ডারবান জলবায়ু সম্মেলনে জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ by ড. মো. দানেশ মিয়া
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ১৯৯৭ সালে কিওটো প্রটোকলের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর যে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা আজ এত বছর পরও খুব একটা সফলতার মুখ দেখেনি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাদের ভোগবিলাসের জন্য কার্বন নির্গমন প্রায় আগের মতো করেই যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর মানুষের ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই চলছে প্রতিনিয়ত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ ভানুয়াতুর মতো অন্য অনেক দেশ সাগরের বাড়তি
পানিতে তলিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রায় অপ্রতিরোধ্য। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আর্তনাদ আর হাহাকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে দিন দিন।
আজকে এমন একটি জ্ঞান ও ন্যায়ভিত্তিক নয়া সমাজব্যবস্থার দিকে আমরা এগোচ্ছি, যেখানে দুর্নীতিমুক্ত ক্রমঅগ্রসরমান অর্থনীতির সঙ্গে সুস্থ একটি প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ধনাত্মক সম্পর্ক আছে, তা মোটামুটি আমরা সবাই বুঝতে পারি। এই প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যস্ততার সঙ্গে যে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ছে, তা রাজনৈতিক অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে পৃথিবীর অনেক দেশে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে ধেয়ে আসছে, তার সঙ্গে মানিয়ে না চলতে পারলে অর্থনীতিকে কখনোই শক্তিশালী করা সম্ভব হবে না। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ একটি বাস্তবতা। মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলেই যে এই পরিবর্তন হচ্ছে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এই পরিবর্তনটি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে হঠাৎ করে একে ঠেকিয়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনের মাত্রা হয়তো প্রশমন করা যেতে পারে। তাই পৃথিবীর অসংখ্য বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারক কঠিনভাবে ভেবে দেখছেন, কিভাবে জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রশমন করা যায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নই হচ্ছে বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ। এটি আশার কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সব উন্নত দেশই তাদের ব্যাপক শিল্পোৎপাদন ও অন্যান্য ভোগবিলাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ানোর দায়-দায়িত্বগুলো স্বীকার করে নিয়ে তা প্রশমনে কাজ করার চেষ্টা করছে। যেহেতু প্রশমনপ্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন, তাই এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে পড়ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। প্রশমনের কোনো নৈতিক দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের না থাকলেও মানিয়ে চলার দক্ষতা অর্জন আমাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে, বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা করছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করছে, পরিবেশ সংরক্ষণে অংশীদারিত্বমূলক নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।
পৃথিবীব্যাপী বনের ধ্বংসযজ্ঞ ২০-২৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। এই ধ্বংসযজ্ঞের বেশির ভাগই হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও ক্রান্তীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশের বন ধ্বংসও এ ক্ষেত্রে কম ভূমিকা রাখেনি। দেশের মোট ভূ-ভাগের ১৭ শতাংশ বনভূমি কাগজে-কলমে থাকলেও বেশ কিছু বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে বন আইনের সঠিক ব্যবহার ও পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে। বর্তমানে দেশের মোট ভূ-ভাগের প্রায় ১০ শতাংশ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বন বলতে সত্যিকার অর্থে যা বোঝায়, তা দু-তিন শতাংশের বেশি হবে না। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য একটি দেশের মোট ভূ-ভাগের ২৫ শতাংশ সত্যিকার অর্থে বনভূমি থাকা যেমন জরুরি, আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তা প্রশমনের জন্যও অত্যধিক জরুরি_শুধু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, বরং সারা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে। বিশাল জনসমর্থনপুষ্ট বর্তমান সরকারের কাছে সব জনগণের প্রত্যাশা এটাই থাকবে, যেন সারা দেশের গ্রাস হওয়া বনভূমিগুলো উদ্ধার করে নতুন বনাচ্ছাদন সৃষ্টি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মানব সমাজের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াটি বেশ জটিল। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়টিও তাই কঠিন ও জটিল। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি পরিবর্তনের যে আঞ্চলিক মডেল আছে, সে মডেল অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে কোন সময় কতটুকু প্রভাব পড়বে, তা হিসাব করে মানিয়ে চলার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য ব্যাপক গবেষণা করতে হবে। আমাদের দক্ষতা ও অর্থের অভাবে বাংলাদেশে এ রকম গবেষণা খুবই কম হচ্ছে বলে আমার ধারণা। বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছু অংশ দিয়ে গবেষণার ব্যাপকতা ও গভীরতা বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের দায় আমাদের নয়, এই দায় শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি আমরা। সে জন্য মানিয়ে চলার জন্য আমাদের যত গবেষণা এবং পরিবর্তিত জীবনাচরণের জন্য যা যা দরকার, তার সবটুকুই দায়ী দেশগুলোকে আমাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশন খুব দরকার। বছর বছর বন্যা, সাইক্লোন ও অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয় যে দারিদ্র্য বাড়ায়, খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তা যে ব্যাহত হয়, তা আজ স্পষ্ট। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিমজ্জমান স্থলভূমি ও ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা যে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি ও সামগ্রিক সমাজব্যবস্থাকে ব্যাপক পরিবর্তন করে দেবে, তা যদি ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে আমরা এখনই বুঝতে চেষ্টা না করি, তাহলে আমাদের নিশ্চিতভাবে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে এবং এতে যেকোনো সরকারকেই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। মহাজোট সরকারের কাছে আমাদের বিনীত প্রত্যাশা_একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যে আন্তসম্পর্ক রয়েছে, তা বিবেচনায় রেখে অর্থনীতি শক্তিশালী করার পথটি যেন বাছাই করে নেওয়া হয়। আমাদের হাতে আর সময় নেই। আমাদের যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তা যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে দুঃখজনকভাবে আমাদের অস্তিত্বের ওপরই আঘাত আসবে। আর কোনো রোডম্যাপের জন্য আমরা অপেক্ষা করতে চাই না। কপ ১৮-এর জন্যও আমরা তাকিয়ে থাকতে চাই না। আমাদের এখনই সর্বশক্তি নিয়ে জ্বলে উঠতে হবে। ডারবানে যাওয়ার আগে বাংলাদেশেই প্রয়োজনে নেগোসিয়েশনের একটি মহড়া হতে পারে, যাতে দায়ী দেশগুলোর সামনে দাবি পেশ করার সময় আমাদের থতমত খেতে না হয়। ডারবান সম্মেলন যেন পর্যটনসর্বস্ব আর নীতিনির্ধারকদের বাজার-সদাই করার সম্মেলন না হয়। নভেম্বরের ২৮ থেকে ডিসেম্বরের ৯_এই সময়গুলোতে আমরাও সবাই দেশে ও বিদেশে যে যেভাবে পারি, মিডিয়ার সামনে বাংলাদেশের আর্তনাদ তুলে ধরতে পারি। আর জ্বলে উঠতে পারি সবাই মিলে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments