রিত থাকা এবং অন্যদিকে কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থি কোনো দল বিরোধিতার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে মাঠে না থাকায় বামফ্রন্টের কোনো সংগঠিত বিরোধিতা দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে থাকেনি। এটাই কেরালার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য। পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাস ও নির্যাতনকে এক ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে কংগ্রেস জনগণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং এই নির্বাচনে তাদের ৪২টি আসন সত্ত্বেও জনগণ আজ পর্যন্ত তা ভুলতে পারেনি।
ভূমিহীন কৃষকদের ও বর্গাচাষিদের শোষণ থেকে অনেকখানি মুক্ত করা এবং পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের কিছুটা গণতান্ত্রিকীকরণের ফলে গ্রামাঞ্চলে সিপিএমের শক্তি বৃদ্ধি হয়। গ্রামাঞ্চলে পার্টি ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়। প্রতিটি নির্বাচনে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট কৃষকদের বিপুল সমর্থন লাভ করে। শহরাঞ্চলে বিশেষত কলকাতায় নব্বইয়ের দশক থেকে বামফ্রন্টের কিছু বিরোধিতা দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে তাদের ঘাঁটি শক্তই ছিল। তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দুর্দশা, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দলীয়করণ ইত্যাদি সিপিএম এবং বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তায় ধীরে ধীরে ফাটল ধরায়।
মুসলমানরা সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে অধিকাংশই সিপিএমকে ভোট দিতে থাকেন। কিন্তু এই সমর্থন সত্ত্বেও ৩৪ বছরে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জন্য সামান্যই করেছে। অন্য বিষয় বাদ দিয়ে চাকরির বিষয়টির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, রাজ্যে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের চাকরি হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে! চাকরির ক্ষেত্রে এভাবে যে চরম বৈষম্যের শিকার তারা প্রথম থেকেই হয়েছিলেন, তার কোনো প্রতিকার হয়নি। এক্ষেত্রে সিপিএমের ঔদাসীন্য বিস্ময়কর। কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে অর্থাৎ সরকারি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বড় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই মুসলমানদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। কমিউনিস্ট বা সোস্যাল ডেমোক্রেটিক হিসেবে সিপিএম অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু বাস্তবত তাদের এই অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ কী দাঁড়াল? পাকিস্তান আন্দোলনের সময় জিন্নাহ চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকা অবস্থাকে আন্দোলনের বড় ইস্যু করেছিলেন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এনেছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন 'অসাম্প্রদায়িক' বামফ্রন্ট সরকারের আমলে হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার অর্থ শুধু দাঙ্গাবাজি নয়। ধর্মীয় কারণে সমাজে বৈষম্য তৈরি ও তা জিইয়ে রাখা হলো সাম্প্রদায়িকতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। এদিক দিয়ে কংগ্রেস থেকে সিপিএম কোনো উন্নত চরিত্রের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়নি। মুসলমানদের অবস্থা কংগ্রেসী জমানায় যেমন, সিপিএমের জমানায়ও তেমনি অপরিবর্তিত থেকেছে।
জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের এ অবস্থা কেন? তার কথা ছিল, মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় পারে না! আমি বললাম, পারবে না কেন, বাঙালি মুসলমানরা বাংলাদেশে তো সবকিছুই পারছে। তারা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছে। দেশের বাইরে নানা প্রতিযোগিতায় তারা ভালোই করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তারা পারবে না কেন? তাছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক, কেরানি, অফিসের দারোয়ান ইত্যাদি চাকরির জন্য আবার প্রতিযোগিতা কিসের? তাছাড়া তারা যদি প্রতিযোগিতায় না পারে তাদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা করুন। তার কথা হলো, সংরক্ষণ করা হলে সেটা সাম্প্রদায়িকতা হবে! তাহলে দেখা যাচ্ছে, জিন্নাহ সাহেবের কথাই ঠিক ছিল। মুসলমানদের চাকরিতে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা সাম্প্রদায়িকতা নয়, তাদের পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে টেনে তোলার জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা করলে সেটা সাম্প্রদায়িকতা! এখানে উল্লেখযোগ্য, কেরালায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেই মুসলমান এবং অন্য পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ ছিল ১০ শতাংশ, যা এখনও চালু আছে। সিপিএমের এই 'অসাম্প্রদায়িক' অবস্থানের কারণেই শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা বিগত নির্বাচনে বেশ বড় আকারে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাদের বড়মাপের পরাজয়ের এটাও একটা কারণ। ২০০৪ সালে ভারত সরকার ঘধঃরড়হধষ ঈড়সসরংংরড়হ ভড়ৎ জবষরমরড়হং ধহফ খরহমঁরংঃরপ গরহড়ৎরঃরবং নামে একটি কমিশন গঠন করে। