কালান্তরের কড়চা-ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা কি মঙ্গল হবে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সরকার বৃহত্তর ঢাকা শহরের সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা অথবা নিউ ঢাকা ও ওল্ড ঢাকার জন্য দুটি স্বতন্ত্র সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাহলে ঢাকা সিটির জন্য (নতুন ও পুরনো) একজন মেয়রের বদলে দুজন মেয়র নির্বাচিত হবেন। এটা কি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, না রাজনৈতিক-দলীয় স্বার্থের জন্য করা হচ্ছে? এই প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই উঠেছে। এই বিভক্তিকরণের প্রস্তাব বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত এখন ব্যাপক জন-সমালোচনার মুখে পড়েছে। সুদূর লন্ডনে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের অনেক হিতাকাঙ্ক্ষীও আমাকে টেলিফোন করে বলছেন, সরকারকে অনুরোধ জানান, তাদের ক্ষমতায় থাকার এই মেয়াদে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত তারা যেন 'ডেফার' করে। এবার আগের মতোই অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন হয়ে যাক। তাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের মতো কিছু হলেও ক্ষতি নেই। বরং সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বাড়বে।
এই বন্ধুদের আরো যুক্তি হলো, এমনিতেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিপর্যয় সরকারকে ভীত করেছে এবং ঢাকার নির্বাচনেও পরাজয়ের ভয়ে সরকার এই নির্বাচন আটকে রেখেছে, এই বিশ্বাস নাগরিকদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। সুতরাং এখন রাজধানীর উন্নয়নের স্বার্থে সরকার সিটি করপোরেশন বিভক্ত করতে চাইছে_এই বিশ্বাস নগরবাসীর মনে ফিরিয়ে আনা যাবে না। আর ফিরিয়ে আনা না গেলে ঢাকার জন্য দুটি সিটি করপোরেশন করেও দুই মেয়র পদে সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী (নারায়ণগঞ্জের আইভীর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রার্থী না হলে) জিতিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না তা সন্দেহের বিষয়।
ঢাকা শহরের বর্তমান আয়তন ও জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে ওঠায় অনেকেই ভাবতে পারেন, শহরটির যথার্থ উন্নয়নের স্বার্থে তার নগর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সিটি করপোরেশন একটির বদলে দুটি এবং নগরপাল বা মেয়র একজনের বদলে দুজন হলে ভালো হয়। বর্তমান সরকার যদি এই কথাটা আগেই ভাবত এবং মেয়র পদে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা কিংবা অন্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আগে পদক্ষেপটি নিত, তাহলে সম্ভবত এই ধারণাটি এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত না যে সরকার মেয়র নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করতে চাইছে। নাগরিকদের মন থেকে আগে এই সন্দেহটি দূর করা দরকার।
আমার মতো দীনহীনের পরামর্শ সরকার শুনবে, তা আশা করি না। তবু সরকারকে অনুরোধ করছি, তারা সিটি করপোরেশন ভাগ করা থেকে এবারের মেয়াদে বিরত থাকুক। দলীয় স্বার্থে নয়, নাগরিকদের স্বার্থে এই ভাগ করা দরকার কি না তা বিবেচনা করে দেখুক। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা হলে নাগরিকদের সুখ-সুবিধা বাড়বে, না আরো সমস্যায় জড়াবে_তা আগে পর্যালোচনা করে দেখুক। এই ব্যাপারে তারা নগরবাসীর মতামত জরিপ করে দেখতে পারে এবং একটি সর্বদলীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তাদের পরামর্শ শুনতে পারে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা সংসদে পাস করানো ঠিক হবে না। এটা যেন এরশাদের আমলের হাইকোর্ট বিভক্তিকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের অবস্থা সৃষ্টি না করে এবং একই পরিণতি বরণ না করে।
ইত্যবসরে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আর যেন গড়িমসি না করে। নির্বাচনের আগে খুবই স্বল্পমেয়াদি একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সরকার নিযুক্ত করতে পারে। আমাকে ঢাকার এক বিশিষ্ট ব্যক্তি টেলিফোনে বলেছেন, 'সাদেক হোসেন খোকার মতো লোকের ভয়ে যদি সরকার দীর্ঘকাল সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখে এবং করপোরেশন ভাগ করতে চায়, তাহলে তারা স্বীকার করছে না কেন যে বিএনপিকে তারা ভয় করতে শুরু করেছে। সরকারের মন থেকে এই ভয় দূর করার জন্যই সম্ভবত সাদেক হোসেন খোকা বলেছেন, 'আমি মেয়র পদের নির্বাচনে আর দাঁড়াব না, দয়া করে সরকার যেন সিটি করপোরেশন ভাগ না করে।' খোকার এই উক্তি কি আওয়ামী লীগের মতো দলের জন্য যথেষ্ট অবমাননাকর নয়?
