অমর একুশে-ভাঙাগড়ার শহীদ মিনার by আনিসুজ্জামান
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?/ ভয় কী বন্ধু, আমরা এখনো সাড়ে চার কোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো!’ লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ, ভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে দেওয়ার কথা মনে করে। ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের মতো সেই মিনারকেও সেদিন আরেক শহীদ বলে মনে হয়েছিল।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে। সে-হোস্টেল কোনো সুরম্য ভবন ছিল না। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পশ্চিমে মুলিবাঁশের বিশ-বাইশটা ব্যারাক নিয়ে ছিল সে হোস্টেল। তবে একেবারে অপরিসর নয়, ব্যারাকের সামনে বাগান করার মতো জায়গাও ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিচালনার পর এই হোস্টেলই হয়ে ওঠে ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্র। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক নেতারাও তখন কর্মপন্থা সম্পর্কে আলাপ করতে এখানে হাজির হতেন।
তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন গোলাম মওলা এবং সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যে-চারজন পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, গোলাম মওলা ছিলেন তাঁদের একজন। একুশের গুলিচালনার পর শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় কিছু একটা করার কথা হয়তো অনেকের মনে জেগেছিল। তবে ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বদরুল আলমকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে বেশ কয়েকজনের উপস্থিতিতে গোলাম মওলা তাঁকে বলেছিলেন শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করে দিতে। বদরুল আলমকে এ-কথা বলার প্রধান কারণ ছিল, তিনি ভালো আঁকতে পারতেন। বদরুল আলমের এই দক্ষতা পরে পেশাগত জীবনেও তাঁর খুব কাজে এসেছিল।
বদরুল আলম বাল্যকালে কোথাও একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছিলেন। সেটা যে স্মৃতিস্তম্ভ তা বোঝার বয়সও তখন তাঁর হয়নি— বাবাকে জিজ্ঞেস করে তা জানতে পেরেছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিস্তম্ভের যে-ছবিটি তাঁর মনে ছিল, তারই আদলে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি একটা নকশা করে দেন। ওই নকশার বাস্তবায়ন কিছু সময়সাপেক্ষ ভেবে গোলাম মওলা, শরফুদ্দিন আহমদ, সাঈদ হায়দার ও আলীম চৌধুরী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ছাত্র নকশাটি কিছুটা সংশোধন করার পরামর্শ দেন। তখন বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার মিলে আরেকটি নকশা তৈরি করেন। এবারে বদরুল আলমের মনে কাজ করেছিল আন্টাঘর বা ভিক্টোরিয়া পার্কের মিনারের নকশা। দ্বিতীয় নকশাটি সকলের অনুমোদন লাভ করে। মিনারের স্থান নির্মাণ হলো হোস্টেলের সামনে, ১২ নম্বর ব্যারাকের কাছে যেখানে শহীদের প্রথম রক্ত ঝরেছিল।
মেডিক্যাল কলেজে তখন কিছু নির্মাণকাজ চলছিল। সেই কাজটা পেয়েছিলেন মোত্তালেব কনট্রাক্টর ও পিয়ারু সরদার। কলেজ-প্রাঙ্গণে একটা গুদামঘরে নির্মাণসামগ্রী রাখা ছিল। তাঁদের বলতেই ছাত্রদেরকে তাঁরা গুদামঘরের চাবি দিয়ে দেন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে চাবি ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন। এখন এই গুদাম থেকে বালি ও সিমেন্ট এবং গুদামের সামনে থেকে ইট নেওয়ার কাজ শুরু হলো। গুদাম থেকে ছাত্রেরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নির্মাণস্থান পর্যন্ত। একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে হাতে ইট পৌঁছে গেল। স্ট্রেচারে করে নেওয়া হলো বালি আর সিমেন্ট। বালতি করে