মন্ত্রী হলেন সুরঞ্জিত, ওবায়দুল কাদের-পূর্ণ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আজকালের মধ্যে দপ্তর পুনর্বণ্টন

ওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভা আবার সম্প্রাসরণ হচ্ছে বলে কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলে আসছিল। নতুন মুখ হিসেবে কয়েকজনের নামও শোনা যাচ্ছিল। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা তৃতীয় বারের মতো সম্প্রসারণ করার মধ্য দিয়ে সেই আলোচনার অবসান ঘটল। মন্ত্রিসভায় যোগ হয়েছেনআওয়ামীলীগেরউপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের। বঙ্গভবনে গতকাল রাত ৮টায় রাষ্ট্রপতি মো.


জিল্লুর রহমান নতুন দুই মন্ত্রীকে শপথ পড়ান। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন হাছান মাহমুদ। তিনি বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
মন্ত্রিসভা থেকে কেউ বাদ পড়েননি। তবে আজ-কালের মধ্যে কয়েকজনের দপ্তর পরিবর্তন হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিসভার সদস্য ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার আকার দাঁড়াল ৪৬ জনে। এর মধ্যে ২৮ জন পূর্ণ মন্ত্রী এবং ১৮ জন প্রতিমন্ত্রী।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীসহ ২৪ জন পূর্ণ মন্ত্রী এবং আটজন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর ১৮ দিন পর ২৪ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা প্রথম সম্প্রসারণ করা হয়। ওই দফায় ছয়জন প্রতিমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ওই বছরের ৩১ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ছয়জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে একজন পূর্ণ মন্ত্রী। বাকিরা প্রতিমন্ত্রী। আগামী ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্ণ হবে।
মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের বর্তমান মন্ত্রিসভার সমালোচনায় সরব ছিলেন এবং বারবার মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের দাবি জানান। সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রীর অদক্ষতা নিয়ে দল ও দলের বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শেয়ারবাজারে বিপর্যয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
মন্ত্রীদের বিভিন্ন বক্তব্যে বিরক্ত হয়ে ওবায়দুল কাদের সরকারি দায়িত্বশীল পদে বসে কাউকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকবার। এ ছাড়াও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সুরঞ্জিত সেনও বারবার মন্ত্রিসভার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেও পরিবর্তনের দাবি জানান বিভিন্ন সময়।
গত এক মাস ধরে মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যের পদত্যাগ, রদবদল নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, মশিউর রহমান, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান, যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ আরো অনেকের পদত্যাগের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলা না হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পদত্যাগকে দলের পক্ষ থেকে সর্বৈব মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বাস্তবতা-বিবর্জিত, অনভিপ্রেত ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার এবং গুজব বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন স্বীকার করা হয়নি। সোহেল তাজ ২০০৯ সালের ১ জুন প্রথম দফায় এবং পরের দফায় ৩১ মে পদত্যাগ করেন বলে দাবি করেন।
পদত্যাগের পর সোহেল তাজ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রে। পদত্যাগের পর সরকারের তরফ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া না হলেও গত বছরের ২৪ আগস্ট সোহেল তাজকে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়।
একটি সূত্র জানায়, পদত্যাগের পর থেকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কোনো বেতন-ভাতা বা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেননি তাজ।
মন্ত্রিসভায় তৃতীয় দফার এই পরিবর্তনেও উপেক্ষিত হয়েছেন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত দলের প্রবীণ নেতারা। প্রথম মন্ত্রিসভায় উপেক্ষিত হওয়ার পর সংস্কারপন্থী নেতারা ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সন্মেলনে দায়িত্বশীল পদ থেকেও বাদ পড়েন। তাঁদের মধ্যে আছেন আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তাঁদের পাশাপাশি উপেক্ষিত হয়েছেন শেখ পরিবারের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এ ছাড়া এবারও উপেক্ষিত রইলেন দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও কাজী জাফরুল্লাহ।
গতকালের শপথের আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের তথ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুরঞ্জিত মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ওবায়দুল কাদের ছিলেন যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী।
সুরঞ্জিত ও ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রী বানানোর ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই দিয়েছিলেন। গত ২২ নভেম্বর সোমবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সুরঞ্জিতকে মন্ত্রী বানানোর ইঙ্গিত দেন। সেই সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেশের বাইরে থাকায় শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরকে বলেন, 'দাদাকে দেশে ফিরতে বলো তাড়াতাড়ি।' এর এক দিন আগে রবিবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে ওবায়দুল কাদেরকে ডেকে ঢাকার বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দেন।
সূত্র মতে, ওবায়দুল কাদেরকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানা গেলেও সংসদবিষয়ক আলাদা কোনো মন্ত্রণালয়ে নেই। সে ক্ষেত্রে আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় ভেঙে আলাদা করতে হবে। অন্যদিকে বর্তমানে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আবুল কালাম আজাদ শুধু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন।
মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম মন্ত্রীসভায় কিছুটা পরিবর্তন আনব। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তা হয়ে উঠেনি। এবার দুজন নতুন মন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।'
বর্তমানে জলবায়ু ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আরো অধিক পরিশ্রম করে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হয় বলে ড. হাছান মাহমুদকে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান মন্ত্রিসভার কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'অনেকে অনেক কথা বলেন। আমি সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে দেখেছি। বাজেট বাস্তবায়নে আমরা রেকর্ড অর্জন করেছি। এক বছরের মধ্যে বাজেট দ্বিগুণ করা সোজা কথা নয়। আমরা বাজেট বেশি রেখে টার্গেট পূরণ করি। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত আমরা তিন মাস অন্তর অন্তর বিশ্লেষণ করি। একনেকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নও আমরা প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করি।'
'রোডমার্চে' খালেদা জিয়ার বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া কিছু দিতে পারেন না, শুধু নিতেই জানেন। উনি (খালেদা) দুর্নীতি, অর্থ পাচার, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দিতে পারেন। আমরাই দিতে পারি দেশের মানুষকে। ভাঙা-সুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জি থেকে আজ তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, দেশের মানুষকে কিছুই দিতে পারেননি। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মাঠে নেমেছেন।'
আওয়ামী লীগ অফিস থেকে জানানো হয়েছে, নবনিযুক্ত দুই মন্ত্রী আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে এবং ১১টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

No comments

Powered by Blogger.