সাম্প্রতিক : চলছে দোষারোপের রাজনীতি-বেহাল দেশ! by শাকিল ফারুক
পাল্টাপাল্টি দোষারোপে গরম রাজনীতির মাঠ। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের যাবতীয় দুরবস্থার জন্য দায়ী করছেন বিরোধী দল বিএনপিকে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে চলছে বিএনপির রোডমার্চ ও জনসভা কার্যক্রম। সেখানে আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দোষ চাপাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ওপর। বর্তমান ও সাবেক দুই সরকারপ্রধানের এই দোষারোপ হাস্যরসের জোগান দিচ্ছে বটে, তবে কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনছে না।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক এখন ছেলেখেলার শামিল। টিপাইমুখে বাঁধ হচ্ছে। এই বাঁধের ফলে কী কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে আমাদের দেশে_কয়েক বছর ধরে তার বৃত্তান্ত লিখতে লিখতে হাজার হাজার দিস্তা কাগজ ফুরিয়ে গেল। কিন্তু হায়! এসবের কোনোটাই চোখে পড়েনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। গত সপ্তাহে দীপু মনি জানিয়েছেন, এই বাঁধ আসলেই কোনো ক্ষতি করবে কি না সে তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কি ধারণা, প্রচারমাধ্যমে যা প্রচার করা হয় বা যে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন তাঁরা অযথাই এসব করেছেন?
এই বাঁধ পুরো দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। কিন্তু এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। তারা যে মূলত ক্ষমতার লোভেই রাজনীতি করে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আবারও। খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে চিঠি লিখেছেন যতটা না দেশের স্বার্থে, অবশ্যই তার চেয়ে বেশি নিজের বা নিজের দলের স্বার্থে। টিপাইমুখ প্রসঙ্গে দল-মত ভুলে দেশপ্রেমী সব রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। সরকারেরও উচিত দেশের স্বার্থে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা।
বিদ্যুৎ নিয়ে ছিনিমিনি
মুখে স্বীকার না করলেও সরকার যে প্রতিনিয়তই বিশ্বব্যাংকের টোপ গিলে চলেছে সে কথা এরই মধ্যে সবার বোঝা হয়ে গেছে। আর এই টোপ গিলতে গিয়ে প্রচলিত আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না তারা। জ্বালানির দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে 'বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন-২০০৩'-এর ৩৪ ধারার ৫ উপধারায় ট্যারিফ-সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ট্যারিফ কোনো অর্থবছরে (জুন থেকে পরবর্তী বছরের জুলাই) একবারের বেশি পরিবর্তন করা যাবে না, যদি না জ্বালানি মূল্যের পরিবর্তনসহ অন্য কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটে। এ আইন লঙ্ঘন করে ২০১১-১২ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত দুই দফায় তেলের এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তিন দফা। গত ২০১০-১১ অর্থবছরেও তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে দুইবার।
কিছুদিন আগেই একবার বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা মোতাবেকই এই মূল্যবৃদ্ধির আয়োজন। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থা ঢাকতেই সরকার এই ভর্তুকি থেকে বাঁচার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। গত আগস্ট মাসেই ১৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের। এবার ২৪ নভেম্বর আরো এক দফা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুই ধাপে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়বে ৩১ শতাংশ। ডিসেম্বরের শুরুতে খুচরা পর্যায়েও বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম।
কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের কী লাভ? অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি উদ্ধৃতি থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাবে, 'বিশ্বব্যাংক পরোক্ষভাবে হলেও কাজ করে বিদেশি ব্যবসার পক্ষে। আজ যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয় তাহলে সেই কথিত বিদেশি উদ্যোক্তা তথা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠানেরই সুবিধা। এতে তারা আরো বেশি করে ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। আর সরকার যদি দাম না বাড়ায় তাহলে সরকার খুব বেশি দিন এই ভর্তুকির দায় টানতে পারবে না। এক পর্যায়ে তারা বেশি দামে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেবে। বিদ্যুতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই আসলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এঙ্টেনশন।'
সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তের ফলে বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি ও শিল্প খাতে। বোরো উৎপাদনে এই মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে সেচ পাম্প চালাতে বোরো মৌসুমে প্রয়োজন পড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। প্রভাব পড়বে শিল্প খাতেও। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, 'বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে।'
নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে কিংবা কারো মন জোগাতে সরকার কিভাবে এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার ফলে নিজের দেশের শিল্প খাতই ধসে পড়ার জোগাড়!
জামায়াত প্রসঙ্গে সাবধান!
