ব্লগ থেকে-ঢাকা শহরের মালিকানা কার? by রেদওয়ান বাশার

হর হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে একটি ছোট ছেলে পথ চলতে চলতে হয়তো এমন কিছু খুঁজে পাবে, যা তাকে বলে দেবে বাকিটা জীবন সে কী করতে চায়Ñলুই কান।‘লুই কানের মূল নকশার বড় ক্ষতি আগেই করা হয়েছে। এখানে ক্রিসেন্ট লেকের ওপর সেতু তৈরি ও মাজার করা হয়েছে। মূল নকশায় ক্রিসেন্ট লেকটিকে একটি অর্ধচন্দ্রের মতো দেখা যায়। চন্দ্রের মাঝখানে সংসদ ভবন ও একটি তারা। সেখানে ব্রিজ ও মাজার করে এখন ধনুকাকৃতির করা


হয়েছে। চাঁদ শান্তির প্রতীক আর ধনুক যুদ্ধের প্রতীক।’ সবাই জানেন বোধ হয়, এই মন্তব্যটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দাঁড়িয়ে দেওয়া বক্তব্য। এর জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম তার পর দিনই দাবি করেনÑ‘জিয়ার মাজার আর সেতু নির্মাণ দ্বারা সংসদ ভবনের সৌন্দর্য আরো বর্ধিত হয়েছে।’
আমার ইচ্ছা ছিল, রাজনীতিবিদদের বলি, তাঁরা যেন চাঁদ-তারা বা তীর-ধনুক দিয়ে ‘সৌন্দর্য’ বোঝার হাস্যকর চেষ্টা না করেন। তাঁরা যেন উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন, লুই কানের নকশার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যহানি হয়েছে সেদিন, যেদিন নিরাপত্তার অজুহাতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (লুই কানের পাবলিক প্লাজা, বাংলায় বলা যায় ‘নাগরিক চত্বর’। কানের ছেলেকে ঢাকাবাসী জানিয়েছিল, ওখানে নাকি সবারই একটা না একটা কিছু স্মৃতি আছে।) যত দিন আমাদের নেতারা এটা না বুঝবেন, ঢাকা বসবাসের অযোগ্যই থেকে যাবে। নগর পরিকল্পনার কারিগরি বা আর্থিক দিকটা কিন্তু খুব জটিল বা দুঃসাধ্য নয়, ইস্যুটা সব সময় রাজনৈতিক, সামাজিক। এই যে ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য আর প্যারিসকে তিলোত্তমা নগরী বলে, আরো হাজারটা পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার যে একটা সড়ক আর একটা ব্যুলোভার্ডের আসল পার্থক্যটা কিন্তু দর্শনেই। সুশাসন ছাড়া বাসযোগ্য নগর হয় না। মেট্রোরেল, উড়াল-সড়ক কোনো কিছুতেই খুব বেশি কিছু আসবে যাবে না।
কিন্তু এই লেখাটা রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে নয়।

২.
অনেকে হয়তো সংসদ ভবনের ‘মূল পরিকল্পনা’ রক্ষার কথাবার্তাকে স্থপতিদের ‘সৌন্দর্য’ নিয়ে আদিখ্যেতা ভেবে থাকতে পারেন। এই ইস্যুতে ‘বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট’ আর ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’-এর আহ্বানে কিছুদিন আগে একটা মানববন্ধন হয়। পরদিন প্রথম আলোর খবরে (এবং শিরোনামে) এটাকে স্থপতিদের একটা কর্মসূচি হিসেবেই দেখানো হয়। প্রথম আলোতে এর আগেও একদিন লেখা হয় ‘বিরোধিতা করছেন স্থপতি, পরিকল্পনাবিদরা।’ (আর কেউ নাই! কোনো রাজনৈতিক দল?) আমি একজন স্থপতি। লুই কান আমার কাছে দেবতুল্য মানুষ। তাঁর প্রতি, তাঁর কাজের প্রতি আমার মনে কী অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ জমা আছে, তা কাউকে বলতেও যাব না। সংসদ ভবনের নান্দনিকতা বা ‘সৌন্দর্য’ নিয়েও না হয় অন্য কোনো দিন, অন্য কোথাও, হয়তো অন্য কোনো লেখক আলাপ করবেন। মেট্রোরেলের রুট বিজয় সরণি দিয়ে যাওয়া উচিত নাকি খামারবাড়ি দিয়ে, সেই যুক্তিতর্কও আরো অনেক আগে থেকেই, অন্য অনেক জায়গায়, অন্য অনেক বিজ্ঞজন করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে এক পক্ষের সমর্থনে এই বিতর্কের ‘উপসংহার’ টেনে দেওয়ার পর পুরো ব্যাপারটায় একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়। সে প্রসঙ্গেই এখানে কিছু বলতে চাওয়া।
যখন বিমান বাহিনীর আপত্তিতে এমআরটি-৬-এর পথ ঘুরে যাওয়ার কথা জানা গেল, আপত্তিটা ছিল প্ল্যানিং নিয়ে, সমন্বয় নিয়ে। লড়াইটা ছিল সুচিন্তিত বিশেষজ্ঞ মতামত বা শুভবুদ্ধির সঙ্গে গোষ্ঠী-স্বার্থের। এ রকম মাঝেমধ্যে শোনা যায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যেই ‘সমন্বয়’ নেই। এমনকি একই দপ্তরের নানা কাজের মধ্যেও নেই। এখানে একটা, ওখানে দুইটা করে উড়াল সড়ক হয় (এবং কিছুদিন পর জানা যায়, সেই উড়াল সড়কে ভারী যানবাহন ওঠা যাবে না!)। ‘সমন্বয়হীন পরিকল্পনা’ কথাটা অদ্ভুত শোনায়; কিন্তু এটাই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে যাচ্ছে। সমন্ব^য় না থাকলে সেটা কেমন পরিকল্পনা! ঢাকায় সব কিছুই হয় অ্যাডহক ভত্তিতে। উপসর্গের চিকিৎসা হয় বড়জোর... রিকশা উঠে যায়, ওয়ান-ওয়ে সড়ক হয়, উড়াল সড়কে বাস ওঠা নিষিদ্ধ হয়... রোগের আর চিকিৎসা হয় না। এ ধরনের জোড়াতালি দিয়ে আজ এই বিমান বাহিনীর আবদারে ডান দিকে, তো কাল বিজেএমইএর আবদারে বাম দিকে, এভাবে করে আর কত দিন চলতে পারবে ঢাকা?
সম্প্রতি উড়াল সড়ক নিয়ে যে লেখালেখি, আলোচনা হচ্ছে, সেখানেও মূল আপত্তিটা বোধ হয় এখানেই। শহর একটা জটিল যৌগ, এর সমস্যাগুলা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শহরের পরিবহনব্যবস্থার সঙ্গে যেখানে এর ভূমিব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, অবকাঠামো, সামাজিক গঠন, নাগরিক সংস্কৃতি সব কিছু জড়িত, সেখানে আমাদের এই ঢাকায় পরিবহনব্যবস্থার একটা পদক্ষেপের সঙ্গে আরেকটা পদক্ষেপেরই কোনো সমন্বয় থাকে না। এসটিপি বা স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের ভালো-মন্দ নিয়ে প্রশ্ন ওঠানোই যায়, কিন্তু এই এসটিপি অবশ্যই একটা সমন্বিত পরিকল্পনা। স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদরা তাই দাবি তোলেন, বিমান বাহিনীর আপত্তিতে যেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা না হয়, সুচিন্তিত