জীবনের কঠিনতম যুদ্ধ লড়ছেন যুবরাজ
ল্যান্স আর্মস্ট্রং, সাইমন ও'ডোনেল ও এরিক আবিদাল_এমন তিন ক্রীড়াবিদ, যাঁরা মাঠের অর্জনের চেয়েও বেশি মহীয়ান প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কারণে। আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়ে ভারতকে ২০১১ বিশ্বকাপ জেতানো যুবরাজ সিংয়ের জীবনেও বেশ কিছুদিন ধরে চলছে সেই যুদ্ধ। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় যুবরাজের এই যুদ্ধ নিয়ে ছাপা হওয়া লেখাটি তুলে দেওয়া হল আমাদের পাঠকদের জন্য
পাহাড়ের চূড়া আর সমুদ্রের তল। দুটোই ভারতীয় ক্রিকেটে সমানভাবে সবচেয়ে বেশি দেখেছেন কে?
স্পোর্টস কুইজে প্রশ্নটা একাধিকবার এসেছে। বিকল্প যে কটি নামই দেওয়া থাক, ঠিক উত্তর_মহিন্দর অমরনাথ।
ভারতীয় কুইজমাস্টাররা মনে হয় না জানেন যে ২০১১-এর শেষ অর্ধে এসে মহিন্দর জবাব দিলে উত্তরটা সম্পূর্ণ ভুল হবে। ঠিক উত্তর যুবরাজ সিং। বিশ্বকাপের 'ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট' তিনি। ৯ ম্যাচে দুর্ধর্ষ ৩৬২ রান, ১৫ উইকেট, মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সব 'পারফরম্যান্স'। এরপর দুনিয়া অত্যাশ্চর্যভাবে বদলে গিয়েছে মাঝের আট মাসে। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কামব্যাক ঘটিয়েছিলেন বিশ্বকাপে। সেখান থেকে অদৃষ্টের স্খলনে ফের তলদেশে যুবরাজ।
ওয়াংখেড়েতে যখন তিনি সেরার সেরার ট্রফি নিচ্ছেন, তখন কে জানত পরের আট মাসে ভারতের হয়ে একটাও ওয়ানডে ম্যাচ খেলা হবে না তাঁর? আর কবে হবে, তা-ও চলে যাবে আশঙ্কার গর্ভে? কে জানত এমন রোমাঞ্চকর কামব্যাকেও যুবরাজ সিংয়ের সুস্থির হওয়ার উপায় থাকবে না। পরের মাসেই তাঁকে কিনা নেমে পড়তে হবে জীবনের কঠিনতম যুদ্ধে। লড়তে হবে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে, যাকে ব্যাট-বলের দক্ষতা দিয়ে হারানোর উপায় নেই। এর নাম ক্যান্সার। যার মুখোমুখি দাঁড়ালে ওষুধ ছাড়া মাত্র দুটি অস্ত্র_ধৈর্য এবং অনমনীয় মনের জোর।
রবিবার যুবরাজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনন্দবাজারকে বলছিলেন, 'আপনারা লেখেন_ও মাঠের হিরো। গত কয়েক মাসে কাছ থেকে দেখার পর মনে হচ্ছে, ওকে জীবনের হিরোও বলার সময় হয়েছে।' ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসে কোনো শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদের এমন শারীরিক বিপন্নতার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইতিহাস নেই। মনসুর আলী খান পতৌদি একমাত্র তুলনা হতে পারেন। কিন্তু পতৌদি এক চোখ হারালেও এত সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে নিয়ত যুঝেননি। আন্তর্জাতিক মঞ্চ তল্লাশি করলে হাতে গুনে তিনটি উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। বার্সেলোনা ডিফেন্ডার এরিক আবিদাল, সাইমন ও'ডোনেল এবং ল্যান্স আর্মস্ট্রং। এ বছরই ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার পর দেড় মাসের মধ্যে অস্ত্রোপচার করিয়ে চমকপ্রদভাবে মাঠে ফেরেন আবিদাল। এমনকি, নেমে পড়েন বার্সেলোনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। সাইমন ও'ডোনেলের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল ১৯৮৭ সালে। ইডেনে তাঁরা বিশ্বকাপ জেতার পরপর। পরের বছরই অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে টিমে তাঁর নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে। এর দুই বছর পরে ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি হৈচৈ ফেলে দেন ১৮ বলে ৫০ করে। তবে ও'ডোনেল কখনো দূর কল্পনাতেও যুবরাজ মাপের ক্রিকেটার নন। একমাত্র আর্মস্ট্রংয়ের কাহিনীটাই অলৌকিক। গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ম্যাচের আগে রাহুল দ্রাবিড়কে বহুবার আর্মস্ট্রংয়ের বই পড়ে উদ্দীপ্ত হতে দেখা গেছে। সেখানে আর্মস্ট্রং ব্যাখ্যা করেছেন, ১৯৯৬-এ ক্যান্সার রোগী হয়েও কিভাবে পরবর্তী সময়ে টানা সাত বছর ট্যুর দ্য ফ্রান্স জিতেছিলেন।
দ্রাবিড়ের হয়তো সময় হয়েছে আর্মস্ট্রংয়ের বইটা যুবরাজকে উপহার দেওয়ার। ক্যান্সারকে হারানোর যুদ্ধে আর্মস্ট্রংই আজ পর্যন্ত লড়াকু ক্রীড়াবিদের সেরা বিজ্ঞাপন। অবশ্য দ্রাবিড় প্রকৃত সত্য জানেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ভারতীয় ড্রেসিংরুম সূত্রের খবর, একমাত্র শচীন টেন্ডুলকারকে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। যুবরাজ একাধিকবার বলেছেন, 'ক্রিকেটে তাঁর প্রত্যাবর্তনের কারণ শচীন। এবারও নাকি শচীন অনুপ্রাণিত করেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই দ্রুতই আবার মাঠে ফিরবি।' যুবরাজের এক বন্ধুর ভাষায়, আগেও শচীন ওর কাছে 'মিস্টার ইনস্পিরেশন' ছিল। এখনো।
যুবরাজ পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্য রবিবারও বলা হলো, তাঁর বাঁ ফুসফুসে যে টিউমার ধরা পড়েছে সেটা নন-ম্যালিগন্যান্ট। প্রাথমিক রিপোর্টে নাকি ওটা ক্যান্সার সেল-ই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তৃতীয় বায়োপসিতে নাকি দেখা যায়, টিউমারটি নন-ম্যালিগন্যান্ট। অতএব ভয়ের কারণ নেই। ঠিক পারিবারিক এই ব্যাখ্যাতেই কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। রয়েছে স্বভাবতই স্পর্শকাতর কিছু প্রসঙ্গ। রয়েছে সহজবোধ্য কিছু সীমাবদ্ধতা।
শনিবার হঠাৎ প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কেন যুবরাজের পরিবার থেকে তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হলো, যেখানে অসুখ ধরা পড়েছে গত ২৭ মে? চণ্ডীগড় থেকে এ দিন যুবরাজের মা শবনম সিং ফোনে বললেন, 'মুখ না খুললে বিভ্রান্তি বাড়ছিল। যুবরাজকে নিয়ে এমনিতেই তো সব সময় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা চলে। এর আগে বলা হয়েছিল, সুরেশ রায়না ক্যাপ্টেন হওয়ায় ও ওয়ানডে সিরিজ খেলেনি। কেউ বলল, যথেষ্ট সিরিয়াস নয়। কেউ আরো কোনো কারণ খুঁজে পেল। আমরা চেয়েছিলাম এসব কথাবার্তা বন্ধ করে সত্যি কারণটা তুলে ধরতে।' শবনম বললেন, 'ওর হৃৎপিণ্ডের ওপরে গলফ বলের সাইজের একটা টিউমার হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারদের অভিমত হলো, ওষুধ, থেরাপি এবং যোগাসনে ওটা মিলিয়ে যাবে।' যুবরাজ কিভাবে কাটাচ্ছেন এখন? শবনম বললেন, 'ভেতরে ভেতরে হয়তো চোখের জল ফেলছে, কিন্তু বাইরে একই রকম কঠোর। কারো বোঝার উপায় নেই যে অস্বস্তিতে আছে। ১৫-২০ দিনের মধ্যে ট্রেনিং শুরু করতে চায়।' এরপর নিজেই যোগ করলেন, 'আমার ছেলেটা সত্যিই সাহসী।' বলতে বলতে সামান্য গলা ধরে গেল, যা শোনামাত্র মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই যুবরাজকে মুম্বাইয়ের বাড়িতে ফোনে ধরলে তিনি অবধারিত বলতেন, 'আমার মা কী সাংঘাতিক সাহসী, একা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন!'
