ইতিহাস ঐতিহ্যের ঢাকা ভাঙছে by অমিতোষ পাল
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) দুই ভাগ করার মাধ্যমে ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর ঢাকাও কার্যত দুই ভাগ হতে চলেছে। ইতিমধ্যে ডিসিসি বিভক্তি বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার পাস হলে আইনে পরিণত হবে। এতে ঢাকার দক্ষিণ দিকের ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে হচ্ছে 'ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ'। আর উত্তর দিকের ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে হচ্ছে 'ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর'।
মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ঘোষণা দিয়েছেন, ঢাকাকে দুই ভাগের বিল সংসদে পাস হলেই তিনি মেয়রের পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। সেটা হলে গতকাল সোমবার ছিল মেয়র খোকার শেষ অফিস দিবস। গতকাল দুপুরে তিনি ডিসিসির কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়েছেন। সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি যেটা শুনেছি, নতুন আইন পাস হলে বিদ্যমান আইনের বিলুপ্তি হবে। সেক্ষেত্রে হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের প্রয়োজন পড়বে না আমার। প্রয়োজন হলে করব।'
ডিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে ঢাকা ভাগ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বলছেন, সেবার দোহাই দিয়ে ঢাকাকে ভাগ করা হলেও কার্যত সেবা বাড়বে না। বরং ব্যাপক মাত্রায় প্রশাসনিক ব্যয় বাড়বে। আমলাতন্ত্র আরো গেঁড়ে বসবে। ভাগ না করে বরং কিভাবে সেবা বাড়ানো যায়, সেদিকেই নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। দরকার হলে দুটি বা চারটি ডেপুটি মেয়রের পদও সৃষ্টি করা যেত। কিন্তু সরকার সেটা না করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্যই এমন কাজ করছে। ঢাকাকে ভাগ করার কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও আওয়ামী লীগের ছিল না।
জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ডিসিসির প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফও কোনো দিন ঢাকা ভাগের দাবি তোলেননি। বরং তিনি মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট প্রথার দাবি জানিয়েছিলেন। বর্তমান মেয়রসহ আরো অনেকেই অনুরূপ দাবি করে ডিসিসিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে চিন্তার ধারধারেনি সরকার।
ডিসিসি ভাগ করার বিরুদ্ধে নগর ভবনে ও বাইরে আন্দোলনও জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ঘোষণা দিয়েছেন, ডিসিসি ভাগ করা হলে তারা নগরীর বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেবেন। বিভক্তির বিরুদ্ধে ডিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে সমন্বয় পরিষদ। আজ তাঁরা বৈঠক করে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা দেবেন।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে, জনসংখ্যা বা আয়তনের বিচারে বিশ্বের বড় শহরগুলো চীনের সাংহাই বা গোয়াংজু, ভারতের মুম্বাই বা দিলি্ল, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক_কোনো শহরই পৃথক সিটি করপোরেশন বা মিউনিসিপ্যালিটি নেই। লন্ডনকে একবার চারটি ভাগে ভাগ করে কার্যক্রম শুরু হলেও সেটা কাজে আসেনি। পরে আবার একটি করপোরেশনের অধীনেই কার্যক্রম চলছে। ওইসব শহরের জনসংখ্যা ও আয়তন ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকার বর্তমান আয়তন যেখানে ৩৬০ বর্গকিলোমিটার ও জনসংখ্যা সোয়া কোটি, সেখানে সাংহাইয়ের আয়তন সাত হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি। জনসংখ্যা দুই কোটি ৩০ লাখ। অথচ সেই ঢাকাকেই ভেঙে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে বাংলাদেশ ও ক্ষমতাসীন সরকার আওয়ামী লীগ।
