পুরান ঢাকা-সেরে উঠুক রোগগ্রস্ত নগরী
নাগরিক ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ পশ্চাৎপট নিয়ে আমাদের গর্বের মূল ভিত্তি পুরান ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে যখন ঢাকা শহরের পত্তন ঘটেছিল, তখন এ অঞ্চলে বহু বড় নগর অনাগত কালের গর্ভে ছিল। বিগত ৪০০ বছরে ঢাকা শহর দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, ঊধর্ে্ব প্রসারিত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার তীরের ছোট শহরটি ক্রমান্বয়ে কোটি মানুষের আবাসে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু নগর হিসেবে ঢাকা কখনোই মর্যাদার আসনে উন্নীত হতে পারেনি। পৃথিবীর বাসযোগ্য, বহুপ্রার্থিত নগরীগুলোর তালিকায় ঢাকা নেই। কেউ কেউ আফসোস করে বলেন, আমরা নগর পেয়েছি ৪০০ বছর আগে, কিন্তু নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। একটি নগর ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত, নগর রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিষ্ঠানগুলোর কীভাবে কাজ করা উচিত, এমনকি নাগরিকদের আবশ্যিক কর্তব্যই বা কী, তা এ দেশে এখনও যেন সংশ্লিষ্টদের অজানা। ফলে, আমাদের পরে তৈরি হয়ে এশিয়ার অনুন্নত দেশের নগরগুলো যখন বিশ্বকে মোহিত করে ফেলছে, তখনও আমাদের সামনে সমাধানহীন অসংখ্য সমস্যার ফিরিস্তি। নাগরিক সুবিধার স্বল্পতা নতুন গড়ে ওঠা অংশে কমবেশি আছে। কিন্তু পুরনো অংশে যে শোচনীয় পরিস্থিতি, তার সঙ্গে হয়তো তুলনা চলে না কোনো অঞ্চলের। যে স্থানটিতে ঢাকার উৎপত্তি ঘটেছিল, সেই পুরান ঢাকা হতে পারত দর্শনীয় স্থান। মোহনীয় নদীতীর, মনোমুগ্ধকর জীবনযাপনের নিদর্শনে দেশের ও বাইরের পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো একটি স্থান। সেভাবেই গড়ে তোলা যেত পুরান ঢাকা। কিন্তু এখন এটি যানজট, ঘিঞ্জিগলি, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, দাহ্য রাসায়নিকে ঠাসা একটি বসবাস-অযোগ্য স্থানে পরিণত হয়েছে। দখল ও দূষণে বুড়িগঙ্গা বহু আগেই দুর্গন্ধময়, বিষাক্ত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ডাকাত শহীদ নামে এক অদৃশ্য সন্ত্রাসীর দাপটে সন্ত্রস্ত পুরো জনপদ। পুলিশ জানে, ডাকাত শহীদ নেই এলাকায়। অন্য কেউ তার নামে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি করছে। কিন্তু যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কেন নেওয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্নের উত্তরও নেই। পুরান ঢাকার নিমতলীতে বছরখানেক আগেই ঘটল এক ভয়াবহ অগি্নকাণ্ড। প্রাণ হারাল ১৪০ জন। তবু এর জন্য দায়ী রাসায়নিক কারখানা, গুদাম সব থাকল বহাল তবিয়তে। হয়তো এ থেকে জন্ম নেবে আরও বিয়োগান্ত অগি্নকাণ্ড। শুধু অগি্নকাণ্ডেই নয়, ভূমিকম্পে-ভূমিধসেও এখানে ঘটতে পারে প্রাণহানি। কিন্তু হেরিটেজ-নন হেরিটেজ বিতর্কে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে পারছে না। দূষণে-দখলে পরাস্ত বুড়িগঙ্গা উদ্ধারে নানা গালভরা উদ্যোগ আসে। কিন্তু কিছুতেই দখল-দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না। এই মৃত নদীর বুকে অতীতের সি্নগ্ধ বুড়িগঙ্গা কবে কীভাবে তৈরি হবে কেউ জানে না। আছে গ্যাস সমস্যা, আছে ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত পানির লাইনে দূষিত পানির সমস্যা। রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতাও একে চলাচলের অযোগ্য করে তুলেছে। পুরান ঢাকা নিয়ে সমকালের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে যে বিস্তর সমস্যার কথা উলি্লখিত হয়েছে, তা সমাধানহীনভাবে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলের দিকে মনোযোগ না দিলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এ এলাকাটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। আমরা আশা করি, তেমন না ঘটুক। বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা সমস্যা একদিনে মিটবে না; কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ আসতে হবে। আর সেটি হতে হবে এখনই।
No comments