শবনম আপাতত চণ্ডীগড়েই, কারণ তিনি পারিবারিক গুরুদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন পাঞ্জাবে। তাঁর অসুস্থতা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতের হয়ে তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন যুবরাজ। রান করেছেন ৬২, ৮, ২৩, ১৮, ২৫_যা নিয়ে তাঁর টেস্ট রান দাঁড়িয়েছে, ৩৭ টেস্টে ১৭৭৫। গড় নেহাতই মধ্যবিত্ত ৩৪.৮০। প্রতিবারই মিডিয়া লিখেছে, ছয় নম্বরে জায়গাটা পেয়েও তিনি রাখতে পারছেন না। কেউ জানতেও পারেনি ভেতরে ভেতরে কী মারাত্মক অসুখ নিয়ে তিনি মাঠের যুদ্ধ লড়েছেন। শবনম ফের দাবি করলেন, নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। বললেন, 'শেষ বায়োপসিতে তা-ই এসেছে।' এ ব্যাপারে ধোঁয়াশার নিষ্পত্তি না করে এটুকু বলা যেতে পারে, এই প্রতিটি টেস্ট ম্যাচেই টানা পাঁচ দিন মাঠে থাকা যুবরাজকে প্রচণ্ড ভুগিয়েছে। এই ব্যাধিতে করণীয় হলো, বিশ্রাম এবং ঠিক ওষুধ। একনাগাড়ে পাঁচ দিন শক্তিক্ষরণে বিশ্রাম করা যায়নি। প্রতিটি টেস্ট ম্যাচের পরে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যুবরাজ। ১৫ দিন আগে ইডেনে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট খেলতে এসেছিলেন যুবরাজ, হোটেলে নাকি তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক সহকারী, যাঁর দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন তাঁকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানোর। গত মে মাসের পর অনেক রাতে তিনি শুতে গেছেন শরীরে ব্যথা উপশমকারী সুচ ফুটিয়ে। শোনা গেল, যুবরাজের দুই কুলপুরোহিত এ সংকটে উৎসাহ জোগাচ্ছেন তাঁকে। যেমন পাশে আছেন পুনে ওয়ারিয়র্স দলের মালিক সুব্রত রায়। কুলপুরোহিতদের কথা থেকে অবশ্য অসম্ভব উদ্দীপনা পাচ্ছেন যুবরাজ। সব ব্যাপারে তিনি তাঁদের শরণাপন্ন হন। তাঁরাই বিশ্বকাপের আগে তাঁকে বলেছিলেন, 'এ টুর্নামেন্ট তোমাকে ফিরিয়ে দেবে বিশ্বমঞ্চে।' তাঁরা সন্ত বাবা অজিত সিংহ এবং রাম সিংহ। গুরুরা এবারও যুবরাজকে আশ্বাস দিয়েছেন, 'তুমি মোটেও বিশাল অসুস্থ নও। এর থেকে ঠিক বেরিয়ে আসবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।' শবনম চণ্ডীগড় থেকে পাঞ্জাবে দেখা করতে যাচ্ছেন গুরুর সঙ্গে। যদি তাঁরা আশাব্যঞ্জক নতুন কোনো পাথেয় দেন। ডাক্তার কী বলেছেন যুবিকে? শবনম বললেন, 'তিনটি জিনিস যেমন করে যাচ্ছ করে যাও_ওষুধ, থেরাপি এবং বিশ্রাম। তোমার মোটেও জীবনের ভয় নেই।' যিনি তাঁকে দেখছেন, এই ডাক্তার কী ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ, না ক্যান্সার সার্জন? তাঁর নাম কী, কোথায় থাকেন? যুবরাজের পরিবার কোনো তথ্য দিতে আগ্রহী নয়, তাই জানার উপায় নেই কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয়েছে কি না।
ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ভট্টাচার্য বললেন, 'যদি ক্যান্সার না হয়ে থাকে, যদি পরিবারের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে শুধু ওষুধে ভালো হয়ে যাবে। এমনকি যদি ম্যালিগন্যান্ট স্টেজ ওয়ান স্মল সেল ক্যান্সার হয়, তাহলেও ওষুধে সেরে যাবে। অস্ত্রোপচার করতে হবে না। তবে এসব ক্ষেত্রে সেটির আবার শরীরে ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে।' ক্যান্সার শল্যচিকিৎসক ড. গৌতম মুখোপাধ্যায় বললেন, 'স্টেজ ওয়ান হলে থেরাপি এবং ওষুধে পুরো সেরে যায়। কিন্তু