রুটটা যেন বদলে ফেলা না হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই ধরনের বক্তব্যের পর ক্ষোভটা আর শুধু প্ল্যানিং নিয়ে থাকে না (এবং অবশ্যই সৌন্দর্য নিয়ে নয়)। যে বিতর্কটা, যে লড়াইটা আগে বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিলে চলত, সেখানে ঢাকাবাসী সবার অংশ নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর প্রধানকে আমরা সরাসরি ভোট দিয়ে ওই পদে বসাইনি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের হিসাব-নিকাশটা অন্য রকম। আমাদের নেতারা গোষ্ঠী-স্বার্থের কবল থেকে শহরকে বাঁচাতে পারেন না, তাঁদের সে ক্ষমতা নেই (অথবা ঘটনা আরো ভয়াবহ, তাঁদের সে চেষ্টাও নেই!), এটা মেনে নিতে আমরা রাজি নই।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘বুয়েট, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মেট্রোরেল রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ তখন এ কথার সত্যতা নিয়ে আমার মতো অনেক স্থপতি ও পরিবেশকর্মীই সন্দিহান হয়ে পড়েন! এবং তিনি এ ব্যাপারে আলোচনার, সঠিক তথ্য প্রকাশের (বলা যায় গণতান্ত্রিক চর্চার) সব পথ রুদ্ধ করে দেন। তিনি যখন প্রশ্ন তোলেন ‘বিমানবন্দর বড়, নাকি কয়েকটা খেজুরগাছ বড়?’ তিনি জটিল প্রশ্নটাকে অতি সরল করে উত্থাপন করেন। তিনি যখন জিয়ার মাজার দ্বারা সংসদ ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার কথা বলেন, তখন তিনি রাজনৈতিক কূটকৌশলে মূল প্রসঙ্গ থেকে আমাদের নজর সরিয়ে দিতে চান। সংবাদপত্রে এবং টিভি চ্যানেলে তাই ওই বক্তব্যটাই শিরোনাম হয়।
লেখার শুরুর দিকেই বাসযোগ্য নগরের শর্ত হিসেবে যে ‘সুশাসনের’ কথা উল্লেখ করা, সেই সুশাসনের প্রধান শর্ত কিন্তু আবার জনসম্পৃক্ততা। একটা সুন্দর নগর গড়ে তুলতে যে ধরনের সুসমন্বিত সামগ্রিক দর্শন প্রয়োজন, জনগণের সম্পৃক্ততাই পারে তা নিশ্চিত করতে, পারে সরকারের নীতিমালাকে সেদিকে প্রভাবিত করতে।
এই ঢাকার সমস্যা শুধু যে ব্যাপক তা-ই নয়, অনেক গভীরও। ঢাকার দখল কেউ ছাড়ে না। গার্মেন্ট, কলকারখানা, সেনানিবাস, বিশ্ববিদ্যালয়Ñএসব মূল শহরের বাইরেই থাকা উচিত। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও শহরের বাইরে নেওয়া দরকার। এই বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে কেমন করে? ঢাকার দখল কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফও ছাড়ে না! এমনকি যে মধ্যবিত্ত আমজনতা, তাদেরও স্বপ্ন কিন্তু ওই দখল, ঢাকার এক টুকরো জমির দখল। সবাই সবার গাছটা আগলে ধরে আছে, পুরোটা মিলে যে জঙ্গল হয়ে আছে, সেটা কে দেখবে? এই বাগানের একজন শক্ত মালি লাগবেই, যে কঠিন হাতে সব দখল ছোটাবে। জানি, শেখ হাসিনা সেই মালি হতে পারবেন না। কারণ তাঁর ও ধরনের বক্তব্যে জঙ্গল সাফ করার দাবিটাই যে একটা বড় ধাক্কা খায়!
এই দাবি তবু আমাদের বারবার তুলতে হবে। এই দাবির সমর্থনে আমাদের জনমত গড়ে তুলতেই হবে।

৩.
এবার একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। কিছুদিন আগে এক প্রবাসী বন্ধুর ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম, সে নাকি বুক ভরে এই ঢাকার দূষিত বাতাসে আবার নিঃশ্বাস নিতে চায়। এটা কি শহরের জন্য ভালোবাসা? এই শহরে যারা বেড়ে উঠছি, এই শহরে যারা বাস করি, সবাই কি নিশ্চিতভাবে দাবি করতে পারি, এই শহরকে আমরা ভালোবাসি?
