ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর by রফিকুল ইসলাম
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি, মোট ষাট বছর। এই ছয় দশকে একুশ থেকে আমরা কী চেয়েছি আর কী পেয়েছি? ১৯৫২ সালে আমরা চেয়েছিলাম পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। এই দাবির অপরাধে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছিল।
কিন্তু সে রক্ত বৃথা যায়নি। কারণ সেই রক্ত থেকেই আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের বিস্তৃত জাতিসত্তাকে। যা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম দীর্ঘ পরাধীনতার কারণে। এ সময় বাংলা ও বাঙালি তার আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছিল। কারণ সে যুগ যুগ ধরে বিদেশি শাসকদের দ্বারা বিদেশি ভাষায় শাসিত হয়েছিল।
মধ্য যুগের আদি পর্বে বাংলাদেশের শাসক ছিল দক্ষিণ ভারতীয় কর্নাটক, সেন রাজ বংশ। তারা এ দেশ শাসন করত সংস্কৃত ভাষা দ্বারা। এরপর মধ্য যুগে সমগ্র মুসলিম আমলজুড়ে তুর্কি, পাঠান এবং মুঘল আমলের সুবে বাংলার দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি। আধুনিক যুগে এসে ইংরেজি আমলজুড়ে দু'শ বছর আমরা শাসিত হয়েছি ইংরেজি ভাষায়। পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষা কখনও রাষ্ট্রীয় বা সরকারি আনুকূল্য পায়নি। যদিও প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আর মধ্য যুগজুড়ে বাঙালি হিন্দু মুসলমান সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষায়, বাংলা বর্ণমালায় বাংলা সাহিত্য রচনা করে গেছেন। এ কারণে তাদের বারবার লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। যে সব হিন্দু সাহিত্যিক দেবদেবীদের কথা সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগ্রী হরফে না লিখে বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে রচনা করতেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাদের স্থান নির্দেশ করেছিলেন রৌরব নরকে। সে জন্য মধ্যযুগের শেষ পাদের প্রধান কবি ভারতচন্দ্রকে 'যাবনিমিশাল' ভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য কৈফিয়ত দিয়ে বলতে হয়েছিল_
'রবে না প্রসাদ গুণ না হবে রসাল
তাই রচি ভাষা যাবনিমিশাল
যে হোক সে হোক ভাষা কাব্য রস লয়ে'
অপরদিকে যে সব মুসলমান সাহিত্যিক বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে আল্লাহ, রাসূল ও নামাজ রোজার কথা নিয়ে সাহিত্য রচনা করতেন; কাঠমোল্লারা তাদের স্থান হাবিয়া দোজখে নির্ধারণ করে ফতোয়া দিতেন।
সে জন্যই ১৭ শতকের কবি আবদুল হাকিম অত্যন্ত ক্ষুব্দ হয়ে লিখেছিলেন_
'যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।'
মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে বিশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। সে জন্য পত্রপত্রিকায় বির্তক হতো, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু। শেষ পর্যন্ত নওয়াব আবদুল লতিফ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, 'আশরাফ' বা উচ্চ শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু আর 'আতরাফ' বা নিম্ন শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। বলাবাহুল্য যে এই আতরাফের সন্তানরাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর আশরাফের সন্তানরা সাংস্কৃতিক রাজাকার রূপে উর্দুর পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। বাঙালি যে একটি ঐতিহ্যবাহী জাতি, এ জাতির যে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে সে কথা একুশ থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম। আর সে জন্যই '৫২-র একুশের রক্ত '৬২, '৬৬, '৬৯ এবং '৭১-এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাঙালিকে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি না হলে '৭১-র মুক্তিযুদ্ধ হতো কি-না সন্দেহ। আমরা যদি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন না করতাম, আমরা যদি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করতাম তাহলে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতো। পূর্ববাংলা এমনিতে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। তদুপরি যদি আমরা আমাদের জাতি সত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি বিসর্জন দিতাম তাহলে আমরা পাকিস্তানের গোলামে পরিণত হতাম। অবিভক্ত ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তানেও আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ পাকিস্তানের প্রথম পঁচিশ বছরের ইতিহাসে সেই বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিতে এমন কোনো কূটকৌশল ছিল না যে তারা প্রয়োগ করেনি। কিন্তু ১৯৫২-র একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি একের পর এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২১ থেকে '৭১-এর মধ্যে তার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অধিকারকে রক্ষা করে গেছে। সে জন্যই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলায় বাঙালি 'অ্যাথনিক ক্লিনজিং' বা গণহত্যা শুরু করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নির্মূল করা, বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করা। আর সে জন্যই বাঙালিকে '৭১-এ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। অন্যথায় বাঙালি জাতীর নাম-নিশানা মুছে যেত।