যদি অস্ত্রোপচার করতে হয় এবং ফুসফুসের অংশ বাদ দিতে হয়, তাহলে ক্রীড়াবিদের সক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। সে ক্ষেত্রে আজকালের দিনে ক্রিকেট যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে স্ট্যামিনা সামান্য কমে যাওয়া বড় সমস্যা হতে পারে।' শহরের নামি দুই চিকিৎসকই মনে করেন, পরিস্থিতি উদ্বেগের হলেও আশা হারানোর কিছু নেই। যুবরাজ সম্মান নিয়েই জীবনে ফিরবেন। হয়তো বা ক্রিকেট মাঠেও। ঘনিষ্ঠ মহলের রিপোর্ট অনুযায়ী যুবরাজ সিংহ অবশ্য জীবনে ফেরা নিয়ে চিন্তিত নন। কত তাড়াতাড়ি ক্রিকেট মাঠে ফিরবেন সেটিই তাঁর লক্ষ্য। যেমন তিনি চান, সামনের মাসে দুলীপ ট্রফি খেলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে দলের জন্য দাবি তুলতে। অনেকের ধারণা, সেটি প্রায় অসম্ভব। এখনো যেভাবে চিকিৎসা চলছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি ম্যাচের ফিটনেস তাঁর পক্ষে পাওয়া কঠিন। বেশিক্ষণ মাঠে থাকলেই তাঁর শরীরে রোগের নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সৌরভ বলছিলেন, 'যুবরাজের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ও ঠিক ফিরে আসবে।' কিন্তু সৌরভও কি পরিস্থিতির খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত? না হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়া সফর তো দূরস্ত, আইপিএলটাও জমিয়ে যুবরাজ খেলতে পারবেন কি না সন্দেহ রয়েছে।
বিশ্বকাপের পর থেকেই আসলে যুবরাজের শরীরে নানা রকম সমস্যা ধরা পড়ে। বমি হচ্ছিল, জ্বর হচ্ছিল, সর্দি-কাশি যাচ্ছিল না। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন যেহেতু ওয়ার্ল্ড কাপে প্রচুর টেনশন গেছে, এটা তারই প্রকাশ। অথবা কোনো অ্যালার্জির সংক্রমণ। দুই দিনে ঠিক হয়ে যাবে। রোগকে তাই পাত্তাই দেননি, উল্টো চৌদ্দটি আইপিএল ম্যাচ খেলেন (৩৪৩ রান, গড় ৩৪.৩০, স্ট্রাইক রেট ১৩১)। তখন বলাবলি হচ্ছিল আইপিএলটি বিশ্বকাপের মতো খেলতে পারলেন না যুবরাজ। তাঁর নিজেরও তাই মনে হচ্ছিল, তিনি ফর্মে নেই। ২৭ মে স্ক্যানের রিপোর্ট বেরোনোর পর যুবরাজ প্রথমে বুঝতে পারেন কেন বিশ্বকাপের মধ্যেও তাঁর তিন-চারবার বমি হচ্ছিল। এরপর থেকেই চলছে তাঁর কঠিন সংগ্রাম। শুধু ক্রিকেট কেন, ভারতীয় খেলাধুলার জগতে যেকোনো বিপন্ন ক্রীড়াবিদের রোলমডেল হতে পারেন এখন যুবরাজ। ওই অবস্থায় তিনি অসম সাহসে ইংল্যান্ড সফরে যান। ফের টেস্ট সিরিজ খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। শতকরা ৯৯ জনকে বুঝতেই দেননি কী পরিমাণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তিনি ক্রিকেট খেলছেন। অথচ ইংল্যান্ড সফরে এমনও হয়েছে, তিনি প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যে টিমের যা ড্রিল সেসব কিছু করতে পারেননি। শবনম বললেন, 'ও বারবার বলেছে, মা কিছু চিন্তা করো না, আমি ফিরবই। এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু আমার ছেলে মাথা ঝোঁকায়নি।'