আমি নিজেই সম্ভবত এই শহরের একজন ‘সুনাগরিক’ নই। যে গণপরিবহন ব্যবস্থার পক্ষে আমি মত দিই, সেই গণপরিবহনে আমি সচরাচর চড়ি না। আমি সেই ১৫ শতাংশ পাপীর দলে, যারা রাস্তার ৭০ শতাংশ দখল করে যাতায়াত করি। যে আমি সুষম ভূমিব্যবস্থাপনার দাবি তুলি সব সময়, সেই আমি শহরের এমন এক এলাকায় থাকি, যেখানে প্রতি একরে বড়জোর ১০০ জন বাস করে। যে আবর্জনাটা নিজের ঘরে ফেলতে বাধে, সেটা শহরের রাস্তায় ফেলতে আসলে ততটা বাধে না। আবার একটা উল্টো গল্প এখানেই শুনিয়ে রাখি। আমার এক পরিচিত ভাই বছর দুয়েক বার্সেলোনায় থেকে বেশ নাগরিক আদব-কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। ঢাকায় ফিরে তিনি একবার চিন্তা করলেন, হাতের পটেটো চিপসের প্যাকেটটা জায়গামতো ফেলবেন, যেখানে-সেখানে নয়। হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের বাসায় পৌঁছে গেলেন, কিন্তু ফেলার জায়গা পাওয়া গেল না। একটা কথা শিক্ষিত মহলে মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, আমাদের নাকি ‘সিভিক সেন্স’ নেই। যে যানজট নিরসনের চেষ্টা থেকে সব আলাপের শুরু, সেই যানজটের জন্য এই নাগরিক আদব-কায়দার অভাবও কিন্তু দায়ী। একটা ছোট উদাহরণ দিইÑওয়ানওয়ে বেইলি রোডে অবশ্যম্ভাবী জটটা আমাদের নাগরিক শিষ্টাচারের অভাব থেকেই তৈরি হয় সব সময়। পিজাহাট, বুমার্সের সামনে যেমন-তেমন পার্কিং, যাত্রী ওঠানামা থেকেই একটা জট তৈরি হয়।
আমি টের পাই, আমার মা-বাবা সম্ভবত এই শহরকে ভালোবাসেন না, বরং ভয় পান। ছেলে ঘরের বাইরে গেলে তাঁরা ভয়ে থাকেন। একসময় এই ভয়কে অযথা বলে বোঝাতাম ওনাদের। কিন্তু এই শহরে সড়ক দুর্ঘটনা আর ছিনতাই দুটোরই কবলে পড়ার পর থেকে তা আর বলতে পারি না। সঙ্গে গাড়ি থাকলে মা-বাবা কিছুটা স্বস্তিতে থাকেন। গাড়ি তাঁদের কাছে একটা নিরাপত্তা ব্যূহের মতো, একটা ‘বাবল’। এই একই ‘বাবল’ আমাদের বারান্দার গ্রিলে, সীমানা প্রাচীরে। ছিনতাই হওয়ার পরপর আমার মধ্যে প্রচণ্ড একটা ক্রোধ বেড়ে উঠছিল। ওদের চাপাতির কোপ আর রডের আঘাত গায়ে নিয়ে আমি যখন বিছানায়, তখন আমাকে দেখতে এসে আমার বস স্থপতি এহসান খান আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা কথা বলে বসেন, ‘দেখতে হবে তোমার ছিনতাইকারী কারা, বখে যাওয়া মাদকসেবীরা, নাকি এই শহরের প্রান্তিক বস্তিবাসীদের কেউÑশহর যাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। একভাবে চিন্তা করলে তোমার সম্পদে তো ওদের হক আছে।’ ছিনতাইকারীদের কমবয়সী মলিন চেহারাগুলো আমার মনে ছিল, আমি ওদের ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলাম। আর মেনে নিয়েছিলাম ছিনতাইমুক্ত শহর গড়ার দায়িত্ব শুধু র‌্যাব-পুলিশের নয়, আমাদের সবার।