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন নামে এই কমিশন অন্যান্যসহ মুসলমানদের জন্যও সংরক্ষণের সুপারিশ করে। শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে এই সংরক্ষণের সুপারিশ ছিল মুসলমানদের জন্য ১০ শতাংশ। ২০০৬ সালে একই উদ্দেশ্যে সাচার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন মুসলমানদের জন্য কোনো সংরক্ষণের সুপারিশ না করলেও মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া অবস্থার বর্ণনা এতে আছে। এ জন্য তার সুপারিশ ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অধিকতর অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণের সুবন্দোবস্ত, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিকাঠামোর উন্নতি ইত্যাদি। সংরক্ষণের দিক থেকে রঙ্গনাথ কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ ছিল একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো কাজ সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট করেনি, যা এই কমিশন রিপোর্টের আগেই তাদের নিজেদের উদ্যোগে করা উচিত ছিল। তবে নির্বাচনের আগে ২০১০ সালে তারা ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলে। তাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং এটা যে তারা নির্বাচন সামনে রেখে বলেছিল এ বিষয়টি বোঝার কোনো অসুবিধা কারও হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে অবশ্য মুসলমানরা যে সুবিধা পাননি এমন নয়। সাধারণভাবে শিক্ষা সম্প্রসারণের ফল তারা পেয়েছেন। ২০১১ সালে ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তার মধ্যে ২ লাখের বেশি মুসলমান।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের জন্য অনেক অশ্রুপাত করে তাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও সরকারের কাছে সংরক্ষণ কার্যকর করার কোনো প্রস্তাব রাখেননি। নিজে রেলমন্ত্রী থাকার সময়ও রেলে মুসলমানদের জন্য কোনো সংরক্ষণ বা বিশেষ কর্মসংস্থান তিনি করেননি। নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেপরোয়া উদারতার সঙ্গে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিপিএম ও বামফ্রন্টের বিপুল ব্যর্থতাকে পুঁজি করে জনগণের পরিত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেও তিনি তো মূলত কংগ্রেসী এবং কংগ্রেসের সঙ্গেই এখন নির্বাচনী গাঁটছড়া বেঁধেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গেই তিনি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গড়তে চলেছেন। তিনি নিজে দুর্নীতিপরায়ণ নন, কিন্তু তার চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে যেসব দুর্নীতিবাজ আছে তাদের তিনি দেবতা বানিয়ে সরকার চালাবেন এমন চিন্তা অর্থহীন। তাছাড়া বাকুড়ায় তিনি বিশ্বের সব থেকে বড় স্টেডিয়াম বানাবেন, কালকাতাকে লন্ডন বানাবেন, দুই বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১০ লাখ কর্মসংস্থান করবেন ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি যে প্রতারণাপূর্ণ ব্যাপার এ নিয়ে কোনো বিতর্ক করাও অর্থহীন।
ষষ্ঠ ও সপ্তম সরকারের আমলে সিপিএম নানা অপকীর্তি করে জনবিচ্ছিন্ন হলেও তারা ৩৪ বছরে কিছুই করেনি বলে যে প্রচারণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালিয়েছেন সেটা সত্য নয়। দীর্ঘদিন পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় সিপিএমের বিরোধিতাকারী জনগণের ব্যাপক অংশ তাকে অবলম্বন করে সিপিএমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং ভোটে তাদের পরাজিত করেছে। কংগ্রেসীরা ৩৪ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে আবার ক্ষমতায় এসেছে। কংগ্রেস ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে কোনো অপরিচিত দল নয়। মমতা সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার নানাভাবে সাহায্য করবে যে সাহায্য তারা সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে দেয়নি। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, মৌলিক প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ছাড়াও কংগ্রেস একটি দুর্নীতিপরায়ণ দল এবং তাদের সরকার বর্তমানেও অনেক বড়মাপের দুর্নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের যারা আছে তারাও দুর্নীতিবাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেসব জায়গায় ২০০৯ সালে জয়লাভ করেছে সেখানে তারা ভালোমতোই দুর্নীতি করছে। ভবিষ্যতে রাজ্যজুড়েও তাই হবে। 'মা মাটি মানুষ' আওয়াজ তুলে যে রাজনৈতিক হাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলেছেন সেটা অন্তঃসারশূন্য। এটা কোনো কর্মসূচি নয়। তৃণমূলের নির্বাচন জয় ও সরকার গঠনের পর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এবার কর্মসূচির সন্ধান করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের সমালোচনা করে ও বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন সেটা চরিতার্থ করা কংগ্রেসীদের কর্ম নয়। কাজেই তার 'মা মাটি মানুষের' অবস্থা তার সরকারের আমলে কী দাঁড়াবে ভবিষ্যতে সেটিই দেখার কথা।