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, গ্রেগ চ্যাপেল বিরক্ত হয়ে বলতেন, যুবরাজের টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না করতে পারার ধাঁধাকে একটা শব্দে অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যায়_বলিউড। চ্যাপেল জানেন না, ২০১১-এর শেষের এই যুবরাজ বলিউড থেকে শতহস্ত দূরে। মা আর ভাই ছাড়া প্রতিনিয়ত সাহস জোগানোর সঙ্গীও নেই। ওষুধ, বিশ্রাম আর অসাধারণ মনের জোরকে সম্বল করে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। আবার যদি ক্রিকেট মাঠে সসম্মানে ফেরেন, ওয়াংখেড়ের জাদুকরী রাতের প্রত্যাবর্তন ঘটবে তাঁর জীবনে। এখানে না-ই বা পেলেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের ট্রফি। প্রত্যাবর্তনের পর না-ই বা হলো টেস্ট দলে পাকা জায়গা। একটা পুরো প্রজন্মের কাছে জলজ্যান্ত বিস্ময়-উদ্রেককারী রোলমডেল হিসেবে থেকে যাবেন। তখন ছয় বলে ছয়টা ছক্কা নয়, যুবরাজ সিংয়ের আসল রেকর্ড থেকে যাবে এটাই। মুখোমুখি মরণপণ যুদ্ধে ক্যান্সার-জয়ী।
স্পোর্টস কুইজে প্রশ্নটা একাধিকবার এসেছে। বিকল্প যে কটি নামই দেওয়া থাক, ঠিক উত্তর_মহিন্দর অমরনাথ।
ভারতীয় কুইজমাস্টাররা মনে হয় না জানেন যে ২০১১-এর শেষ অর্ধে এসে মহিন্দর জবাব দিলে উত্তরটা সম্পূর্ণ ভুল হবে। ঠিক উত্তর যুবরাজ সিং। বিশ্বকাপের 'ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট' তিনি। ৯ ম্যাচে দুর্ধর্ষ ৩৬২ রান, ১৫ উইকেট, মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সব 'পারফরম্যান্স'। এরপর দুনিয়া অত্যাশ্চর্যভাবে বদলে গিয়েছে মাঝের আট মাসে। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কামব্যাক ঘটিয়েছিলেন বিশ্বকাপে। সেখান থেকে অদৃষ্টের স্খলনে ফের তলদেশে যুবরাজ।
ওয়াংখেড়েতে যখন তিনি সেরার সেরার ট্রফি নিচ্ছেন, তখন কে জানত পরের আট মাসে ভারতের হয়ে একটাও ওয়ানডে ম্যাচ খেলা হবে না তাঁর? আর কবে হবে, তা-ও চলে যাবে আশঙ্কার গর্ভে? কে জানত এমন রোমাঞ্চকর কামব্যাকেও যুবরাজ সিংয়ের সুস্থির হওয়ার উপায় থাকবে না। পরের মাসেই তাঁকে কিনা নেমে পড়তে হবে জীবনের কঠিনতম যুদ্ধে। লড়তে হবে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে, যাকে ব্যাট-বলের দক্ষতা দিয়ে হারানোর উপায় নেই। এর নাম ক্যান্সার। যার মুখোমুখি দাঁড়ালে ওষুধ ছাড়া মাত্র দুটি অস্ত্র_ধৈর্য এবং অনমনীয় মনের জোর।
রবিবার যুবরাজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনন্দবাজারকে বলছিলেন, 'আপনারা লেখেন_ও মাঠের হিরো। গত কয়েক মাসে কাছ থেকে দেখার পর মনে হচ্ছে, ওকে জীবনের হিরোও বলার সময় হয়েছে।' ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসে কোনো শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদের এমন শারীরিক বিপন্নতার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইতিহাস নেই। মনসুর আলী খান পতৌদি একমাত্র তুলনা হতে পারেন। কিন্তু পতৌদি এক চোখ হারালেও এত সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে নিয়ত যুঝেননি। আন্তর্জাতিক মঞ্চ তল্লাশি করলে হাতে গুনে তিনটি উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। বার্সেলোনা ডিফেন্ডার এরিক আবিদাল, সাইমন ও'ডোনেল এবং ল্যান্স আর্মস্ট্রং। এ বছরই ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার পর দেড় মাসের মধ্যে অস্ত্রোপচার করিয়ে চমকপ্রদভাবে মাঠে ফেরেন আবিদাল। এমনকি, নেমে পড়েন বার্সেলোনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। সাইমন ও'ডোনেলের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল ১৯৮৭ সালে। ইডেনে তাঁরা বিশ্বকাপ জেতার পরপর। পরের বছরই অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে টিমে তাঁর নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটে। এর দুই বছর পরে ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি হৈচৈ ফেলে দেন ১৮ বলে ৫০ করে। তবে ও'ডোনেল কখনো দূর কল্পনাতেও যুবরাজ মাপের ক্রিকেটার নন। একমাত্র আর্মস্ট্রংয়ের কাহিনীটাই অলৌকিক। গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট ম্যাচের আগে রাহুল দ্রাবিড়কে বহুবার আর্মস্ট্রংয়ের বই পড়ে উদ্দীপ্ত হতে দেখা গেছে। সেখানে আর্মস্ট্রং ব্যাখ্যা করেছেন, ১৯৯৬-এ ক্যান্সার রোগী হয়েও কিভাবে পরবর্তী সময়ে টানা সাত বছর ট্যুর দ্য ফ্রান্স জিতেছিলেন।
দ্রাবিড়ের হয়তো সময় হয়েছে আর্মস্ট্রংয়ের বইটা যুবরাজকে উপহার দেওয়ার। ক্যান্সারকে হারানোর যুদ্ধে আর্মস্ট্রংই আজ পর্যন্ত লড়াকু ক্রীড়াবিদের সেরা বিজ্ঞাপন। অবশ্য দ্রাবিড় প্রকৃত সত্য জানেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ভারতীয় ড্রেসিংরুম সূত্রের খবর, একমাত্র শচীন টেন্ডুলকারকে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। যুবরাজ একাধিকবার বলেছেন, 'ক্রিকেটে তাঁর প্রত্যাবর্তনের কারণ শচীন। এবারও নাকি শচীন অনুপ্রাণিত করেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই দ্রুতই আবার মাঠে ফিরবি।' যুবরাজের এক বন্ধুর ভাষায়, আগেও শচীন ওর কাছে 'মিস্টার ইনস্পিরেশন' ছিল। এখনো।
যুবরাজ পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্য রবিবারও বলা হলো, তাঁর বাঁ ফুসফুসে যে টিউমার ধরা পড়েছে সেটা নন-ম্যালিগন্যান্ট। প্রাথমিক রিপোর্টে নাকি ওটা ক্যান্সার সেল-ই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তৃতীয় বায়োপসিতে নাকি দেখা যায়, টিউমারটি নন-ম্যালিগন্যান্ট। অতএব ভয়ের কারণ নেই। ঠিক পারিবারিক এই ব্যাখ্যাতেই কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। রয়েছে স্বভাবতই স্পর্শকাতর কিছু প্রসঙ্গ। রয়েছে সহজবোধ্য কিছু সীমাবদ্ধতা।
শনিবার হঠাৎ প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কেন যুবরাজের পরিবার থেকে তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হলো, যেখানে অসুখ ধরা পড়েছে গত ২৭ মে? চণ্ডীগড় থেকে এ দিন যুবরাজের মা শবনম সিং ফোনে বললেন, 'মুখ না খুললে বিভ্রান্তি বাড়ছিল। যুবরাজকে নিয়ে এমনিতেই তো সব সময় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা চলে। এর আগে বলা হয়েছিল, সুরেশ রায়না ক্যাপ্টেন হওয়ায় ও ওয়ানডে সিরিজ খেলেনি। কেউ বলল, যথেষ্ট সিরিয়াস নয়। কেউ আরো কোনো কারণ খুঁজে পেল। আমরা চেয়েছিলাম এসব কথাবার্তা বন্ধ করে সত্যি কারণটা তুলে ধরতে।' শবনম বললেন, 'ওর হৃৎপিণ্ডের ওপরে গলফ বলের সাইজের একটা টিউমার হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারদের অভিমত হলো, ওষুধ, থেরাপি এবং যোগাসনে ওটা মিলিয়ে যাবে।' যুবরাজ কিভাবে কাটাচ্ছেন এখন? শবনম বললেন, 'ভেতরে ভেতরে হয়তো চোখের জল ফেলছে, কিন্তু বাইরে একই রকম কঠোর। কারো বোঝার উপায় নেই যে অস্বস্তিতে আছে। ১৫-২০ দিনের মধ্যে ট্রেনিং শুরু করতে চায়।' এরপর নিজেই যোগ করলেন, 'আমার ছেলেটা সত্যিই সাহসী।' বলতে বলতে সামান্য গলা ধরে গেল, যা শোনামাত্র মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই যুবরাজকে মুম্বাইয়ের বাড়িতে ফোনে ধরলে তিনি অবধারিত বলতেন, 'আমার মা কী সাংঘাতিক সাহসী, একা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন!'
