মাতৃভাষার অধিকার থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বঞ্চিত by নাজমুল ইসলাম
আমরা বাংলাদেশি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। অন্য জাতি-গোষ্ঠীর মতো মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাও অকৃত্রিম। গত শতাব্দীর যে অর্জনগুলো নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তার একটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। যেই আন্দোলনে রফিক, বরকতদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ।
আমরা পেয়েছিলাম মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিল এক নব দিগন্ত।
ভাষা শহীদদের চরম আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে UNIESCO একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। UNIESCO-ভুক্ত ১৮৮টি দেশ একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্মিত শহীদ মিনারগুলো নীরবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তারা শহীদদের কথা। বিশ্বের অনেক দেশে ডাক টিকিটে শহীদ মিনারের ছবি দিচ্ছে। সিয়েরা লিওন, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেক দেশ বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। এককথায় ভাষাশহীদদের কল্যাণে একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষা আজ বিশ্ব দরবারে পরিচিত।
বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও আজ বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীনসহ আরো বহু লেখকের বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যন্য অর্জন 'গীতাঞ্জলির' নোবেল বিজয় বাংলাকে আরো উঁচুতে তুলে ধরেছে। সারা বিশ্বে একুশ উদ্যাপন, বিভিন্ন দেশে বাংলার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা, বাংলা সাহিত্যের নোবেল প্রাপ্তি_এর সবই বাংলা ভাষার গৌরবমাখা ইতিহাস।
প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণ করে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার নিয়ে। মাতৃভাষার বর্ণমালা শেখার অধিকারও তাই জন্মগত। কিন্তু সেই অধিকার থেকে এ দেশের ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী সম্পূর্ণ বঞ্চিত। চাকমা, খাসিয়ার মতো ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যালয় যায় তার অ, আ, ক, খ শেখে। তাদের নিজ মাতৃভাষা নয়। ফলে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা আজ মৃতপ্রায়। একুশ মানে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা।
মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সরকারের উচিত ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়া।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা জানার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। শিক্ষার্থীরাও কর্মের তাগিদে বাংলার চেয়ে বিদেশি ভাষা শিখতে বেশি আগ্রহী হয়। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিদেশি ভাষাচর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। অথচ বাংলা ভাষা চর্চাকেন্দ্র নেই বললেই চলে। বাংলা ভাষার অতীত ইতিহাসও তাই বেশির ভাগ বাংলা ভাষাভাষীই জানে না। শুদ্ধ বাংলা বলতে পারে এমন লোক খুবই কম।
বাংলা ভাষা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধকরণে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা বাংলা একাডেমীর। সাবেক বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠিত এই একাডেমীর জন্ম ১৯৫৫ সালে। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত বইগুলোকেই এ দেশের মানুষ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভুল মনে করে। 'ভুলেভরা বাংলা একাডেমী অভিধান' সম্ভবত এই শিরোনামেই একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রতিবেদন করেছিল। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেই ভুলগুলো না শুধরিয়েই একাডেমী কর্তৃপক্ষ তা বাজারজাত করছে। অনেক সময়ই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা বাংলা একাডেমীর নাম নিয়েও বিতর্ক করেন। তাঁদের দাবি, বাংলা একাডেমীর নামকরণও সম্পূর্ণ বাংলায় করা হোক।
আমাদের চলচ্চিত্রেও বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করা হয় না। অনেক সময়ই নায়ক-নায়িকাদের মুখে ইংরেজির ফুলঝুরি দেখা যায়। যা দেখে প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে সরব হয়ে ওঠে। ভাবখানা এমন যেন, ইংরেজি বলতে পারার মধ্যেই আভিজাত্য। অথচ চলচ্চিত্র হতে পারত বাংলা ভাষা শুিদ্ধভাবে শেখার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য সংরক্ষণে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থান প্রশংসনীয়। পত্রপত্রিকাগুলো প্রতিনিয়তই বাংলাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলা সাহিত্য সংরক্ষণে তারা বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করছে।
বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণে সরকারের ভূমিকা আবশ্যক। সরকারের উচিত, সাংবিধানিকভাবে ভাষানীতি প্রণয়ন করা। যার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বাংলা শেখা সব বাঙালির জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাংলা সাহিত্য শেখাবে। দেশের সর্বত্র বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। অন্যান্য ভাষায় রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞান এ দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা যদি যথাযথভাবে বাংলার ব্যবহার করি, তবেই ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হবে। কাক হয়ে ময়ূরের নাচ না নেচে নিজস্ব সংস্কৃতিও ঐতিহ্য লালন করলেই মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। তবেই আমরা ময়ূর হতে পারব। কারণ আমাদের যে গৌরবময় ঐতিহ্য আছে, তা আর কোনো ভাষার নেই।
No comments