অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফয়েজ ভাই by কামাল লোহানী

আমার সঙ্গে ফয়েজ ভাইয়ের রাজনৈতিক সখ্য এবং মন-মানসিকতার এক অভূতপূর্ব ঐক্য ছিল বলে বাস্তবে, বিশেষ করে সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমার অগ্রজ। যখন যা করতাম, তাকে না শুধিয়ে কিছুই করতাম না। তারপর তার প্রতিভাদৃপ্ত এ অকৃতদার জীবনে ফয়েজ ভাই কত যে সাহসী কাজ করেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তার কোনো হিসাব করে শেষ করা যাবে না। ফয়েজ ভাই প্রচণ্ড সাহসের মানুষ ছিলেন।


সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদেরও আগে থেকে, সে প্রায় ৬০ বছর হবে। কিন্তু তারও আগে থেকে তিনি ছড়াকার হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। ফয়েজ ভাই অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন। ছিলেন বন্ধুবৎসলও। পরোপকারী একটা আকর্ষণীয় চরিত্র ছিল তার। তা ছাড়া অসম সাহসী মন ছিল তার, অকপটে সত্য কথা বলতে কখনও দ্বিধা করতে তাকে দেখিনি। দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব, সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিঃশঙ্ক মন নিয়ে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছেন।
ফয়েজ আহ্মদ এমনই এক মানুষ ছিলেন, যিনি কোনোদিন কোনো বিষয়েই আপস করেননি। দ্বিধাহীন চিত্তে মত প্রকাশ করতেন, কারও তোয়াক্কা না করে। সে কারণেই বোধহয় আমার কাছে ভালো লাগত তাকে। কেবল যে আমার কাছে, তাই নয়, অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন অনন্য সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, উদ্যোগী এক মহান চরিত্র। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জনগণের স্বার্থে। প্রগতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সব আন্দোলনে লেখা ও মননে সম্পৃক্ত থাকতেন।
সাংবাদিকতায় তিনি একজন রিপোর্টার হিসেবে ঢুকেছিলেন। সে সময় তো অনেক খবরের কাগজ ছিল না। তবু ইনসাফ, সংবাদ, ইত্তেফাক আর অবজারভার পত্রিকায় কাজ করেছেন। চিফ রিপোর্টার ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশে। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগমুহূর্তে পূর্বদেশ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মতবিরোধের কারণে। তখনই প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক 'স্বরাজ'। প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনেরই যেন মুখপত্র হয়ে উঠল পত্রিকাটি। 'স্বরাজ' প্রকাশ এক অভিনব অভিজ্ঞতাই বটে।
তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমি তখনও পূর্বদেশে। বাস্তুহারা সংসারবিহীন জীবন ছিল বহুদিন। সাংবাদিকতা জীবনের প্রথম দিকে ফয়েজ ভাই থাকতেন রথখোলা মোড়ে নবাবপুর রোডে হোটেল ডিকেন্সের এক কামরায়। সেখান থেকে অনেক পরে ভাই রফিকের পরিবারকে নিয়ে তার সংসারের পত্তন করেছিলেন। ওই বাচ্চারাই যেন তার পিতার সাধ পূরণে সহায়ক হয়েছিল। তাই অভিভাবকত্বের দায়িত্ববোধ তাকে বিবেকসম্পন্ন করেছিল সাংসারিকতার গণ্ডির ভেতরেও।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যখন শুরু হলো কলকাতা থেকে, তখন তিনি যুক্ত হলেন লেখক হিসেবে। অভূতপূর্ব রচনাশৈলীর মাধুর্যে সৃষ্টি হলো 'পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে' নামে সিরিজ। তিনি তার সহকর্মীদের সব কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। স্বাধীনতার পর মওলানা ভাসানীর সমর্থক শিল্পপতি-ব্যবসায়ী গোলাম কবীরের অর্থায়নে প্রকাশিত হয়েছিল 'দৈনিক বঙ্গবার্তা'। তার সম্পাদক হলেন তিনি আর আমি বার্তা সম্পাদক। কী প্রবল সৃজনশীলতা, অথচ টিকল না বেশিদিন। ফয়েজ আহ্মদই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পত্রিকায় চলচ্চিত্রের কোনো অশ্লীল বিজ্ঞাপন ছাপতে দিতেন না কিংবা প্রকৃতির উদ্ভট কাণ্ড অথবা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা ইত্যাদি কোনো সংবাদ, এমনকি বিজ্ঞাপনও ছাপতে বারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে ফয়েজ আহ্মদ মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের সংগ্রামে সোচ্চার ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করে 'পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' নামে প্রগতিশীল লেখক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
এ মানুষটি সাংবাদিকতা থেকে ছড়া কিংবা কাগজের সংবাদ, যা কিছু লিখতেন, সবই ছিল মানুষের কল্যাণে।
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.