শবনম আপাতত চণ্ডীগড়েই, কারণ তিনি পারিবারিক গুরুদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন পাঞ্জাবে। তাঁর অসুস্থতা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতের হয়ে তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন যুবরাজ। রান করেছেন ৬২, ৮, ২৩, ১৮, ২৫_যা নিয়ে তাঁর টেস্ট রান দাঁড়িয়েছে, ৩৭ টেস্টে ১৭৭৫। গড় নেহাতই মধ্যবিত্ত ৩৪.৮০। প্রতিবারই মিডিয়া লিখেছে, ছয় নম্বরে জায়গাটা পেয়েও তিনি রাখতে পারছেন না। কেউ জানতেও পারেনি ভেতরে ভেতরে কী মারাত্মক অসুখ নিয়ে তিনি মাঠের যুদ্ধ লড়েছেন। শবনম ফের দাবি করলেন, নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। বললেন, 'শেষ বায়োপসিতে তা-ই এসেছে।' এ ব্যাপারে ধোঁয়াশার নিষ্পত্তি না করে এটুকু বলা যেতে পারে, এই প্রতিটি টেস্ট ম্যাচেই টানা পাঁচ দিন মাঠে থাকা যুবরাজকে প্রচণ্ড ভুগিয়েছে। এই ব্যাধিতে করণীয় হলো, বিশ্রাম এবং ঠিক ওষুধ। একনাগাড়ে পাঁচ দিন শক্তিক্ষরণে বিশ্রাম করা যায়নি। প্রতিটি টেস্ট ম্যাচের পরে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যুবরাজ। ১৫ দিন আগে ইডেনে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট খেলতে এসেছিলেন যুবরাজ, হোটেলে নাকি তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক সহকারী, যাঁর দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন তাঁকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানোর। গত মে মাসের পর অনেক রাতে তিনি শুতে গেছেন শরীরে ব্যথা উপশমকারী সুচ ফুটিয়ে। শোনা গেল, যুবরাজের দুই কুলপুরোহিত এ সংকটে উৎসাহ জোগাচ্ছেন তাঁকে। যেমন পাশে আছেন পুনে ওয়ারিয়র্স দলের মালিক সুব্রত রায়। কুলপুরোহিতদের কথা থেকে অবশ্য অসম্ভব উদ্দীপনা পাচ্ছেন যুবরাজ। সব ব্যাপারে তিনি তাঁদের শরণাপন্ন হন। তাঁরাই বিশ্বকাপের আগে তাঁকে বলেছিলেন, 'এ টুর্নামেন্ট তোমাকে ফিরিয়ে দেবে বিশ্বমঞ্চে।' তাঁরা সন্ত বাবা অজিত সিংহ এবং রাম সিংহ। গুরুরা এবারও যুবরাজকে আশ্বাস দিয়েছেন, 'তুমি মোটেও বিশাল অসুস্থ নও। এর থেকে ঠিক বেরিয়ে আসবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।' শবনম চণ্ডীগড় থেকে পাঞ্জাবে দেখা করতে যাচ্ছেন গুরুর সঙ্গে। যদি তাঁরা আশাব্যঞ্জক নতুন কোনো পাথেয় দেন। ডাক্তার কী বলেছেন যুবিকে? শবনম বললেন, 'তিনটি জিনিস যেমন করে যাচ্ছ করে যাও_ওষুধ, থেরাপি এবং বিশ্রাম। তোমার মোটেও জীবনের ভয় নেই।' যিনি তাঁকে দেখছেন, এই ডাক্তার কী ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ, না ক্যান্সার সার্জন? তাঁর নাম কী, কোথায় থাকেন? যুবরাজের পরিবার কোনো তথ্য দিতে আগ্রহী নয়, তাই জানার উপায় নেই কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয়েছে কি না।
ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ভট্টাচার্য বললেন, 'যদি ক্যান্সার না হয়ে থাকে, যদি পরিবারের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে শুধু ওষুধে ভালো হয়ে যাবে। এমনকি যদি ম্যালিগন্যান্ট স্টেজ ওয়ান স্মল সেল ক্যান্সার হয়, তাহলেও ওষুধে সেরে যাবে। অস্ত্রোপচার করতে হবে না। তবে এসব ক্ষেত্রে সেটির আবার শরীরে ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে।' ক্যান্সার শল্যচিকিৎসক ড. গৌতম মুখোপাধ্যায় বললেন, 'স্টেজ ওয়ান হলে থেরাপি এবং ওষুধে পুরো সেরে যায়। কিন্তু যদি অস্ত্রোপচার করতে হয় এবং ফুসফুসের অংশ বাদ দিতে হয়, তাহলে ক্রীড়াবিদের সক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। সে ক্ষেত্রে আজকালের দিনে ক্রিকেট যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে স্ট্যামিনা সামান্য কমে যাওয়া বড় সমস্যা হতে পারে।' শহরের নামি দুই চিকিৎসকই মনে করেন, পরিস্থিতি উদ্বেগের হলেও আশা হারানোর কিছু নেই। যুবরাজ সম্মান নিয়েই জীবনে ফিরবেন। হয়তো বা ক্রিকেট মাঠেও। ঘনিষ্ঠ মহলের রিপোর্ট অনুযায়ী যুবরাজ সিংহ অবশ্য জীবনে ফেরা নিয়ে চিন্তিত নন। কত তাড়াতাড়ি ক্রিকেট মাঠে ফিরবেন সেটিই তাঁর লক্ষ্য। যেমন তিনি চান, সামনের মাসে দুলীপ ট্রফি খেলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে দলের জন্য দাবি তুলতে। অনেকের ধারণা, সেটি প্রায় অসম্ভব। এখনো যেভাবে চিকিৎসা চলছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি ম্যাচের ফিটনেস তাঁর পক্ষে পাওয়া কঠিন। বেশিক্ষণ মাঠে থাকলেই তাঁর শরীরে রোগের নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সৌরভ বলছিলেন, 'যুবরাজের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ও ঠিক ফিরে আসবে।' কিন্তু সৌরভও কি পরিস্থিতির খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত? না হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়া সফর তো দূরস্ত, আইপিএলটাও জমিয়ে যুবরাজ খেলতে পারবেন কি না সন্দেহ রয়েছে।
বিশ্বকাপের পর থেকেই আসলে যুবরাজের শরীরে নানা রকম সমস্যা ধরা পড়ে। বমি হচ্ছিল, জ্বর হচ্ছিল, সর্দি-কাশি যাচ্ছিল না। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন যেহেতু ওয়ার্ল্ড কাপে প্রচুর টেনশন গেছে, এটা তারই প্রকাশ। অথবা কোনো অ্যালার্জির সংক্রমণ। দুই দিনে ঠিক হয়ে যাবে। রোগকে তাই পাত্তাই দেননি, উল্টো চৌদ্দটি আইপিএল ম্যাচ খেলেন (৩৪৩ রান, গড় ৩৪.৩০, স্ট্রাইক রেট ১৩১)। তখন বলাবলি হচ্ছিল আইপিএলটি বিশ্বকাপের মতো খেলতে পারলেন না যুবরাজ। তাঁর নিজেরও তাই মনে হচ্ছিল, তিনি ফর্মে নেই। ২৭ মে স্ক্যানের রিপোর্ট বেরোনোর পর যুবরাজ প্রথমে বুঝতে পারেন কেন বিশ্বকাপের মধ্যেও তাঁর তিন-চারবার বমি হচ্ছিল। এরপর থেকেই চলছে তাঁর কঠিন সংগ্রাম। শুধু ক্রিকেট কেন, ভারতীয় খেলাধুলার জগতে যেকোনো বিপন্ন ক্রীড়াবিদের রোলমডেল হতে পারেন এখন যুবরাজ। ওই অবস্থায় তিনি অসম সাহসে ইংল্যান্ড সফরে যান। ফের টেস্ট সিরিজ খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। শতকরা ৯৯ জনকে বুঝতেই দেননি কী পরিমাণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তিনি ক্রিকেট খেলছেন। অথচ ইংল্যান্ড সফরে এমনও হয়েছে, তিনি প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যে টিমের যা ড্রিল সেসব কিছু করতে পারেননি। শবনম বললেন, 'ও বারবার বলেছে, মা কিছু চিন্তা করো না, আমি ফিরবই। এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু আমার ছেলে মাথা ঝোঁকায়নি।'
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, গ্রেগ চ্যাপেল বিরক্ত হয়ে বলতেন, যুবরাজের টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না করতে পারার ধাঁধাকে একটা শব্দে অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যায়_বলিউড। চ্যাপেল জানেন না, ২০১১-এর শেষের এই যুবরাজ বলিউড থেকে শতহস্ত দূরে। মা আর ভাই ছাড়া প্রতিনিয়ত সাহস জোগানোর সঙ্গীও নেই। ওষুধ, বিশ্রাম আর অসাধারণ মনের জোরকে সম্বল করে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। আবার যদি ক্রিকেট মাঠে সসম্মানে ফেরেন, ওয়াংখেড়ের জাদুকরী রাতের প্রত্যাবর্তন ঘটবে তাঁর জীবনে। এখানে না-ই বা পেলেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের ট্রফি। প্রত্যাবর্তনের পর না-ই বা হলো টেস্ট দলে পাকা জায়গা। একটা পুরো প্রজন্মের কাছে জলজ্যান্ত বিস্ময়-উদ্রেককারী রোলমডেল হিসেবে থেকে যাবেন। তখন ছয় বলে ছয়টা ছক্কা নয়, যুবরাজ সিংয়ের আসল রেকর্ড থেকে যাবে এটাই। মুখোমুখি মরণপণ যুদ্ধে ক্যান্সার-জয়ী।
No comments