একুশ : ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে by সেলিনা হোসেন
আমাদের সংস্কৃতিতে কি অভিঘাত এনেছিল একুশ? একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী ঘটেছিল? প্রথমে আমরা তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। ঘটনাগুলো তো আমাদের সবারই জানা। পরিপ্রেক্ষিতও জানা। তবু আর একবার নতুন করে দেখা যাক। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটল। জন্ম হলো পাকিস্তান এবং ভারতের।
পাকিস্তান তৈরি হলো, কথিতভাবে, মুসলমানদের জন্য, অন্যদিকে ভারত ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের জন্য। আমরা, তৎকালীন বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় পাকিস্তানকে সমর্থন করলাম। তার মানে, আমরা ধর্মকে প্রাধান্য দিলাম এবং একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য সৃষ্ট রাষ্ট্রের অংশীদারি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলাম। পাকিস্তানে প্রথম দিন থেকেই একনায়কত্ব স্থাপিত হলো, অন্যদিকে ভারতে প্রথম দিন থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা পাকিস্তানের একনায়কের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করলাম না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তিনি জোর গলায় বললেন, উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।
আমরা কি সে সময় প্রকৃতপক্ষেই ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিকে সর্বপ্রধান করে দেখেছিলাম? যদি দেখে থাকি, কেন দেখেছিলাম? ধর্মানুভূতির সঙ্গে একনায়কত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি আমরা সে সময়ে বিশেষ ধর্মানুভূতি দিয়ে আলোড়িত হয়েও থাকি, তাহলেও আমরা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম না কেন? এর কারণ কি এই যে আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত হয়নি অথবা গণতান্ত্রিক চেতনার চেয়ে ধর্মীয় আদর্শ ও অনুভূতিকে আমরা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলাম? মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন কেন? উর্দু পাকিস্তানের কোনো অংশেরই জনগণের মাতৃভাষা ছিল না। তবুও কেন? এর কারণ কি এই যে উর্দুর সঙ্গে একটি ইসলামী আবহ আছে? যেহেতু পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য গঠিত রাষ্ট্র, যেহেতু ইসলাম মুসলমানদের ধর্ম এবং উর্দু প্রধানত ভারতীয় মুসলমানদের ভাষা এবং উর্দু আরবি হরফে লেখা হয়, সেহেতু যে ধর্মাবলম্বীদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, সেই ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের সঙ্গে নৈকট্যের জন্যই কি উর্দুকে বেছে নেওয়া হলো? যদি তা-ই হয়ে থাকে, আমরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলাম না কেন? আমাদের ধর্মীয় আবেগ কি হঠাৎ করে বিলুপ্ত বা ক্ষীণ হয়ে গেল? যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা কেন হলো এবং কেমন করে হলো? এ সবই সংস্কৃতির প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলোর সার্বিক উত্তর অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়েই অমর একুশের পরবর্তী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সম্যকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এ দেশে বহু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বাস করে। যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ, বলা যাক বিপুলসংখ্যক মানুষ ধর্মানুরাগী এবং ধর্মীয় আচরণ পালনে বিশেষভাবে যত্নশীল। এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি না যে তারা ধর্মের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মভীরু ও ধর্মপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মান্ধ নয় এবং আগেও ছিল না। এ কথা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই। ধর্মের প্রতি অনুরাগের কারণে নয়, বরং এ দেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের প্রতি রায় দিয়েছিল, আমি মনে করি অন্য একটি কারণে। তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল একটি ভীতি থেকে। আবার একই ভীতি থেকে তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকেও সমর্থন করেছিল।
