চলতি পথে-কমলা রানীর সাগরদিঘি by দীপংকর চন্দ

১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোয় ভারত সীমান্তবর্তী নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরিতে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি সেনারা। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর স্থানীয় সদস্যদের সশস্ত্র সহযোগিতায় মুক্তিকামী বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিরিশিরি বধ্যভূমিতে।


দুর্গাপুর এম কে সি এম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এ আউয়ালের নৃশংস মৃত্যুর সাক্ষীও বিরিশিরি বধ্যভূমির অপ্রতিভ ধুলামাটি। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি সেনারা এ দেশ ত্যাগ করলে গা-ঢাকা দেয় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।
পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে তারা প্রকাশ্যে এসে দাঁড়ায় আবার। আবার শুরু করে তাদের সহজাত আচরণ। ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে খেলন শুক্লা আমাদের নিয়ে গেলেন এম কে সি এম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশপথের সামনে। সেখানে একটি অনুচ্চ তোরণ দণ্ডায়মান। শহীদ বুদ্ধিজীবী এম এ আউয়ালের স্মরণে নির্মিত এই ধুলামলিন তোরণটি দেখাতে দেখাতে খেলন শুক্লা জানালেন, দুর্গাপুরে শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ প্রয়াসের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভীষণ তৎপর। দুর্গাপুর সদরের ছোট্ট একটি সড়কের নামও তাঁরা রাখেন শহীদ এই বুদ্ধিজীবীর নামে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির অপপ্রয়াসে সড়কের সেই নামটি আজ প্রতিস্থাপিতপ্রায়। উদ্বেগজনক এ তথ্যে বিপন্ন বোধ করি আমরা। খেলন শুক্লার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিষণ্ন মনে রিকশায় চেপে বসি। বিব্রতকর সত্যের দহনজ্বালা প্রশমিত করার জন্য জলের কাছে যাওয়ার কথা মনে হয় আমাদের। কিন্তু কোথায় জল? রিকশাওয়ালা মো. মমিন আমাদের জলের সন্ধান দিলেন, জানালেন কমলা রানীর সাগরদিঘির কথা।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোককাহিনিতে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে থাকা এ দিঘিটির অবস্থান দুর্গাপুর সদর থেকে খুব একটা দূরে নয়। কমলা রানীর সাগরদিঘি নিয়ে দুটি ভিন্ন ধরনের লোককাহিনি প্রচলিত দুর্গাপুর উপজেলায়। তার মধ্যে একটি লোককাহিনির জন্ম বাঙালি সমাজে। অন্য লোককাহিনিটি আদিবাসী গারো সমাজে প্রচলিত।
বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত লোককাহিনি অনুযায়ী, সুসঙ্গ রাজবংশের রাজা জানকীনাথ মল্লিক বিয়ে করেন অপরূপা সুন্দরী কমলা রানীকে। যথাসময়ে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয় তাঁদের সংসারে। একদিন এক শুভমুহূর্তে প্রজাদের কল্যাণ কামনায় সুসঙ্গ রাজবাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল পূর্ব-দক্ষিণে একটি দিঘি খননের কাজ শুরু করলেন রাজা জানকীনাথ। কিন্তু খনন শেষে বিশাল সেই দিঘিতে জলের দেখা মিলল না এতটুকুও। চিন্তায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো রাজার। ঘোরতর অমঙ্গলের আশঙ্কায় তিনি ডেকে পাঠালেন রাজপুরোহিতকে। রাজপুরোহিত নতমুখে জানালেন, যদি কমলা রানীকে বিসর্জন দেওয়া যায় দিঘিবক্ষে, তবেই সে স্থান পরিপূর্ণ হবে জলে। রাজপুরোহিতের কথায় চমকে উঠলেন রাজা। কিন্তু প্রজাহিতার্থে শেষ পর্যন্ত কমলা রানীকে তিনি তুলে দিলেন বিসর্জনের বেদিতে। কমলা রানী বিসর্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাগরসমান জলে ভরে উঠল দিঘির একূল-ওকূল।
লোককাহিনি অনুযায়ী, দিঘিবক্ষে বিসর্জিত হওয়ার পরও কমলা রানী তাঁর শিশুপুত্রকে স্তন্যদান করাতে মাঝেমধ্যেই উঠে আসতেন দিঘির পাড়ে। দাইমার কোলে থাকা শিশুপুত্রকে স্তন্যপান করিয়ে আবার তিনি নেমে যেতেন দিঘিবক্ষে। বিষয়টি জানতে পেরে রাজা একদিন চুপিচুপি উপস্থিত হন দিঘির পাড়ে। কমলা রানী উঠে আসতেই তিনি হাত চেপে ধরেন রানীর। কিন্তু রানী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পুনরায় ঝাঁপ দেন জলে। রানীর অন্তর্ধান ঘটে এবার চিরদিনের মতো।
আদিবাসী গারো সমাজে প্রচলিত লোককাহিনিটিও প্রায় একই ধরনের। কেবল পাত্রীর নাম এবং ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য লক্ষণীয়। গারো লোককাহিনিতে কমলা রানীর নাম রিপরাক রানী। সৌন্দর্যে অতুলনীয় রিপরাক রানীকে বিয়ে করেন সুসঙ্গ রাজবংশের রাজা মল্লিক জানকীনাথ। বিয়ের পরবর্তী ঘটনা সংঘটনের প্রকৃতি বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত লোককাহিনির সঙ্গে খুব একটা বৈসাদৃশ্যপূর্ণ নয়।
যা-ই হোক, রাজপথ ছেড়ে আমাদের রিকশা একটি নির্জন শাখাপথে নেমে এল। জনবিরল সেই শাখাপথ ধরে চলতে চলতে মো. মমিন হঠাৎ থামিয়ে দিলেন রিকশা। চেহারায় একধরনের নির্বিকারত্ব ফুটিয়ে তুলে রিকশা থেকে নেমে আসতে বললেন আমাদের। কেন? কারণ, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের সামনেই নাকি দাঁড়িয়ে আছি আমরা!
তাই নাকি! বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়ার পালা এবার আমাদের! কিন্তু কই! দিগন্তের এ-মাথা ও-মাথায় বারবার তাকিয়েও তো খুঁজে পাই না কোনো দিঘির অস্তিত্ব! নজরে পড়ে না জলের বিন্দুচিহ্ন! চারদিকে শুধু ফসলি জমির সমারোহ আর দুকূল প্লাবিত সবুজ মাঠ। অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে পতিত মানুষের মতো মো. মমিনের মুখের দিকে তাকাই আমরা। প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য এলাকার প্রবীণ অধিবাসী আবদুল মোতালেবের সঙ্গে কথা বলি। সাগরদিঘির পাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেব আমাদের নিশ্চিত করেন, এই জলহীন সুবিস্তৃত প্রান্তরই কমলা রানীর সাগরদিঘি। আমাদের বিবেকবিবর্জিত বৈষয়িক প্রবৃত্তির বলি হয়ে ঐতিহাসিক দিঘি আজ পরিণত হয়েছে ফসলি জমিতে।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.