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো। বাঙালির প্রাণের দাবি, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার। এই বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে নানা কূটকৌশলে জড়িত হয়েছে নানা মহল। দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাভাবে এই বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করাই এসব মহলের উদ্দেশ্য। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তালিকায় রয়েছেন মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের মতো শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই জামায়াতে ইসলামী মাঠে নেমেছে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। শোনা যাচ্ছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে মানবতাবিরোধী বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা অপপ্রচার ছড়ানোর কাজ শুরু করেছে দলটি। দেশের ভেতরেও সেই একই অপচক্রান্ত করার ফন্দি আটছে দলটির বর্তমান শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সরকারকে তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব বুঝে-শুনে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে কূপোকাত করতে চাইলে, যথাযথ আইনের ভিত্তিতেই করতে হবে। গায়ের জোরে দমন করতে গেলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। কারণ জামায়াত অন্যদের কাছে নিজেদের অবস্থা প্রদর্শন করে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। গত সপ্তাহে জামায়াত ও শিবিরের অফিস এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তারা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছে জামায়াত। সম্মেলনে বর্তমান সরকারকে অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। অন্যথায় দলটি সরকারকে সমুচিত জবাব দেবে বলে হুমকিও দেয়।
জামায়াত এখন এসব কথাবার্তার মাধ্যমে মূলত সরকারকে উত্তেজিত করতে চাইছে, যাতে সরকার হুট করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, যা দেখিয়ে নানা মহল থেকে সুবিধা আদায় এবং সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত করা যায়। সংবাদ সম্মেলনে সরকার জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন জামায়াত নেতারা। তাই সরকারের উচিত আইনি প্রক্রিয়ায়ই জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ এই দলের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী বহু শক্তিই ইন্ধন জোগাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করার জন্য এদের দমন করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে।
ভালোই বেহাল অর্থনীতি!
টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের অতিঋণের কারণে অর্থনীতির এই দুরবস্থা। বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। সীমিত আয়ের মানুষের উঠছে নাভিশ্বাস। মানুষের সঞ্চয়, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ এবং ব্যাংকের আমানত কমেই চলেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। তারল্য সংকটের কারণে ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্প। অর্থবছরের শুরু থেকে অবশ্য অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না বলেই গায়ে লাগেনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, অবস্থা ততই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে ব্যাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরকারকে ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকার ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় দুই পদ্ধতিতে_ট্রেজারি বিল ইস্যু করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এবং টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে। পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ করেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে প্রায় পৌনে ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের কথায় জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরবরাহ করলে অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়ে। হাই পাওয়ারড মানি হিসেবে পরিচিত এ ধরনের এক টাকা সরবরাহের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ৪ দশমিক ৭৫ টাকার সমান। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরবরাহ করছে বলেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং বেড়েই চলেছে। ফলে মানুষের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঞ্চয় কমছে। ব্যাংকগুলোতে গত বছরের তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৬৫ শতাংশ। ব্যাংকে তাই আমানত সংকট। এর প্রভাব পড়ছে শেয়ার বাজারেও। শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে দেশের ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরাই সংকটে আছে। এমন অবস্থায় বিনিয়োগ করার উপায় কী? শিল্প খাতেও ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না ব্যাংকের কাছ থেকে। শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশ।
সরকার নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে গিয়ে এই ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। আর এ জন্যই নানা খাতে ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু অপরিকল্পিত এবং অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ঋণের বোঝা থেকে তো মুক্তি মিলছেই না বরং ভর্তুকি কমিয়ে আরো অস্থিরতা বৃদ্ধি করছে সরকার। এ বিষয়ে শিগগিরই বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে এগোনো উচিত সরকারের।
এই বাঁধ পুরো দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। কিন্তু এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। তারা যে মূলত ক্ষমতার লোভেই রাজনীতি করে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আবারও। খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে চিঠি লিখেছেন যতটা না দেশের স্বার্থে, অবশ্যই তার চেয়ে বেশি নিজের বা নিজের দলের স্বার্থে। টিপাইমুখ প্রসঙ্গে দল-মত ভুলে দেশপ্রেমী সব রাজনৈতিক দলের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। সরকারেরও উচিত দেশের স্বার্থে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা।
বিদ্যুৎ নিয়ে ছিনিমিনি
মুখে স্বীকার না করলেও সরকার যে প্রতিনিয়তই বিশ্বব্যাংকের টোপ গিলে চলেছে সে কথা এরই মধ্যে সবার বোঝা হয়ে গেছে। আর এই টোপ গিলতে গিয়ে প্রচলিত আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না তারা। জ্বালানির দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে 'বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন-২০০৩'-এর ৩৪ ধারার ৫ উপধারায় ট্যারিফ-সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ট্যারিফ কোনো অর্থবছরে (জুন থেকে পরবর্তী বছরের জুলাই) একবারের বেশি পরিবর্তন করা যাবে না, যদি না জ্বালানি মূল্যের পরিবর্তনসহ অন্য কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটে। এ আইন লঙ্ঘন করে ২০১১-১২ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত দুই দফায় তেলের এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তিন দফা। গত ২০১০-১১ অর্থবছরেও তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে দুইবার।
কিছুদিন আগেই একবার বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা মোতাবেকই এই মূল্যবৃদ্ধির আয়োজন। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থা ঢাকতেই সরকার এই ভর্তুকি থেকে বাঁচার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। গত আগস্ট মাসেই ১৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের। এবার ২৪ নভেম্বর আরো এক দফা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুই ধাপে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়বে ৩১ শতাংশ। ডিসেম্বরের শুরুতে খুচরা পর্যায়েও বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম।
কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের কী লাভ? অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি উদ্ধৃতি থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যাবে, 'বিশ্বব্যাংক পরোক্ষভাবে হলেও কাজ করে বিদেশি ব্যবসার পক্ষে। আজ যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয় তাহলে সেই কথিত বিদেশি উদ্যোক্তা তথা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠানেরই সুবিধা। এতে তারা আরো বেশি করে ব্যবসা করার সুযোগ পাবে। আর সরকার যদি দাম না বাড়ায় তাহলে সরকার খুব বেশি দিন এই ভর্তুকির দায় টানতে পারবে না। এক পর্যায়ে তারা বেশি দামে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেবে। বিদ্যুতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই আসলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এঙ্টেনশন।'
সরকারের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তের ফলে বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি ও শিল্প খাতে। বোরো উৎপাদনে এই মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে সেচ পাম্প চালাতে বোরো মৌসুমে প্রয়োজন পড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। প্রভাব পড়বে শিল্প খাতেও। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, 'বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে।'
নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে কিংবা কারো মন জোগাতে সরকার কিভাবে এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার ফলে নিজের দেশের শিল্প খাতই ধসে পড়ার জোগাড়!