হাতে হাতেই বয়ে নেওয়া হলো পানি। দুটো রিকশাও লাগানো হলো নির্মাণসামগ্রী বহন করতে। কনট্রাক্টরদের পরোক্ষ সাহায্যে দুজন রাজমিস্ত্রিকেও পাওয়া গেল। তবে কায়িক পরিশ্রম সবটা ছাত্রেরাই করল। বিভিন্নজনের লেখা থেকে নির্মাণকার্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন: আবদুর রশিদ, আবদুস সামাদ, আবদুস সালাম, আবুল হাশিম, আলী আসগর, আলীম চৌধুরী, আশেক, আসাদুজ্জামান, আহমদ রফিক, ইসমাইল, কবির, কাজী আনওয়ারুল হক, কাদের, গোলাম মওলা, জহুরুল হক, জাহেদ, জিয়া, জোকো, তাহের, নওয়াব হোসেন প্রধান, ফজলুল মতিন, ফরিদুল হুদা, বদরুল আলম, মকসুদ, মনজুর হোসেন, মর্তুজা, মামুনুর রশীদ, রাব্বি, শরফুদ্দিন আহমদ, শাহজাহান, সাঈদ হায়দার, সিরাজ জিন্নাত, হাবিবুর রহমান, হুমায়ুন আবদুল হাই।
ভোর হতে না-হতে শহীদ মিনার তৈরি হয়ে গেল। দশ ফুট উঁচু, ছ ফুট চওড়া, সাত ফুট তার ভিত্তি। তিন ভাগ বালি, এক ভাগ সিমেন্ট আর ইট দিয়ে তৈরি মিনার। তখনো কাঁচা, তাই তার চারপাশে দড়ি দিয়ে একটা নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি হয়েছিল। মিনারের গায়ে দুটো পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। মধ্যভাগে লেখা হয়: ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। নিচের দিকে লেখা হয়: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আন্দোলনের তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার আবেদনও জানানো হয়েছিল।
২৩ তারিখে একটু বেলা করে এই মিনারের উদেবাধন করেন ২২ তারিখে নিহত ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী সফিউর রহমানের পিতা এ জি অফিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মাহবুবুর রহমান। কী কারণে জানি না, ২৫ তারিখে আবার এর আনুষ্ঠানিক উদেবাধন হলো। সে-দায়িত্ব পালন করলেন দৈনিক আজাদ - সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তিনি সেইদিনই পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন—মুসলিম লীগের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও।
প্রথমবার উদেবাধনের সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ মিনার দেখতে মানুষের ঢল নামে। মিনারের নিচের দিকে খালি জায়গায় সাদা কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই লোকে টাকা-পয়সা দান করছিল। আমার মা সৈয়দা খাতুনের নির্বন্ধাতিশয্যে আমার আব্বা নিজের গাড়ি ফেলে তার সঙ্গে রিকশায় করে শহীদ মিনারে যান। মা সেখানে একটি সোনার হার দান করে আসে। হারটি ছিল আমার অকালমৃত এক ছোটো বোনের। মা যে সেটা শহীদ মিনারে দিয়ে আসতে যাচ্ছে, তা আব্বাকে আগে বলেনি। মুর্তজা বশীরের একটি কবিতায় ঘটনাটির উল্লেখ করা হয় সর্বপ্রথমে। বশীর জানতেন না যে, যিনি হারটি দিয়েছিলেন, তিনি আমারই মা। তাঁর কবিতা পড়ে আমি তাঁকে এটা জানিয়েছিলাম।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশ, আনসার ও ইপিআরের এবং সম্ভবত সেনাবাহিনীর সদস্যদের দল গাঁইতি-শাবল নিয়ে এসে শহীদ মিনার ভেঙে দেয়। আমরা কেউ কেউ তখন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলাম। যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইমাদুল্লাহ্ রুদ্ধকণ্ঠে চিৎকার করতে থাকেন: ‘ওরা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলছে—কেউ একটা ছবি তুলে রাখো।’ ছবি তোলার মতো কেউ ধারেকাছে ছিলেন বলে আমার মনে পড়ে না। সরকারি বাহিনী মিনার ভেঙে দিয়ে ইট-বালি-সিমেন্ট পর্যন্ত ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যায়। ওই জায়গাটায় চুনের দাগ দিয়ে ঘিরে সেখানে একটা কালো পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রাখা যায়নি। তখনকার মতো শহীদ মিনার অবলুপ্ত হয়ে যায়।