কিন্তু এই বিভক্তিতে কতটা নাগরিক সুবিধা বাড়বে কালের কণ্ঠ সেই প্রশ্ন রেখেছিল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলীর কাছে। তিনি বলেন, 'সংস্থা ছোট হয়ে গেলে রিসোর্স ক্যাপাসিটি কমে যায়। দুটি সিটি করপোরেশন করার লাভ ক্ষতি কী হবে সেটা পরে বোঝা যাবে। তবে এটা করার আগে অনেক গবেষণা করার প্রয়োজন ছিল, সেটা করা হয়নি। আপাতত মনে হচ্ছে, বিভাজন হলে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেবে। এতে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এত দিন ঢাকার মেয়র মন্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। দুটি সিটি করপোরেশন করে দুই মেয়রকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হবে। পদমর্যাদা কমে গেলে বর্তমান মেয়র পদাবনতির চিন্তা করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। এতে ক্ষমতাসীন দলের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। অবশ্য মেয়র খোকা গত শনিবার সরকারের প্রতি আকুতি জানিয়ে বলেন, 'ঢাকাকে ভাঙবেন না, আমি আগামীতে নির্বাচন করব না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, 'আমাদের দেশে কোনো সিদ্ধান্তই রাজনীতিমুক্ত না। ঢাকাকে দুই ভাগ করার পেছনেও কোনো রাজনীতি থাকতে পারে। এটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।'
ডিসিসি ভাগের ব্যাপারে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও একটি অশ্বস্তি চলছে। কে কোন দিকে পড়বে, সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। নগর ভবনেই দুটি কার্যালয় হবে কি না সে ব্যাপারেও কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বনানীতে ডিসিসির কমিউনিটি সেন্টারকেই উত্তরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। সংস্থার সম্পত্তি কিভাবে ভাগ হবে সেটা নিয়েও সমস্যা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে চলছে সম্পত্তির পরিমাণ নির্ণয়ের হিসাব-নিকাশ। এ ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে রাজস্ব আদায় নিয়ে। কারণ উত্তরের অংশ থেকেই ৭০ শতাংশ রাজস্ব আয় হয় ডিসিসির। অথচ বেশি ব্যয় হয় নগরীর দক্ষিণাংশের উন্নয়ন খাতে। এতে ভবিষ্যতে দক্ষিণাংশের বাসিন্দাদের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা আছে।
দীর্ঘ ২০ বছর সময় ব্যয় করে বর্তমান সিটি করপোরেশন আজকের বিকশিত অবস্থায় এসেছে। বিভাজন ঘটলে নবগঠিত দুটি করপোরেশনকে পরিপক্ব হতে অনেক সময় পার করতে হবে। নগরীতে ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাসের মতো সেবা সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হলে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ডিসিসির অনুমতি নিতে হয়। কোনো ড্রেন বা টেলিফোন-বিদ্যুতের তারের লাইন দুটি করপোরেশনের এলাকায় পড়লে দুই করপোরেশনেরই অনুমতি লাগবে। এতে উন্নয়নকাজে ধীরগতি তৈরি হবে। তার ওপর দুটি করপোরেশনে পৃথক রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তি মেয়র নির্বাচিত হলে উন্নয়নকাজে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সব মিলিয়ে ডিসিসি বিভাজন যে নগরবাসীর জন্য সাপেবর হয়ে দেখা দেবে_এমনটা আশা করা যায় না। ঢাকাবাসীও কখনো ডিসিসি ভাগের দাবি কোনো দিন তোলেননি। এমনকি যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে নগরীতে বসবাস করেন, তাঁরাও এটি আশা করেন না।
বর্তমানে ডিসিসির ৯০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে থাকা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৮ জন কাউন্সিলরও এ বিভাজন মেনে নিতে পারছেন না। এ ছাড়া সংরক্ষিত ৩০ জন মহিলা কাউন্সিলের মধ্যেও কেউ বিভাজনের পক্ষে নন। তাঁরাও বর্তমান করপোরেশনকে অবিভক্ত রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কাউন্সিলরদের আহ্বায়ক কাজী আবুল বাশার বলেন, 'সরকারের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। ঢাকাকে যাতে দুই ভাগ না করা হয় সে জন্য সরকারকে বোঝাতে হবে।'
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়া বিভক্তি ভালো হবে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে, আলাপ-আলোচনা করে সরকার ধীরগতিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত। অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ সম্প্রতি জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা ও আয়তন অনেক বেড়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগণের চাহিদা মেটানোর স্বার্থে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১৬০৮ সালে ঢাকার গোড়াপত্তন হয়। তখন ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভায় উন্নীত হয়। ১৯৭৮ সালে পৌরসভা থেকে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন হয় ঢাকা। ১৯৯০ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নাম হয় ঢাকা সিটি করপোরেশন।
একনজরে ঢাকা সিটি করপোরেশন
No comments