শিরোনামহীনের ‘শহরের কথা’ গানটার শেষ পঙ্ক্তিটা খুব লক্ষণীয়, ‘শহর মানেই গ্রামের গল্প!’ শহর মানেই যেন গ্রামের জন্য হাহাকার। গ্রামীণ পরিবেশ শহরে চাইতে যাওয়াটা বোকামি। তা হলে হাহাকারটা কেন? বোধ করি হাহাকারটা একটা স্বাস্থ্যকর (শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য), পরিবেশবান্ধব, সমাজবান্ধব ‘নাগরিক জীবন’-এর জন্য। শহর শুধু কর্মসংস্থান আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নয়, ‘বাসযোগ্য’ নয় শুধু, শহরকে হতে হয় তার নাগরিকদের সুস্থ, সুন্দর নাগরিক জীবনযাপনের উপযোগী। আর সে ধরনের শহর গড়ে তুলতে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লাগবেই।
নগর আর নাগরিকের সম্পর্কটা নিশ্চিতভাবেই পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবর্জনা জায়গামতো ফেলার মানসিকতা, আর আবর্জনা ফেলার জায়গাÑকোনটা আগে আসতে হবে বলেন তো? আসলে দুটো একই সঙ্গে আসতে হবে। এই বোধটা আমাদের মধ্যে আসাটা জরুরি। শহর নিয়ে আমাদের দাবিগুলা তা না হলে সত্যিকারের নৈতিক জোর পাবে না।

৪.
আমি একবার লিখেছিলাম, বিজিবি হেডকোয়ার্টার, ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাস শহরের বাইরে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। বিডিআর হেডকোয়ার্টারে শৈশব কাটানো আমার এক বন্ধু তাতে ভীষণ আহত হয়। তার অভিযোগ ছিল, কোন স্পর্ধায় আমি শহরকে ‘আমার শহর’ বলি? এই শহর কি সেনাবাহিনীরও শহর নয়? আমি জানি, আমি কতখানি ভালোবাসায় এই ঢাকা শহরকে ‘আমার শহর’ বলি। ভালোবাসলে এই স্পর্ধাটা দেখানো যায়। আমি চাইব আমরা ঢাকাবাসীরা সবাই এতখানি স্পর্ধা নিয়ে ঢাকাকে ‘আমার শহর’ বলি। একটা সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেউ যদি আমার প্রাণপ্রিয় বুয়েটকে ঢাকার বাইরে চলে যেতে বলে, আমার তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে না।
শহরকে ঘিরে আমাদের দাবিগুলো নিয়ে আমাদের আরো উচ্চকণ্ঠ হতে হবে। শুধু ‘বাসযোগ্য’, শুধু কর্মদ্যোগী ঢাকা নয়, এই দরকষাকষিতে দরটা হাঁকতে হবে আরো উঁচু থেকে। একটা সামগ্রিক দর্শন, সামগ্রিক পরিকল্পনার দাবি জানাতেই হবে। শহরের রাস্তায় আমাদের ‘গণতন্ত্র’ চাইতে হবে। তাই আপনি মেট্রোরেলের যে রুটের পক্ষেই থাকুন না কেন, গবেষণা-আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করবেন আশা করি। আমাদের স্থপতিদের পরবর্তী কর্মসূচিতে সবাইকে পাশে চাই আমরা। এ লড়াই কেন স্থপতিদের একার লড়াই হবে? কেন ঢাকাবাসী সবার লড়াই হবে না?
যাঁরা মনে করেন ঢাকাকে একটা সুন্দর নগরীতে পরিণত করা সম্ভব নয়, তাঁরা ভুল মনে করেন। ঢাকাকে ততটাই সুন্দর করা সম্ভব, যতটা আপনারা দাবি করতে পারবেন।
লেখক : স্থপতি ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী
লেখাটি ব্লগসাইট সচলায়তন.কম-এ প্রকাশিত

No comments

Powered by Blogger.