'একুশের চেতনা' বলে একটি কথা বারবার শোনা যায়। একুশের চেতনা মানে কী? নানা সময়ে এর নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমার সামান্য বিবেচনায় একুশের চেতনা মানে- এক. মাতৃভাষাকে এবং মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত করা, কেননা মাতৃভাষাকে সমুন্নত করতে গিয়ে একুশের শহীদরা আত্মাহুতি দিয়েছেন। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে একুশের স্বীকৃতি এই দিকটির স্বীকৃতি; দুই. জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকারকে সমুন্নত করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হতে হবে। এই ভূখণ্ডের মানুষের ভাষা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জনের জন্য ভাষা আন্দোলন হয়েছিল; তিন. সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করা। রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি মানুষের সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিংবা এ দুইয়ের মধ্যে যদি কোনো অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে সংস্কৃতির ক্ষতি হয় না, সংস্কৃতি টিকেই থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যেমন ভেঙে পড়েছিল ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সরকার এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটিই।
মাতৃভাষা সমুন্নত করার অর্থ কেবল বাংলা ভাষা সমুন্নত করা নয়, প্রত্যেক নাগরিকের মাতৃভাষাই সমুন্নত করা। যদিও তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম, তবু এই দেশে এমন নাগরিক আছে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। সংখ্যালঘু নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী তো আছেই, এদের সবার মাতৃভাষাকে সমুন্নত করার চেষ্টা যদি না করা হয় এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে তা আমার বিবেচনায় মাতৃভাষাকে সমুন্নত করার জন্য একুশের যে চেতনা, তাকেই হেয় করা হয়। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মাতৃভাষা সমুন্নত করার জন্য বলতে গেলে কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার গতিও দুঃখজনকভাবে শ্লথ। বিশেষ করে প্রকৌশল ও চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব খুবই তীব্র। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই সীমিত। কম্পিউটার উন্নতমানের মুদ্রাক্ষরযন্ত্র নয়, কিন্তু কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা থেকে মনে হয় কম্পিউটার উন্নতমানের মুদ্রাক্ষরযন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এমনটি কিন্তু অন্য দেশে ঘটেনি। কম্পিউটারের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে দুরূহ জাপানি ভাষার ব্যবহার তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা এত বছরেও ১০০ ভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে পারিনি। তার মানে, আমরা আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষকে বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা একুশের চেতনার এবং আমাদের সংস্কৃতিতে একুশের চেতনার অভিঘাতের সার্থকতা প্রমাণ করে না।
অমর একুশে ছিল ন্যায়ের পক্ষে, সুতরাং সত্যেরও পক্ষে। কিন্তু আমাদের নির্মোহ, তথ্যভিত্তিক সঠিক এবং সত্য ইতিহাস কি এখনো লেখা হয়েছে? না, হয়নি। সত্য কথা বললে কেউ যদি আহত হয়, সেই ভয়ে বারবার বিকৃত বা খণ্ডিত বা অর্ধসত্য বিবরণ রচিত হয়েছে। কোনো মানুষই ভুলের ওপরে নয়। ভুলভ্রান্তি থাকলেই যেকোনো মানুষের কৃতিত্ব ও গৌরব ম্লান হয়ে যাবে, এমনও নয়। তাহলে একজন মানুষকে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে দেখব না কেন? আমাদের ভয় কিসের? একুশের চেতনাকে যদি আমরা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম এবং নিজেদের মধ্যে লালন করতে পারতাম, তাহলে এমনটি ঘটত না; খণ্ডিত বা পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচিত হতো না। আমরা কি সত্য বলব না, কেবল ক্ষমতাসীনদের মুখ চেয়ে আমাদের লেখা লিখে যাব, কাউকে অবজ্ঞা করব, কাউকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড় করে তুলব- এটি আর যা-ই হোক একুশের চেতনা নয়। এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমি গৌরবের সঙ্গে বলতে চাই যে একুশের চেতনা একটি খাঁটি চেতনা। এই চেতনা বেঁচে আছে এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে, ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষী মানুষের মধ্যে নয়। একুশের চেতনার এই শক্তির প্রমাণ প্রতিবছর সেই অমর দিনে আমরা দেখতে পাই।
মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে? এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমনভাবে মিশে আছে যে সংকটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এ ভালোবাসার কথা ভুলেই যায়। যখন মানুষ তা ভুলে যায়, তখন মানুষ এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে, যাতে সেই ভালোবাসা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানুষ হয়তো এই আশঙ্কার কথা বুঝতেই পারে না। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা মানুষকে তাই মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের ফল্গুধারার মতো ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়, সে ভালোবাসার প্রকাশ প্রয়োজন। সে ভালোবাসা লালন করা প্রয়োজন এবং সে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অমর একুশে আমাদের সে প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদার প্রতীক হয়ে অমর একুশে আমাদের সংস্কৃতিকে ও আমাদের জীবনকে নতুন মাত্রা দেয়। এ কারণেই আমাদের সংস্কৃতিতে অমর একুশে একটি অবিস্মরণীয় বাঁকবদল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
আমরা কি সে সময় প্রকৃতপক্ষেই ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিকে সর্বপ্রধান করে দেখেছিলাম? যদি দেখে থাকি, কেন দেখেছিলাম? ধর্মানুভূতির সঙ্গে একনায়কত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি আমরা সে সময়ে বিশেষ ধর্মানুভূতি দিয়ে আলোড়িত হয়েও থাকি, তাহলেও আমরা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম না কেন? এর কারণ কি এই যে আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত হয়নি অথবা গণতান্ত্রিক চেতনার চেয়ে ধর্মীয় আদর্শ ও অনুভূতিকে আমরা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছিলাম? মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন কেন? উর্দু পাকিস্তানের কোনো অংশেরই জনগণের মাতৃভাষা ছিল না। তবুও কেন? এর কারণ কি এই যে উর্দুর সঙ্গে একটি ইসলামী আবহ আছে? যেহেতু পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য গঠিত রাষ্ট্র, যেহেতু ইসলাম মুসলমানদের ধর্ম এবং উর্দু প্রধানত ভারতীয় মুসলমানদের ভাষা এবং উর্দু আরবি হরফে লেখা হয়, সেহেতু যে ধর্মাবলম্বীদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, সেই ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের সঙ্গে নৈকট্যের জন্যই কি উর্দুকে বেছে নেওয়া হলো? যদি তা-ই হয়ে থাকে, আমরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলাম না কেন? আমাদের ধর্মীয় আবেগ কি হঠাৎ করে বিলুপ্ত বা ক্ষীণ হয়ে গেল? যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা কেন হলো এবং কেমন করে হলো? এ সবই সংস্কৃতির প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলোর সার্বিক উত্তর অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়েই অমর একুশের পরবর্তী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সম্যকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এ দেশে বহু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বাস করে। যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ, বলা যাক বিপুলসংখ্যক মানুষ ধর্মানুরাগী এবং ধর্মীয় আচরণ পালনে বিশেষভাবে যত্নশীল। এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি না যে তারা ধর্মের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মভীরু ও ধর্মপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মান্ধ নয় এবং আগেও ছিল না। এ কথা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই। ধর্মের প্রতি অনুরাগের কারণে নয়, বরং এ দেশের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের প্রতি রায় দিয়েছিল, আমি মনে করি অন্য একটি কারণে। তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল একটি ভীতি থেকে। আবার একই ভীতি থেকে তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকেও সমর্থন করেছিল।
'একুশের চেতনা' বলে একটি কথা বারবার শোনা যায়। একুশের চেতনা মানে কী? নানা সময়ে এর নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমার সামান্য বিবেচনায় একুশের চেতনা মানে- এক. মাতৃভাষাকে এবং মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত করা, কেননা মাতৃভাষাকে সমুন্নত করতে গিয়ে একুশের শহীদরা আত্মাহুতি দিয়েছেন। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে একুশের স্বীকৃতি এই দিকটির স্বীকৃতি; দুই. জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকারকে সমুন্নত করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হতে হবে। এই ভূখণ্ডের মানুষের ভাষা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জনের জন্য ভাষা আন্দোলন হয়েছিল; তিন. সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করা। রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি মানুষের সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কিংবা এ দুইয়ের মধ্যে যদি কোনো অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে সংস্কৃতির ক্ষতি হয় না, সংস্কৃতি টিকেই থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যেমন ভেঙে পড়েছিল ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সরকার এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটিই।