জামায়াত প্রসঙ্গে সাবধান!
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো। বাঙালির প্রাণের দাবি, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার। এই বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে নানা কূটকৌশলে জড়িত হয়েছে নানা মহল। দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাভাবে এই বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করাই এসব মহলের উদ্দেশ্য। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তালিকায় রয়েছেন মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের মতো শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই জামায়াতে ইসলামী মাঠে নেমেছে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে। শোনা যাচ্ছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে মানবতাবিরোধী বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা অপপ্রচার ছড়ানোর কাজ শুরু করেছে দলটি। দেশের ভেতরেও সেই একই অপচক্রান্ত করার ফন্দি আটছে দলটির বর্তমান শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সরকারকে তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব বুঝে-শুনে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে কূপোকাত করতে চাইলে, যথাযথ আইনের ভিত্তিতেই করতে হবে। গায়ের জোরে দমন করতে গেলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। কারণ জামায়াত অন্যদের কাছে নিজেদের অবস্থা প্রদর্শন করে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। গত সপ্তাহে জামায়াত ও শিবিরের অফিস এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তারা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছে জামায়াত। সম্মেলনে বর্তমান সরকারকে অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। অন্যথায় দলটি সরকারকে সমুচিত জবাব দেবে বলে হুমকিও দেয়।
জামায়াত এখন এসব কথাবার্তার মাধ্যমে মূলত সরকারকে উত্তেজিত করতে চাইছে, যাতে সরকার হুট করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, যা দেখিয়ে নানা মহল থেকে সুবিধা আদায় এবং সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত করা যায়। সংবাদ সম্মেলনে সরকার জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন জামায়াত নেতারা। তাই সরকারের উচিত আইনি প্রক্রিয়ায়ই জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ এই দলের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী বহু শক্তিই ইন্ধন জোগাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করার জন্য এদের দমন করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে।
ভালোই বেহাল অর্থনীতি!
টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের অতিঋণের কারণে অর্থনীতির এই দুরবস্থা। বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। সীমিত আয়ের মানুষের উঠছে নাভিশ্বাস। মানুষের সঞ্চয়, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ এবং ব্যাংকের আমানত কমেই চলেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। তারল্য সংকটের কারণে ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদনমুখী শিল্প। অর্থবছরের শুরু থেকে অবশ্য অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না বলেই গায়ে লাগেনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, অবস্থা ততই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে ব্যাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরকারকে ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকার ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয় দুই পদ্ধতিতে_ট্রেজারি বিল ইস্যু করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এবং টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে। পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ করেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে প্রায় পৌনে ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের কথায় জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরবরাহ করলে অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়ে। হাই পাওয়ারড মানি হিসেবে পরিচিত এ ধরনের এক টাকা সরবরাহের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ৪ দশমিক ৭৫ টাকার সমান। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরবরাহ করছে বলেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং বেড়েই চলেছে। ফলে মানুষের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঞ্চয় কমছে। ব্যাংকগুলোতে গত বছরের তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৬৫ শতাংশ। ব্যাংকে তাই আমানত সংকট। এর প্রভাব পড়ছে শেয়ার বাজারেও। শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে দেশের ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরাই সংকটে আছে। এমন অবস্থায় বিনিয়োগ করার উপায় কী? শিল্প খাতেও ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না ব্যাংকের কাছ থেকে। শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশ।
সরকার নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে গিয়ে এই ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। আর এ জন্যই নানা খাতে ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু অপরিকল্পিত এবং অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ঋণের বোঝা থেকে তো মুক্তি মিলছেই না বরং ভর্তুকি কমিয়ে আরো অস্থিরতা বৃদ্ধি করছে সরকার। এ বিষয়ে শিগগিরই বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে এগোনো উচিত সরকারের।
No comments