আমার ধারণা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনটি যথাসম্ভব দ্রুত শেষ করে ফেলা উচিত। আওয়ামী লীগ যদি পুরনো ও বিতর্কিত মুখগুলোর মধ্যে প্রার্থী সন্ধান না করে নতুন ও পুরনো ঢাকার নাগরিকদের কাছে সৎমানুষ হিসেবে পরিচিত একজন তরুণ প্রজন্মের কাউকে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেয়, তাহলে এখনো ঢাকা সিটি করপোরেশন তাদের হাতছাড়া হওয়ার কথা নয়। এই ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আর সে শিক্ষা যদি তারা না নেয় এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন নাগরিকদের অনুমোদন না নিয়ে ভাগ করে পুরনো ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের মেয়র পদে সমর্থন দেয়, তাহলে দুই মেয়র পদেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। বরং দুই পদেই হারার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
কোনো শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে বেড় যাওয়ার জন্য যদি সিটি করপোরেশন ভাগ করতে হতো, তাহলে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন বা কলকাতার মতো বড় শহরেও এই বিভাজন লক্ষ করা যেত। ঢাকার চেয়েও বড় এবং বেশি জনসংখ্যার শহর ও নগরগুলো যদি একটি সংস্থা দ্বারা চালিত হতে পারে, তাহলে ঢাকায় তার অন্যথা হবে কেন? কোনো দলীয় সরকার দলীয় স্বার্থে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার গায়ে হাত দিতে গেলে পরিণতি কী দাঁড়ায়, লন্ডন থেকেই তার একটি উদাহরণ দেব।
দীর্ঘকাল ধরে বৃহত্তর লন্ডন গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল (জিএলসি) নামের একটি স্বায়ত্তশাসিত নগর সংস্থা এবং একজন মেয়র দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছিল। এই জিএলসির মেয়র ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বামপন্থী বলে পরিচিত লেবার দলীয় নেতা কেন লিভিংস্টোন। টোরি দলের মার্গারেট থ্যাচারের ক্ষমতায় আসার পর কেন লিভিংস্টোনের জনপ্রিয়তা এবং জিএলসির ক্ষমতা তাঁর সহ্য হয়নি। তিনি লিভিংস্টোনকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে জিএলসি টোরিদের দখলে আনার অনেক চেষ্টা করেন। না পেরে গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নেন (বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন বিলোপ নয়, বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে)।
কেন্দ্রীয় নগর সংস্থাটি ভেঙে দিয়ে গ্রেটার লন্ডনের উন্নয়ন ও নগরবাসীকে অধিকতর সেবা দানের জন্য করা কাউন্সিল ও কাউন্টি কাউন্সিলগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো হবে বলে টোরি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করতে পারেনি। অন্যদিকে দেখা গেল, নগরবাসীকে নিয়মিত সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বারা ও কাউন্টি কাউন্সিলের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধায়ক সংস্থায় অনুপস্থিতিতে কোনো সমন্বয়, যোগাযোগ ও ভারসাম্য নেই; বরং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার অতিরিক্ত কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে পোলট্যাঙ্ নামে একটি করের বোঝা নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেন। এর বিরুদ্ধে নাগরিক বিক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। পরিণামে মিসেস থ্যাচারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়।
কেবল টোরি পার্টি বা সরকারের ক্ষমতার স্বার্থে গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল ভেঙে দিয়ে টোরি সরকার গ্রেটার লন্ডনের নৈরাজ্যকর অবস্থা সামাল দিতে পারেনি। ওই গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিলের ভগ্নাবশেষের ওপর তাদেরই আবার গ্রেটার লন্ডন অথরিটি নামে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গড়ে তুলতে হয়েছে। আবার সাবেক জিএলসির বিতাড়িত মেয়র কেন লিভিংস্টোনই (তখন তিনি লেবার পার্টি থেকে বিতাড়িত) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে দাঁড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের আইভীর মতো বিপুল ভোটে জিতেছিলেন এবং লেবার পার্টি আবার তাঁকে দলে টেনে নিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সেলিনা আইভীর ব্যাপারেও তা-ই ঘটেছে।