মাতৃভাষা সমুন্নত করার অর্থ কেবল বাংলা ভাষা সমুন্নত করা নয়, প্রত্যেক নাগরিকের মাতৃভাষাই সমুন্নত করা। যদিও তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম, তবু এই দেশে এমন নাগরিক আছে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। সংখ্যালঘু নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী তো আছেই, এদের সবার মাতৃভাষাকে সমুন্নত করার চেষ্টা যদি না করা হয় এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে তা আমার বিবেচনায় মাতৃভাষাকে সমুন্নত করার জন্য একুশের যে চেতনা, তাকেই হেয় করা হয়। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মাতৃভাষা সমুন্নত করার জন্য বলতে গেলে কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার গতিও দুঃখজনকভাবে শ্লথ। বিশেষ করে প্রকৌশল ও চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব খুবই তীব্র। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার খুবই সীমিত। কম্পিউটার উন্নতমানের মুদ্রাক্ষরযন্ত্র নয়, কিন্তু কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা থেকে মনে হয় কম্পিউটার উন্নতমানের মুদ্রাক্ষরযন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এমনটি কিন্তু অন্য দেশে ঘটেনি। কম্পিউটারের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে দুরূহ জাপানি ভাষার ব্যবহার তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা এত বছরেও ১০০ ভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে পারিনি। তার মানে, আমরা আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষকে বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা একুশের চেতনার এবং আমাদের সংস্কৃতিতে একুশের চেতনার অভিঘাতের সার্থকতা প্রমাণ করে না।
অমর একুশে ছিল ন্যায়ের পক্ষে, সুতরাং সত্যেরও পক্ষে। কিন্তু আমাদের নির্মোহ, তথ্যভিত্তিক সঠিক এবং সত্য ইতিহাস কি এখনো লেখা হয়েছে? না, হয়নি। সত্য কথা বললে কেউ যদি আহত হয়, সেই ভয়ে বারবার বিকৃত বা খণ্ডিত বা অর্ধসত্য বিবরণ রচিত হয়েছে। কোনো মানুষই ভুলের ওপরে নয়। ভুলভ্রান্তি থাকলেই যেকোনো মানুষের কৃতিত্ব ও গৌরব ম্লান হয়ে যাবে, এমনও নয়। তাহলে একজন মানুষকে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে দেখব না কেন? আমাদের ভয় কিসের? একুশের চেতনাকে যদি আমরা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম এবং নিজেদের মধ্যে লালন করতে পারতাম, তাহলে এমনটি ঘটত না; খণ্ডিত বা পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচিত হতো না। আমরা কি সত্য বলব না, কেবল ক্ষমতাসীনদের মুখ চেয়ে আমাদের লেখা লিখে যাব, কাউকে অবজ্ঞা করব, কাউকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড় করে তুলব- এটি আর যা-ই হোক একুশের চেতনা নয়। এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমি গৌরবের সঙ্গে বলতে চাই যে একুশের চেতনা একটি খাঁটি চেতনা। এই চেতনা বেঁচে আছে এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে, ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষী মানুষের মধ্যে নয়। একুশের চেতনার এই শক্তির প্রমাণ প্রতিবছর সেই অমর দিনে আমরা দেখতে পাই।
মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে? এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমনভাবে মিশে আছে যে সংকটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এ ভালোবাসার কথা ভুলেই যায়। যখন মানুষ তা ভুলে যায়, তখন মানুষ এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে, যাতে সেই ভালোবাসা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানুষ হয়তো এই আশঙ্কার কথা বুঝতেই পারে না। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা মানুষকে তাই মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের ফল্গুধারার মতো ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়, সে ভালোবাসার প্রকাশ প্রয়োজন। সে ভালোবাসা লালন করা প্রয়োজন এবং সে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অমর একুশে আমাদের সে প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদার প্রতীক হয়ে অমর একুশে আমাদের সংস্কৃতিকে ও আমাদের জীবনকে নতুন মাত্রা দেয়। এ কারণেই আমাদের সংস্কৃতিতে অমর একুশে একটি অবিস্মরণীয় বাঁকবদল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments