সরকারের পদক্ষেপ আমলে নেয়নি বিশ্বব্যাংক : অর্থমন্ত্রী

পদ্মা সেতুর কাজে দুর্নীতি যাতে সংঘটিত না হতে পারে, সরকার সর্বতোভাবে সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাই বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং সঠিকও নয়। সুষ্ঠুভাবে বিষয়টির সমাধানের জন্য সরকার এখনো বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা বহাল রেখেছে।


পদ্মা সেতুর প্রাথমিক কাজে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারের সাড়া পর্যাপ্ত ছিল না- এ অজুহাতে শনিবার বিশ্বব্যাংকের আচমকা ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণার পর সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে গতকাল রবিবার অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন।
রবিবার সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিকে অসম্মানজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রহস্যজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের নির্বাহী পরিচালক এই বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তাদের পুনর্বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করব।'
আলোচনা চলতে থাকায় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের খাতিরে বিশ্বব্যাংকের চিঠিপত্র প্রকাশ না করলেও সরকারের লেখা সব কয়টি চিঠির প্রতিলিপি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। আজ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিস্তৃত বক্তব্য দেবেন বলে জানান।
১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে শনিবার জারি করা বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে যে, দুর্নীতি-সংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। তারা এই বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে যে, তারা তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চায় এবং তারা সেটা পায়নি। আমি তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্পর্কে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিইনি- তাদের এ কথাটিও সঠিক নয়।'
বিশ্বব্যাংকের যে তিনটি শর্ত সরকার মানেনি বলে সংস্থাটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে সে প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বিশ্বব্যাংক এই সময়ে আমাদের কাছে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়। তারা বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক দাবি করে। তারা আরো দাবি করে, দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজের বিষয়ে বিদেশি উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটি টার্মস অব রেফারেন্স করার সম্মতি দিতে হবে।' তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার খাতিরে এবং পদ্মা সেতুতে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি বিতাড়নের লক্ষ্যে আমরা অনেক বিষয়ে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিই।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'সম্ভাব্য দুর্নীতির জন্য অসম্মানজনক কোনো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কোনো বিদেশি প্যানেলের সঙ্গে চুক্তি করার পরিবর্তে বিধি-বিধান এবং রীতিনীতি যথেষ্ট শিথিল করে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন শর্তকে আমাদের মতো করে গ্রহণ করি। তার পরও বিশ্বব্যাংক কেন এই ঋণচুক্তি বাতিল করে অসম্মানজনক একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করল, তা বাস্তবেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রহস্যজনক। এই বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।'
বিশ্বব্যাংকের প্রথম লিখিত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পরেই সরকার তৎপর হয় উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বিশ্বব্যাংক আমাদের দেশে সাতটি দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে তাদের সুপারিশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আমাদের কাছে পাঠায়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ করে রাখা হয়নি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি অক্টোবর মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং তদন্ত প্রক্রিয়া আলাদা করার জন্য বিশ্বব্যাংককে পরামর্শ দিই। তারা সেটি গ্রহণ করেনি।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ নিরসনের জন্য আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি। সরকার সেতু প্রকল্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সেসব বিষয় আমলে না নিয়ে তাদের দৃষ্টি নির্মাণ পরামর্শক ঠিকাদারের দিকে নিবদ্ধ করে। তারা গত এপ্রিল মাসে কানাডীয় কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি বিবেচনা করে তদন্ত জোরদার করতে বলে। এই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই তদন্ত শুরু করে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে তদন্ত প্রতিবেদনও বিশ্বব্যাংককে পাঠায়। তার পরও বিশ্বব্যাংক অধিকতর তদন্ত করতে সুপারিশ করে। দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের নিজস্ব উপায়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।'
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, "পদ্মা সেতুর কাজে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের সময় একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশ্বব্যাংক 'জারিজুরি' করতে থাকে এবং পরে সেই প্রতিষ্ঠানের 'জালিয়াতি' ধরা পড়ে যাওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাংকের আগ্রহে ভাটা পড়তে থাকে। এবং তার পর থেকেই শুরু হয় আমাদের গত ৯ মাসের দুর্দিন।"
বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম সংস্থা হিসেবে অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে এক হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে এবং এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩৫টি প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান রয়েছে, যাতে মোট ৪৯৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ২৯০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধান সহ-অর্থায়নকারী হিসেবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিলে সম্পাদন করে। কিন্তু প্রকল্পে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে।
সর্বশেষ ঘটনার বিবরণ দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ৪ জুন আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিশ্বব্যাংক ৫ জুন আমাদের লিখিতভাবে তাদের অবস্থান জানায় এবং কিছু বিষয়ে আমাদের সম্মতি চায়। আমরা ১২ জুন এই বিষয়ে আমাদের মতামত ও পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিই এবং চূড়ান্ত আলোচনার জন্য তাদের আহ্বান করি। অতঃপর বিশ্বব্যাংক এই বিষয়ে ঢাকায় আলোচনার নিমিত্তে আরেকটি দলকে ২৩ জুন প্রেরণ করে। এই দলের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আবারও স্বতন্ত্র বৈঠক হয়। বিশ্বব্যাংক এই সময়ে আমাদের কাছে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়।' এ পর্যায়ে হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের অসম্মানজনক ঘোষণা দিল বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.