১৬.৫.২০১১
৩৪ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পর বামফ্রন্ট সরকার তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের কাছে পরাজিত হয়েছে। তৃণমূল-কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল হলেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তারা সরকারি দল। এই সত্যটির দিকে তাকালে ২০১১ সালে গঠিত নতুন সরকার জনস্বার্থে কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে কতখানি দুধেভাতে রাখবে তার একটা ধারণা করা কঠিন নয়।
গত শতাব্দীর সত্তর দশকের গোড়া থেকে কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধী ও পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায় ক্ষমতায় থাকার সময় পশ্চিমবঙ্গে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল, জনগণের ওপর যে ব্যাপক ও নির্মম নির্যাতন জারি হয়েছিল তার হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্যই ১৯৭৭ সালে সেখানকার জনগণ কংগ্রেসকে হটিয়ে বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গকে সন্ত্রাসমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি বামফ্রন্ট রক্ষা করেছিল। ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে তারা কৃষকদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা তারা সাধ্যমতো পালন করেছিল। সাধ্যমতো এ কারণে যে, তাদের সরকার ছিল ভারতীয় সংবিধানের অধীন এবং কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ছিল তাদের ভূমি সংস্কার কর্মসূচির বিরোধী। যাই হোক সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ডানপন্থিদের জমি থেকে উচ্ছেদের পথ বন্ধের জন্য আইন করেছিল, তাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল। তারা শিক্ষার সম্প্রসারণ ও শিক্ষকদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছিল, যদিও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তারা কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেনি। উপরন্তু স্কুল পর্যায়ে বেশ কয়েক বছর ইংরেজি শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। পরে তারা এই নীতি পরিবর্তন করলেও ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছিল তা সামাল দেওয়া বা তার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর বিরুদ্ধে মধ্য শ্রেণীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সিপিএমের প্রকৃত কোনো কমিউনিস্ট চরিত্র না থাকলেও তারা সে সময়ে একটি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি হিসেবে যেমন কিছু ইতিবাচক কাজ করেছিল, তেমনি তারা কিছুদিনের মধ্যেই এমন কিছু কাজ শুরু করেছিল যার কোনো সমর্থন জনগণের মধ্যে থাকেনি। সবকিছুর দলীয়করণ ছিল এ ধরনেরই এক কাজ।
১৯৭৭ সাল থেকে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট পরপর সাতটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সাতবার সরকার গঠন করেছিল। যে কোনো দল বা জোটের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় কৃতিত্ব। তবে এর কারণ ছিল পশ্চিমবঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি বা পার্টির অনুপস্থিতি। প্রথম থেকেই সিপিএম বামফ্রন্ট গঠন করে সব বামপন্থি দলকে নিজেদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিল। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বামপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী দল আর গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৯৭৭ সালে প্রায় উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর তারা আর সেখানে মাজা খাড়া করে দাঁড়াতে পারেনি। এই নির্বাচনেও তারা যে সাফল্য অর্জন করেছে তাতে তাদের নিজেদের কৃতিত্ব সামান্য। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে যে ঢেউ উঠেছে সেই ঢেউয়ের মাথায় চড়ে তারা ৪২টি আসন পেয়েছে, নিজেদের একক শক্তির জোরে যার কাছাকাছি যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
একদিকে বামফ্রন্টের মধ্যে সব উল্লেখযোগ্য বামপন্থি দল একত্রিত থাকা এবং অন্যদিকে কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থি কোনো দল বিরোধিতার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে মাঠে না থাকায় বামফ্রন্টের কোনো সংগঠিত বিরোধিতা দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে থাকেনি। এটাই কেরালার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য। পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাস ও নির্যাতনকে এক ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে কংগ্রেস জনগণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং এই নির্বাচনে তাদের ৪২টি আসন সত্ত্বেও জনগণ আজ পর্যন্ত তা ভুলতে পারেনি।
