সফলতম দলের সঙ্গে ইতিহাস বদলানোর লড়াই by নোমান মোহাম্মদ

স্পনসর প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতিযোগিতার নামকরণের রীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন। এ কারণেই আজ থেকে শুরু হওয়া সিরিজটির নাম 'কুল অ্যান্ড কুল কাপ'। কিন্তু সেখানে অংশগ্রহণকারী দুই দলের নামের অবস্থান রীতিমতো রীতিবিরুদ্ধ। পৃথিবীর যেকোনো দেশে আয়োজিত যেকোনো খেলায় স্বাগতিক দলের নাম আগে থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ চলতি সিরিজের লোগো, সংবাদ সম্মেলনের ব্যাকড্রপ_সর্বত্রই আগে থাকছে সফরকারী দলের নাম।


সিরিজটি বাংলাদেশ-পাকিস্তান না হয়ে তাই হচ্ছে পাকিস্তান-বাংলাদেশের। বিসিবি কর্তাদের বেখেয়ালি আচরণের আরেকটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকছে যা!
তবে মাঠের ক্রিকেটের কথা যদি বলেন, তাহলে কিন্তু পাকিস্তান এগিয়ে যোজন যোজন। সেটি তাদের শক্তি-সামর্থ্যে এবং সাম্প্রতিক ফর্মের বিচারেও। আর যদি বিবেচ্য হয় টোয়েন্টি টোয়েন্টি, তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পার্থক্যটা সেখানে আকাশ-পাতাল। বাইবেলে বর্ণিত ডেভিড-গোলিয়াথের দ্বৈরথই তাই হতে পারে মুশফিকুর রহিমের প্রেরণা।
২০ ওভারের এই ধুম-ধাড়াক্কা ক্রিকেটের ইতিহাস টেস্টের মতো সুপ্রাচীন নয়। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে এর পথচলা শুরু। অর্ধযুগের পরিক্রমা শেষে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ৪৯টি ম্যাচ খেলেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ মাঠে নেমেছে কেবল ১৭ বার। সাফল্যের বিচারেও তুলনা চলে না তাদের। ৩০ জয়, ১৮ হার, এক টাই ম্যাচে পাকিস্তানের সাফল্যের শতকরা হার ৬২.২৪%। ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক বলে যারা কুখ্যাত, তাদের এমন সাফল্য চমকে দেওয়ার মতোই। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাই (৬৫%) কুড়ি-বিশের ক্রিকেটে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। আর বাংলাদেশ? ৪ জয়, ১৩ হারে তাদের সফলতার পরিসংখ্যান বড্ড ম্রিয়মাণ। মাত্র ২৩.৫২%। কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড এমনকি কানাডা, আফগানিস্তানের টোয়েন্টি টোয়েন্টি রেকর্ডও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো!
এমনিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল জয়গুলোর একটি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান-বধ। তবে এর আগে-পরে কোনো ফরম্যাটের ক্রিকেটে কখনোই পাকিস্তানকে আর হারাতে পারেনি তারা। টোয়েন্টি টোয়েন্টির তুলনামূলক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের হতদরিদ্র অবস্থা। পাকিস্তানের সঙ্গে চার ম্যাচের চারটিতেই হেরেছে তারা। এ ফরম্যাটে টানা সবচেয়ে বেশি জয়ের রেকর্ড ইংল্যান্ডের, ৮ ম্যাচ। টানা ৭ ম্যাচ জিতে তাদের ঠিক পেছনেই পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আর বাংলাদেশের রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়হীন থাকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৭ সালে জয়ের পর গত মাসে আরেকবার সেই স্বাদ পেল তারা। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১২টি ম্যাচ এবং চার বছরেরও বেশি সময়।
টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান ১৬৬। পাকিস্তানের ১১টি স্কোর আছে এর চেয়ে বেশি। সর্বোচ্চ এই বাংলাদেশের বিপক্ষেই ২০০৮ সালে করাচিতে। ৫ উইকেটে ২০৩ রান। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সাকুল্যে ফিফটি করেছেন পাঁচটি। পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ফিফটি ২৮টি।
টোয়েন্টি টোয়েন্টি ইতিহাসে ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি রান করাদের মধ্যে প্রথম ১৫ জনে আছেন পাকিস্তানের চারজন_শহীদ আফ্রিদি (৭০৫), কামরান আকমল (৭০৪), মিসবাহ-উল হক (৭০০) ও শোয়েব মালিক (৬৫৬)। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান মোহাম্মদ আশরাফুলের। ১৬ ম্যাচে মাত্র ২৮৯। অথচ পাকিস্তানের উমর আকমল কেবল ২০১০ সালেই করেছেন ৪৪১ রান। এক পঞ্জিকাবর্ষে তাঁর চেয়ে বেশি রান কেবল ২০০৯ সালে তিলকরত্নে দিলশানের (৪৭১)।
বোলিংটা দেখুন। উইকেট শিকারের বিচারে এই ফরম্যাটের সবচেয়ে সফল তিন বোলারই পাকিস্তানের। শহীদ আফ্রিদি (৫৩), উমর গুল (৪৯), সাঈদ আজমল (৪৬)। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলার আবদুর রাজ্জাকের উইকেট ২২টি। উইকেট সংখ্যায় তিনি ছাড়া দুই অঙ্কে গিয়েছেন কেবল সাকিব ও মাশরাফি। ইনিংসে সবচেয়ে বেশি চারবার ৪ উইকেট করে নিয়েছেন উমর গুল। আফ্রিদির এই কীর্তি আছে তিনবার, সাঈদ আজমলের দুবার। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে ইনিংসে ৪ উইকেট নেওয়ার ঘটনাই কেবল দুটি। রাজ্জাক ও সাকিবের। উইকেটরক্ষক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসাল কামরান আকমলের, ৪৫। মুশফিকুর রহিমের তা মাত্র ১৫।
এ ছাড়া ২০ ওভারের এ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জিতেছেন সনাৎ জয়াসুরিয়া ও আফ্রিদি, ছয়বার করে। সেখানে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা সাকুল্যেই এ পুরস্কার বগলদাবা করেছেন ছয়বার!
অর্থাৎ আজ টোয়েন্টি টোয়েন্টির লড়াইয়ে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ শুধু পাকিস্তান না, ইতিহাসও। মুশফিকুর রহিম অবশ্য সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবতে রাজি নন। ঝলমলে আত্মবিশ্বাসেই তাই সংবাদ সম্মেলনে বলে গেলেন, 'গত মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলার আগেও তো ওরা ফেভারিট ছিল। কিন্তু ওই ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো শুরু করলে এবং সেটা ধরে রাখতে পারলে ফল আমাদের পক্ষেও আসতে পারে। হ্যাঁ, ওরা ভালো ফর্মে আছে। কিন্তু কাল তো সেই প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে। ওরা যা করে এসেছে সেসব এখন ইতিহাস।'
সেই পুরনো ইতিহাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের নতুন করে ইতিহাস লেখার চ্যালেঞ্জ!

No comments

Powered by Blogger.