ডা. বদরুল আলম পরে পেশোয়ারে খাইবার মেডিক্যাল কলেজে কাজ পেয়ে চলে যান—১৯৫৭ সালে। এর বছর চারেক পরে স্ত্রী আফজালুন্নেসাকে নিয়ে তিনি বিলেতে উচ্চশিক্ষা নিতে যান। দেশে ফিরে ডা. আলম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে শিশু-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে শহীদ মিনার-নির্মাণে তাঁর ভূমিকার জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন—এ-আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়।
আনিসুজ্জামান: শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক।
তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন গোলাম মওলা এবং সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যে-চারজন পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, গোলাম মওলা ছিলেন তাঁদের একজন। একুশের গুলিচালনার পর শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় কিছু একটা করার কথা হয়তো অনেকের মনে জেগেছিল। তবে ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বদরুল আলমকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে বেশ কয়েকজনের উপস্থিতিতে গোলাম মওলা তাঁকে বলেছিলেন শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করে দিতে। বদরুল আলমকে এ-কথা বলার প্রধান কারণ ছিল, তিনি ভালো আঁকতে পারতেন। বদরুল আলমের এই দক্ষতা পরে পেশাগত জীবনেও তাঁর খুব কাজে এসেছিল।
বদরুল আলম বাল্যকালে কোথাও একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছিলেন। সেটা যে স্মৃতিস্তম্ভ তা বোঝার বয়সও তখন তাঁর হয়নি— বাবাকে জিজ্ঞেস করে তা জানতে পেরেছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিস্তম্ভের যে-ছবিটি তাঁর মনে ছিল, তারই আদলে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি একটা নকশা করে দেন। ওই নকশার বাস্তবায়ন কিছু সময়সাপেক্ষ ভেবে গোলাম মওলা, শরফুদ্দিন আহমদ, সাঈদ হায়দার ও আলীম চৌধুরী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ছাত্র নকশাটি কিছুটা সংশোধন করার পরামর্শ দেন। তখন বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার মিলে আরেকটি নকশা তৈরি করেন। এবারে বদরুল আলমের মনে কাজ করেছিল আন্টাঘর বা ভিক্টোরিয়া পার্কের মিনারের নকশা। দ্বিতীয় নকশাটি সকলের অনুমোদন লাভ করে। মিনারের স্থান নির্মাণ হলো হোস্টেলের সামনে, ১২ নম্বর ব্যারাকের কাছে যেখানে শহীদের প্রথম রক্ত ঝরেছিল।
মেডিক্যাল কলেজে তখন কিছু নির্মাণকাজ চলছিল। সেই কাজটা পেয়েছিলেন মোত্তালেব কনট্রাক্টর ও পিয়ারু সরদার। কলেজ-প্রাঙ্গণে একটা গুদামঘরে নির্মাণসামগ্রী রাখা ছিল। তাঁদের বলতেই ছাত্রদেরকে তাঁরা গুদামঘরের চাবি দিয়ে দেন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে চাবি ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন। এখন এই গুদাম থেকে বালি ও সিমেন্ট এবং গুদামের সামনে থেকে ইট নেওয়ার কাজ শুরু হলো। গুদাম থেকে ছাত্রেরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নির্মাণস্থান পর্যন্ত। একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে হাতে ইট পৌঁছে গেল। স্ট্রেচারে করে নেওয়া হলো বালি আর সিমেন্ট। বালতি করে হাতে হাতেই বয়ে নেওয়া হলো পানি। দুটো রিকশাও লাগানো হলো নির্মাণসামগ্রী বহন করতে। কনট্রাক্টরদের পরোক্ষ সাহায্যে দুজন রাজমিস্ত্রিকেও পাওয়া গেল। তবে কায়িক পরিশ্রম সবটা ছাত্রেরাই করল। বিভিন্নজনের লেখা থেকে নির্মাণকার্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন: আবদুর রশিদ, আবদুস সামাদ, আবদুস সালাম, আবুল হাশিম, আলী আসগর, আলীম চৌধুরী, আশেক, আসাদুজ্জামান, আহমদ রফিক, ইসমাইল, কবির, কাজী আনওয়ারুল হক, কাদের, গোলাম মওলা, জহুরুল হক, জাহেদ, জিয়া, জোকো, তাহের, নওয়াব হোসেন প্রধান, ফজলুল মতিন, ফরিদুল হুদা, বদরুল আলম, মকসুদ, মনজুর হোসেন, মর্তুজা, মামুনুর রশীদ, রাব্বি, শরফুদ্দিন আহমদ, শাহজাহান, সাঈদ হায়দার, সিরাজ জিন্নাত, হাবিবুর রহমান, হুমায়ুন আবদুল হাই।