ভূমিহীন কৃষকদের ও বর্গাচাষিদের শোষণ থেকে অনেকখানি মুক্ত করা এবং পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের কিছুটা গণতান্ত্রিকীকরণের ফলে গ্রামাঞ্চলে সিপিএমের শক্তি বৃদ্ধি হয়। গ্রামাঞ্চলে পার্টি ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়। প্রতিটি নির্বাচনে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট কৃষকদের বিপুল সমর্থন লাভ করে। শহরাঞ্চলে বিশেষত কলকাতায় নব্বইয়ের দশক থেকে বামফ্রন্টের কিছু বিরোধিতা দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে তাদের ঘাঁটি শক্তই ছিল। তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দুর্দশা, চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দলীয়করণ ইত্যাদি সিপিএম এবং বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তায় ধীরে ধীরে ফাটল ধরায়।
মুসলমানরা সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে অধিকাংশই সিপিএমকে ভোট দিতে থাকেন। কিন্তু এই সমর্থন সত্ত্বেও ৩৪ বছরে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জন্য সামান্যই করেছে। অন্য বিষয় বাদ দিয়ে চাকরির বিষয়টির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, রাজ্যে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের চাকরি হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে! চাকরির ক্ষেত্রে এভাবে যে চরম বৈষম্যের শিকার তারা প্রথম থেকেই হয়েছিলেন, তার কোনো প্রতিকার হয়নি। এক্ষেত্রে সিপিএমের ঔদাসীন্য বিস্ময়কর। কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে অর্থাৎ সরকারি অফিস, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বড় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই মুসলমানদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। কমিউনিস্ট বা সোস্যাল ডেমোক্রেটিক হিসেবে সিপিএম অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু বাস্তবত তাদের এই অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ কী দাঁড়াল? পাকিস্তান আন্দোলনের সময় জিন্নাহ চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকা অবস্থাকে আন্দোলনের বড় ইস্যু করেছিলেন। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এনেছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন 'অসাম্প্রদায়িক' বামফ্রন্ট সরকারের আমলে হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার অর্থ শুধু দাঙ্গাবাজি নয়। ধর্মীয় কারণে সমাজে বৈষম্য তৈরি ও তা জিইয়ে রাখা হলো সাম্প্রদায়িকতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। এদিক দিয়ে কংগ্রেস থেকে সিপিএম কোনো উন্নত চরিত্রের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়নি। মুসলমানদের অবস্থা কংগ্রেসী জমানায় যেমন, সিপিএমের জমানায়ও তেমনি অপরিবর্তিত থেকেছে।
জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের এ অবস্থা কেন? তার কথা ছিল, মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় পারে না! আমি বললাম, পারবে না কেন, বাঙালি মুসলমানরা বাংলাদেশে তো সবকিছুই পারছে। তারা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছে। দেশের বাইরে নানা প্রতিযোগিতায় তারা ভালোই করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তারা পারবে না কেন? তাছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক, কেরানি, অফিসের দারোয়ান ইত্যাদি চাকরির জন্য আবার প্রতিযোগিতা কিসের? তাছাড়া তারা যদি প্রতিযোগিতায় না পারে তাদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা করুন। তার কথা হলো, সংরক্ষণ করা হলে সেটা সাম্প্রদায়িকতা হবে! তাহলে দেখা যাচ্ছে, জিন্নাহ সাহেবের কথাই ঠিক ছিল। মুসলমানদের চাকরিতে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা সাম্প্রদায়িকতা নয়, তাদের পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে টেনে তোলার জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা করলে সেটা সাম্প্রদায়িকতা! এখানে উল্লেখযোগ্য, কেরালায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেই মুসলমান এবং অন্য পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ ছিল ১০ শতাংশ, যা এখনও চালু আছে। সিপিএমের এই 'অসাম্প্রদায়িক' অবস্থানের কারণেই শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা বিগত নির্বাচনে বেশ বড় আকারে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাদের বড়মাপের পরাজয়ের এটাও একটা কারণ। ২০০৪ সালে ভারত সরকার ঘধঃরড়হধষ ঈড়সসরংংরড়হ ভড়ৎ জবষরমরড়হং ধহফ খরহমঁরংঃরপ গরহড়ৎরঃরবং নামে একটি কমিশন গঠন করে। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন নামে এই কমিশন অন্যান্যসহ মুসলমানদের জন্যও সংরক্ষণের সুপারিশ করে। শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে এই সংরক্ষণের সুপারিশ ছিল মুসলমানদের জন্য ১০ শতাংশ। ২০০৬ সালে একই উদ্দেশ্যে সাচার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন মুসলমানদের জন্য কোনো সংরক্ষণের সুপারিশ না করলেও মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া অবস্থার বর্ণনা এতে আছে। এ জন্য তার সুপারিশ ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অধিকতর অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণের সুবন্দোবস্ত, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিকাঠামোর উন্নতি ইত্যাদি। সংরক্ষণের দিক থেকে রঙ্গনাথ কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ ছিল একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো কাজ সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট করেনি, যা এই কমিশন রিপোর্টের আগেই তাদের নিজেদের উদ্যোগে করা উচিত ছিল। তবে নির্বাচনের আগে ২০১০ সালে তারা ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলে। তাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং এটা যে তারা নির্বাচন সামনে রেখে বলেছিল এ বিষয়টি বোঝার কোনো অসুবিধা কারও হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে অবশ্য মুসলমানরা যে সুবিধা পাননি এমন নয়। সাধারণভাবে শিক্ষা সম্প্রসারণের ফল তারা পেয়েছেন। ২০১১ সালে ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তার মধ্যে ২ লাখের বেশি মুসলমান।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের জন্য অনেক অশ্রুপাত করে তাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও সরকারের কাছে সংরক্ষণ কার্যকর করার কোনো প্রস্তাব রাখেননি। নিজে রেলমন্ত্রী থাকার সময়ও রেলে মুসলমানদের জন্য কোনো সংরক্ষণ বা বিশেষ কর্মসংস্থান তিনি করেননি। নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেপরোয়া উদারতার সঙ্গে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিপিএম ও বামফ্রন্টের বিপুল ব্যর্থতাকে পুঁজি করে জনগণের পরিত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেও তিনি তো মূলত কংগ্রেসী এবং কংগ্রেসের সঙ্গেই এখন নির্বাচনী গাঁটছড়া বেঁধেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গেই তিনি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গড়তে চলেছেন। তিনি নিজে দুর্নীতিপরায়ণ নন, কিন্তু তার চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে যেসব দুর্নীতিবাজ আছে তাদের তিনি দেবতা বানিয়ে সরকার চালাবেন এমন চিন্তা অর্থহীন। তাছাড়া বাকুড়ায় তিনি বিশ্বের সব থেকে বড় স্টেডিয়াম বানাবেন, কালকাতাকে লন্ডন বানাবেন, দুই বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১০ লাখ কর্মসংস্থান করবেন ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি যে প্রতারণাপূর্ণ ব্যাপার এ নিয়ে কোনো বিতর্ক করাও অর্থহীন।
ষষ্ঠ ও সপ্তম সরকারের আমলে সিপিএম নানা অপকীর্তি করে জনবিচ্ছিন্ন হলেও তারা ৩৪ বছরে কিছুই করেনি বলে যে প্রচারণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালিয়েছেন সেটা সত্য নয়। দীর্ঘদিন পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় সিপিএমের বিরোধিতাকারী জনগণের ব্যাপক অংশ তাকে অবলম্বন করে সিপিএমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং ভোটে তাদের পরাজিত করেছে। কংগ্রেসীরা ৩৪ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে আবার ক্ষমতায় এসেছে। কংগ্রেস ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে কোনো অপরিচিত দল নয়। মমতা সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার নানাভাবে সাহায্য করবে যে সাহায্য তারা সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারকে দেয়নি। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, মৌলিক প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ছাড়াও কংগ্রেস একটি দুর্নীতিপরায়ণ দল এবং তাদের সরকার বর্তমানেও অনেক বড়মাপের দুর্নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের যারা আছে তারাও দুর্নীতিবাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেসব জায়গায় ২০০৯ সালে জয়লাভ করেছে সেখানে তারা ভালোমতোই দুর্নীতি করছে। ভবিষ্যতে রাজ্যজুড়েও তাই হবে। 'মা মাটি মানুষ' আওয়াজ তুলে যে রাজনৈতিক হাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলেছেন সেটা অন্তঃসারশূন্য। এটা কোনো কর্মসূচি নয়। তৃণমূলের নির্বাচন জয় ও সরকার গঠনের পর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এবার কর্মসূচির সন্ধান করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের সমালোচনা করে ও বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন সেটা চরিতার্থ করা কংগ্রেসীদের কর্ম নয়। কাজেই তার 'মা মাটি মানুষের' অবস্থা তার সরকারের আমলে কী দাঁড়াবে ভবিষ্যতে সেটিই দেখার কথা।
১৬.৫.২০১১
No comments