চরাচর-ঢাকার কামান by সাজ্জাদ কবির

ঢাকা একটি ঐতিহাসিক শহর। ৪০০ বছরের পুরনো এই শহর। আমাদের উপমহাদেশে এত পুরনো শহর হাতেগোনা। একটি ঐতিহাসিক পুরনো শহরের নানা রকম ঐতিহ্য থাকে। ঢাকা শহরের এ রকম অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী বিষয় রয়েছে। আর এসবের মধ্যে ভারতখ্যাত যে ঐতিহ্য, সেটি হলো ঢাকার কামান।


যুদ্ধের মতো একটা রক্তক্ষয়ী বিষয়ে যে মানুষের গর্ব করার থাকতে পারে, তা ঢাকার কামান না দেখলে বোঝা যায় না। এর নির্মাণশৈলী আর আকার যে এটিকে একটা দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত করেছে তা যে কেউ স্বীকার করবে না।
মগ, পর্তুগিজ আর আরাকান জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষা করার জন্য অনেক কামান তৈরি করা হয়। এই কামানগুলো তৈরি হয় সতেরো শতকের ত্রিশের দশকে। এই কামানগুলোর মধ্যে আকারে বড় ছিল দুটি। এর একটির নাম 'কালে খাঁ জমজম' আর অন্যটির নাম 'বিবি মরিয়ম'। বিশাল এই কামান দুটি ছিল ভারতখ্যাত। শুধু আকারে নয়- এগুলোর নির্মাণশৈলীও ছিল অপূর্ব। আর এ কারণে এগুলো ছিল তখনকার ঢাকাবাসীর গর্বের বস্তু।
বহুকাল ধরে এ দেশে যুদ্ধাস্ত্রের নাম দেওয়ার প্রচলন আছে। সে কারণে কামান দুটির নাম রাখা হয় 'কালে খাঁ জমজম' এবং 'বিবি মরিয়ম'। কে কামান দুটির নামকরণ করেছেন, তা জানা যায়নি। তবে সম্ভবত কালে খাঁ নামে কোনো বীর বা শহীদের নামেই এই কামানের নাম রাখা হয়। আর বিবি মরিয়ম হতে পারে কালে খাঁর স্ত্রীর নাম। কালে খাঁ জমজম কামানটি ছিল সবচেয়ে বড় আর বিবি মরিয়ম আকারে তার চেয়ে ছোট। সম্রাট আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ কামানের যে তালিকা তৈরি করান, তার মধ্যে কালে খাঁ জমজম ছিল। বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন কালে খাঁ জমজমের বিষয়ে।
বিবি মরিয়ম কামানটি সেই তুলনায় বেশ ছোট। এর দৈর্ঘ্য ১১ ফুট। এই কামানটির মুখের ব্যাস ৬ ইঞ্চি। আর এর গোলার ওজন বলা হয় পাঁচ মণ। সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ১৬৬০ সালে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। ১৬৬১ সালে মীর জুমলা আসাম অভিযানের সময় ছয়টি ভারী কামান ব্যবহার করেন। বিবি মরিয়ম ছিল এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনি যুদ্ধে বিজয় লাভ করে ফিরে এসে বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারি ঘাটের পাশে স্থাপন করেন। তখন থেকে এটি মীর জুমলার কামান নামে পরিচিতি লাভ করে।
কালে খাঁ জমজম তখনো রাখা ছিল মোগলাই চরে। কিন্তু সেখানে ভাঙন দেখা দেয়। তখন ইংরেজ আমল। ১৭৭৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিতে চাকরি নিয়ে আসা রবার্ট লিন্ডসের লেখা থেকে পাওয়া যায়- চরটা দুই দিক থেকেই ভাঙছিল। কামানটি হুমকির মধ্যে ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটির বিষয়ে ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। একদিন কালে খাঁ জমজম বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়। ১৮৪০ সালে তখনকার ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটারস বিবি মরিয়মকে সোয়ারি ঘাট থেকে সরিয়ে স্থাপন করেন চকবাজারে। চকবাজার ঘনবসতি এলাকায় পরিণত হলে ১৯২৫ সালে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর নলিনী কান্ত ভট্টশালী কামানটি সদর ঘাটে স্থাপন করেন। তার পর গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিবি মরিয়মকে স্থাপন করা হয় গুলিস্তানে। গুলিস্তান তখন ঢাকার কেন্দ্রস্থল। তখন থেকে এটিকে মানুষ গুলিস্তানের কামান বলত। এরপর ১৯৮৩ সালে সরকার এ কামানটি ওসমানী উদ্যানে স্থাপন করে। এখন পর্যন্ত বিবি মরিয়ম সেখানেই আছে।
সাজ্জাদ কবির

No comments

Powered by Blogger.