নিউ ইয়র্কে তো বহুবার এমন হয়েছে, গভর্নর পদে রিপাবলিকান থাকলে সিটি মেয়রের পদে ডেমোক্র্যাট অথবা গভর্নর ডেমোক্র্যাট হলে মেয়র পদে রিপাবলিকান দেখা গেছে; তাতে ক্ষতিটা হয়েছে কী? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তো এমনটাই হওয়া উচিত। বাংলাদেশে বিএনপি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ কি দোর্দণ্ড প্রতাপে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেননি? বর্তমানেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি সমর্থিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা কি তাঁর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গত তিন বছর ধরে মেয়র পদে কাজ চালাচ্ছেন না? তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে কি?
যদি ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আগামী নির্বাচনে দেখা যায় সরকারের পছন্দের অথবা সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হননি, তাতে অবশ্যই আওয়ামী লীগের মতো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জয়-পরাজয় মেনে নিয়েই গণতান্ত্রিক রাজনীতি। আওয়ামী লীগ তো পঞ্চাশের দশকের মুসলিম লীগ নয় যে পরাজয়ের ভয়ে প্রাদেশিক পরিষদের ৩৫টি উপনির্বাচনও ঠেকিয়ে রাখবে, কিংবা কয়েক বছর আগে সংসদের মাগুরা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিএনপির মতো জাল-জুয়াচুরির আশ্রয় নেবে!
আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নির্বাচনকে দলীয় করে পরাজয়ের নিরিখে বিচার না করাই ভালো। তাদের দেখা উচিত, নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, যোগাযোগ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে উপযুক্ত সেবা (সার্ভিস) দিতে পারেন, এখন যোগ্য ও দক্ষ লোক নির্বাচিত হয়েছেন কি না। যদি হন, তিনি কোন দলের লোক তা বিবেচনা না করে তাঁকে সরকারের উচিত সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া।
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ ঘুরে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং লোকাল সেলফ গভর্নমেন্টের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা না থাকলে কোনো দেশে গণতন্ত্র এবং জনকল্যাণব্যবস্থা_কোনোটাই সাফল্য দেখাতে পারে না। আমাদের দেশে গণতন্ত্র মাথাভারী। তার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নেই। সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের কুক্ষিগত।
স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নামেই মাত্র স্বায়ত্তশাসন আছে। আসলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুমবরদার।
বাংলাদেশে এই অবস্থা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বিরাজিত। মন্ত্রী, এমপি, আমলারা তাঁদের হাতের অঢেল ক্ষমতা ছাড়তে চান না। দেশের সব উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলোর ওপর তারা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছেন। দেশে জেলা পরিষদ আছে, উপজেলা পরিষদ আছে, ইউনিয়ন পরিষদ আছে, তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁদের হাতে ক্ষমতা নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের বোঝা উচিত, দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর কোনো বিভক্তিকরণের দরকার নেই। দরকার সংস্থাগুলোর ক্ষমতা, দায়িত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি। সংস্থাগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করতে হবে। আমার ধারণা, দলমত নির্বিশেষে ঢাকাবাসীর এখন একটাই দাবি, সিটি করপোরেশনের বিভক্তি চাই না। দুই মেয়রের মধ্যে লড়াই দেখতে চাই না। বিভক্ত সিটির বিভক্ত ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন দেখতে চাই না। চাই অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের হাতে অধিকতর ক্ষমতা এবং একজন নির্বাচিত সৎ ও দক্ষ মেয়র।
লন্ডন, ২৮ নভেম্বর, সোমবার, ২০১১
No comments