ভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে ও জীবনে-ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর
আজ ২০১২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ৬০ বছর আগে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার রাজপথে বাঙালি ছেলেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার অধিকারকে সর্বজনীন মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ রচনা করেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো দিন। এই দিনকে আমরা ভুলতে পারি না।
একুশের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দিনটি এবার উদ্যাপিত হচ্ছে আরও ব্যাপক উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি ভাষাশহীদদের; আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি ভাষাসৈনিকদের।
মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণদের সেদিনের আত্মবলিদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল। সে স্বপ্নই ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পথ দেখিয়েছে বাঙালি জাতিকে। তাই ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র—আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস।
২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এই দেশেও সংখ্যার দিক থেকে ছোট অনেক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয় পরিপুষ্টির সুযোগ অবারিত রাখতে হবে।
আজ এ কথা ভেবে দেখার দিন, যে বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি তরুণেরা প্রাণ দিয়েছেন, সেই প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার আজ কী অবস্থা। কাগজ-কলমে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রচলন ঘটেনি; এখনো ইংরেজির প্রাধান্য বেশি। আইন প্রণয়ন হয় বাংলায়, কিন্তু উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা চালু হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার জায়গা নেই বললেই চলে। এনজিও খাতও চলছে মূলত ইংরেজি ভাষায়। তাদের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামগুলোর ভাষা প্রধানত ইংরেজি; তাদের প্রতিবেদন ও অন্যান্য লেখালেখির ভাষাও তা-ই। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি রপ্ত করতেই বেশি আগ্রহী। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বাংলায় লিখতে না পারা অগৌরব বলে বিবেচিত নয়। শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের প্রসার নয়, বাংলার প্রতি অবহেলা সাধারণ বিদ্যালয়েও কম নয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে; কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার অবসান ঘটলে বাংলার প্রতি অবহেলা প্রকট হয়। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃভাষার মর্যাদা নেই; সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ঘটলেই কেবল তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়। শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে প্রয়োজন একটি জাতীয় ভাষাপরিকল্পনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কিছু স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ও মানুষ, যাঁরা বাংলা ভাষার বিকাশের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাবেন।
No comments