বাঙালির এই মুক্তি সংগ্রাম এ দেশীয় যে সব বাংলাভাষী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোসর ছিল তাদের মধ্যে কিছু সাংস্কৃতিক রাজাকার ছিল, যারা ১৯৭১ সালে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে '৭১-র মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক রাজাকাররা নেই। এই সাংস্কৃতিক রাজাকাররা ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা মেজর জেনারেল রাওফরমান আলীর কাছে পেশ করেছিলেন। এবং আল বদরবাহিনী দ্বারা বাঙালি নিধনযজ্ঞ চলেছিল। কিন্তু এসব সাংস্কৃতিক রাজাকাররা বর্তমানে বর্ণচোরা দেশপ্রেমিক। বস্তুতপক্ষে এসব বর্ণচোরা দেশপ্রেমিক সেজে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেশবাসীকে ধর্মের সবক দিচ্ছেন। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
গত ষাট বছরে একুশ থেকে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি। তারও আগে পেয়েছিলাম ২১ দফা, বাংলা একাডেমী, শহীদ দিবস এবং মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব ও অহঙ্কার। কিন্তু গত ষাট বা চলি্লশ বছরেও আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনে সর্বাবস্থায় বাংলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি। উচ্চ আদালতে এখনও বাংলা ভাষার অবস্থান হয়নি। বিভিন্ন বেসরকারি ইংরেজি ও আরবি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা ঢুকতে পারছে না। মনে হয় যেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্যে। অন্যথায় এটা কি বিশ্বাস্য যে, বাংলাদেশে গত বিশ বছরে স্থাপিত ৫০টিরও অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় ৫০টিতেই বাংলা ভাষা পঠন-পাঠনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একুশ শতকের বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাংলা ও ইংরেজি নামফলক বর্তমানে রোমান হরফে লিখিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র প্রায়শ বিদেশি ভাষায় রচিত। বাংলাদেশের ভেতরে যখন এই অবস্থা, তখন বিশ্বায়নের পটভূমিকায় 'আন্তর্জাতিক ভাষার সাম্রাজ্যবাদ' বিশ্বের বিভিন্ন ছোট-বড় দেশে অসংখ্য ভাষাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আমরাও সেই ধ্বংসের শিকার। তদুপরি আমরা নিজেরাই সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকে বিকৃত এবং স্থূল করে ফেলেছি। টেলিভিশন সিরিয়ালে, এফএম রেডিওতে, মোবাইলের এসএমএসে, ইন্টারনেটে, ফেসবুকে; বাংলাকে বিদেশি হরফে বা বিদেশি ভাষার মিশ্রণে ব্যবহারের মাধ্যমে আমারা নিজেরাই আমাদের মাতৃভাষাকে ধ্বংস করছি। ফলে একুশের ষাট বছর পর আবার একটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
†jLK : cÖvewíãK
wk¶vwe`
মধ্য যুগের আদি পর্বে বাংলাদেশের শাসক ছিল দক্ষিণ ভারতীয় কর্নাটক, সেন রাজ বংশ। তারা এ দেশ শাসন করত সংস্কৃত ভাষা দ্বারা। এরপর মধ্য যুগে সমগ্র মুসলিম আমলজুড়ে তুর্কি, পাঠান এবং মুঘল আমলের সুবে বাংলার দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি। আধুনিক যুগে এসে ইংরেজি আমলজুড়ে দু'শ বছর আমরা শাসিত হয়েছি ইংরেজি ভাষায়। পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষা কখনও রাষ্ট্রীয় বা সরকারি আনুকূল্য পায়নি। যদিও প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আর মধ্য যুগজুড়ে বাঙালি হিন্দু মুসলমান সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষায়, বাংলা বর্ণমালায় বাংলা সাহিত্য রচনা করে গেছেন। এ কারণে তাদের বারবার লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। যে সব হিন্দু সাহিত্যিক দেবদেবীদের কথা সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগ্রী হরফে না লিখে বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে রচনা করতেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাদের স্থান নির্দেশ করেছিলেন রৌরব নরকে। সে জন্য মধ্যযুগের শেষ পাদের প্রধান কবি ভারতচন্দ্রকে 'যাবনিমিশাল' ভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য কৈফিয়ত দিয়ে বলতে হয়েছিল_
'রবে না প্রসাদ গুণ না হবে রসাল
তাই রচি ভাষা যাবনিমিশাল
যে হোক সে হোক ভাষা কাব্য রস লয়ে'
অপরদিকে যে সব মুসলমান সাহিত্যিক বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে আল্লাহ, রাসূল ও নামাজ রোজার কথা নিয়ে সাহিত্য রচনা করতেন; কাঠমোল্লারা তাদের স্থান হাবিয়া দোজখে নির্ধারণ করে ফতোয়া দিতেন।
সে জন্যই ১৭ শতকের কবি আবদুল হাকিম অত্যন্ত ক্ষুব্দ হয়ে লিখেছিলেন_
'যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।'
মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে বিশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। সে জন্য পত্রপত্রিকায় বির্তক হতো, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু। শেষ পর্যন্ত নওয়াব আবদুল লতিফ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, 'আশরাফ' বা উচ্চ শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু আর 'আতরাফ' বা নিম্ন শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। বলাবাহুল্য যে এই আতরাফের সন্তানরাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর আশরাফের সন্তানরা সাংস্কৃতিক রাজাকার রূপে উর্দুর পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। বাঙালি যে একটি ঐতিহ্যবাহী জাতি, এ জাতির যে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে সে কথা একুশ থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম। আর সে জন্যই '৫২-র একুশের রক্ত '৬২, '৬৬, '৬৯ এবং '৭১-এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাঙালিকে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি না হলে '৭১-র মুক্তিযুদ্ধ হতো কি-না সন্দেহ। আমরা যদি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন না করতাম, আমরা যদি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করতাম তাহলে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতো। পূর্ববাংলা এমনিতে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। তদুপরি যদি আমরা আমাদের জাতি সত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি বিসর্জন দিতাম তাহলে আমরা পাকিস্তানের গোলামে পরিণত হতাম। অবিভক্ত ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তানেও আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ পাকিস্তানের প্রথম পঁচিশ বছরের ইতিহাসে সেই বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিতে এমন কোনো কূটকৌশল ছিল না যে তারা প্রয়োগ করেনি। কিন্তু ১৯৫২-র একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি একের পর এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২১ থেকে '৭১-এর মধ্যে তার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অধিকারকে রক্ষা করে গেছে। সে জন্যই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলায় বাঙালি 'অ্যাথনিক ক্লিনজিং' বা গণহত্যা শুরু করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নির্মূল করা, বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করা। আর সে জন্যই বাঙালিকে '৭১-এ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। অন্যথায় বাঙালি জাতীর নাম-নিশানা মুছে যেত।
বাঙালির এই মুক্তি সংগ্রাম এ দেশীয় যে সব বাংলাভাষী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোসর ছিল তাদের মধ্যে কিছু সাংস্কৃতিক রাজাকার ছিল, যারা ১৯৭১ সালে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে '৭১-র মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক রাজাকাররা নেই। এই সাংস্কৃতিক রাজাকাররা ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা মেজর জেনারেল রাওফরমান আলীর কাছে পেশ করেছিলেন। এবং আল বদরবাহিনী দ্বারা বাঙালি নিধনযজ্ঞ চলেছিল। কিন্তু এসব সাংস্কৃতিক রাজাকাররা বর্তমানে বর্ণচোরা দেশপ্রেমিক। বস্তুতপক্ষে এসব বর্ণচোরা দেশপ্রেমিক সেজে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেশবাসীকে ধর্মের সবক দিচ্ছেন। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
গত ষাট বছরে একুশ থেকে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি। তারও আগে পেয়েছিলাম ২১ দফা, বাংলা একাডেমী, শহীদ দিবস এবং মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব ও অহঙ্কার। কিন্তু গত ষাট বা চলি্লশ বছরেও আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনে সর্বাবস্থায় বাংলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি। উচ্চ আদালতে এখনও বাংলা ভাষার অবস্থান হয়নি। বিভিন্ন বেসরকারি ইংরেজি ও আরবি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা ঢুকতে পারছে না। মনে হয় যেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্যে। অন্যথায় এটা কি বিশ্বাস্য যে, বাংলাদেশে গত বিশ বছরে স্থাপিত ৫০টিরও অধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় ৫০টিতেই বাংলা ভাষা পঠন-পাঠনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একুশ শতকের বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাংলা ও ইংরেজি নামফলক বর্তমানে রোমান হরফে লিখিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র প্রায়শ বিদেশি ভাষায় রচিত। বাংলাদেশের ভেতরে যখন এই অবস্থা, তখন বিশ্বায়নের পটভূমিকায় 'আন্তর্জাতিক ভাষার সাম্রাজ্যবাদ' বিশ্বের বিভিন্ন ছোট-বড় দেশে অসংখ্য ভাষাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আমরাও সেই ধ্বংসের শিকার। তদুপরি আমরা নিজেরাই সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকে বিকৃত এবং স্থূল করে ফেলেছি। টেলিভিশন সিরিয়ালে, এফএম রেডিওতে, মোবাইলের এসএমএসে, ইন্টারনেটে, ফেসবুকে; বাংলাকে বিদেশি হরফে বা বিদেশি ভাষার মিশ্রণে ব্যবহারের মাধ্যমে আমারা নিজেরাই আমাদের মাতৃভাষাকে ধ্বংস করছি। ফলে একুশের ষাট বছর পর আবার একটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
†jLK : cÖvewíãK
wk¶vwe`
No comments