ভোর হতে না-হতে শহীদ মিনার তৈরি হয়ে গেল। দশ ফুট উঁচু, ছ ফুট চওড়া, সাত ফুট তার ভিত্তি। তিন ভাগ বালি, এক ভাগ সিমেন্ট আর ইট দিয়ে তৈরি মিনার। তখনো কাঁচা, তাই তার চারপাশে দড়ি দিয়ে একটা নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি হয়েছিল। মিনারের গায়ে দুটো পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। মধ্যভাগে লেখা হয়: ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। নিচের দিকে লেখা হয়: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আন্দোলনের তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার আবেদনও জানানো হয়েছিল।
২৩ তারিখে একটু বেলা করে এই মিনারের উদেবাধন করেন ২২ তারিখে নিহত ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী সফিউর রহমানের পিতা এ জি অফিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মাহবুবুর রহমান। কী কারণে জানি না, ২৫ তারিখে আবার এর আনুষ্ঠানিক উদেবাধন হলো। সে-দায়িত্ব পালন করলেন দৈনিক আজাদ - সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তিনি সেইদিনই পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন—মুসলিম লীগের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও।
প্রথমবার উদেবাধনের সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ মিনার দেখতে মানুষের ঢল নামে। মিনারের নিচের দিকে খালি জায়গায় সাদা কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই লোকে টাকা-পয়সা দান করছিল। আমার মা সৈয়দা খাতুনের নির্বন্ধাতিশয্যে আমার আব্বা নিজের গাড়ি ফেলে তার সঙ্গে রিকশায় করে শহীদ মিনারে যান। মা সেখানে একটি সোনার হার দান করে আসে। হারটি ছিল আমার অকালমৃত এক ছোটো বোনের। মা যে সেটা শহীদ মিনারে দিয়ে আসতে যাচ্ছে, তা আব্বাকে আগে বলেনি। মুর্তজা বশীরের একটি কবিতায় ঘটনাটির উল্লেখ করা হয় সর্বপ্রথমে। বশীর জানতেন না যে, যিনি হারটি দিয়েছিলেন, তিনি আমারই মা। তাঁর কবিতা পড়ে আমি তাঁকে এটা জানিয়েছিলাম।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশ, আনসার ও ইপিআরের এবং সম্ভবত সেনাবাহিনীর সদস্যদের দল গাঁইতি-শাবল নিয়ে এসে শহীদ মিনার ভেঙে দেয়। আমরা কেউ কেউ তখন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলাম। যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইমাদুল্লাহ্ রুদ্ধকণ্ঠে চিৎকার করতে থাকেন: ‘ওরা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলছে—কেউ একটা ছবি তুলে রাখো।’ ছবি তোলার মতো কেউ ধারেকাছে ছিলেন বলে আমার মনে পড়ে না। সরকারি বাহিনী মিনার ভেঙে দিয়ে ইট-বালি-সিমেন্ট পর্যন্ত ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যায়। ওই জায়গাটায় চুনের দাগ দিয়ে ঘিরে সেখানে একটা কালো পতাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রাখা যায়নি। তখনকার মতো শহীদ মিনার অবলুপ্ত হয়ে যায়।
ডা. বদরুল আলম পরে পেশোয়ারে খাইবার মেডিক্যাল কলেজে কাজ পেয়ে চলে যান—১৯৫৭ সালে। এর বছর চারেক পরে স্ত্রী আফজালুন্নেসাকে নিয়ে তিনি বিলেতে উচ্চশিক্ষা নিতে যান। দেশে ফিরে ডা. আলম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে শিশু-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে শহীদ মিনার-নির্মাণে তাঁর ভূমিকার জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন—এ-আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়।
আনিসুজ্জামান: শিক্ষাবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক।
No comments