একুশের প্রদীপে বাংলা ভাষা চিরপ্রজ্বলিত অগ্নিশিখা by মেহেরুন্নেছা মৌরী
শ্যামল কোমল প্রকৃতির নীড়ে যখন ফাগুন তার আগুন লাগা রঙে কৃষ্ণচূড়া আর পলাশের শাখা রাঙিয়ে তোলে, ফুলের সৌরভ যখন তার অব্যক্ত মূর্ছনায় মাতিয়ে তোলে চারদিক, তখন সেই মূর্ছনাই যেন হয়ে ওঠে মানব হৃদয়ের না-বলা ভাষা। সে ভাষাপ্রেমিকের কাছে হয়ে ওঠে অধরা ভালোবাসা, কবি হৃদয়ে ছোঁয়া দেয় নতুন কবিতার ছন্দের, শিল্পী মনে এনে দেয় স্বপ্নের তুলির আকর, বলহীন হৃদয়ের জোয়ারে এনে দেয় অসীম সাহস।
আর তখনই এই ফাগুনের লোহিতবর্ণ পুষ্পশোভা বঙ্গ জননীর প্রেমময় সন্তানের চোখে হয়ে ওঠে অহংকারের একুশ। একুশ মানেই তো আমার মা ডাকার অধিকার। এই একুশই আমাকে দিয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগে লেখা প্রাণের বর্ণমালা। একুশ মানেই অ আ ক খ। ছোট শিশুটি যখন তোতলানো মুখে হাতেখড়ি দেয় মাতৃভাষায়, মায়ের মুখের স্নিগ্ধ প্রশান্তির হাসি তখন মনে করিয়ে দেয় বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি পিচঢালা কালো পথ যখন কৃষ্ণচূড়ার তলে বুকের শাণিত ধারায় রঞ্জিত হয়েছিল, সেই দিনই বাঙালির হৃদয়পটে অঙ্কিত হয়েছিল চিরগৌরবের মাতৃভাষা বাংলার বর্ণমালা। ফেব্রুয়ারির একুশই তো আমার প্রাণের ধন, রত্নের আকর বাংলা ভাষা। এই তারিখটি এসেছিল বলেই আজকে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে গৌরবগাথা লিখতে পারি।
এ বিশ্বের বুকে যত ভাষা আছে তার মধ্যে বাংলাই একমাত্র ভাষা, যাকে রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে গৌরবের স্থান। আজ বাংলা ভাষা আর একুশে ফেব্রুয়ারি এক হয়ে শুধু আমাদের নিজস্ব সম্পদ হয়েই থাকেনি, বরং তা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা। যে ভাষার জন্য রফিক, সালাম, বরকত ও শফিউরের বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়েছে বাংলার আকাশ, আজ সেই ভাষা আমার ঐতিহ্য।
একুশের দুপুরে তপ্ত তপনের মাঝে লোহিতবর্ণ পথে যে ভাষা বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল হয়েছিল, আমাদের সেই বাংলা ভাষার রয়েছে সুদীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য, রয়েছে সমৃদ্ধ সাহিত্য ভাণ্ডার। সে ইতিহাস আর সাহিত্যিক মূল্যের বিশ্লেষণ আমাদের করতে পারে আরো এক সারি সামনের কাতারের জাতি। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনো পূর্ণতা আসেনি। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ভাষাকে বাংলা প্রমাণ করে ঐতিহ্যের যে ধারা তৈরি করছিলেন, তা আজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলা একাডেমী বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করলেও সর্বস্তরে মাতৃভাষার উন্নয়ন সাধিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সাহিত্যে বাংলা ভাষাকে যে স্থানে উন্নীত করেছিলেন, সে ধারায়ও এসেছে বিভিন্ন পরিবর্তন। তাই আমাদের ভাষাকে শুদ্ধ ও প্রমিতরূপে সর্বস্তরে সংরক্ষণত করার জন্য ভাষা গবেষণা আধুনিকতর করে তোলা এখন সময়ের দাবি।
যে ভাষায় বিদ্রোহী নজরুল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, রূপসী বাংলার জীবনানন্দ এনেছিলেন প্রশস্তি ও জয়গান, আজ সেই ভাষারই যথেচ্ছ ব্যবহার যখন দেখি, তখন লাখো-কোটি রক্তবিন্দুর বিনিময়ে কেনা এই ভাষার মূল্যায়নে আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে তর্ক ওঠে। এ প্রজন্ম যখন অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করে আর বাংলা শব্দের যথার্থ ব্যবহারের প্রতি উদসীনতা দেখায়, তখন তা সত্যিই পীড়াদায়ক হয়। প্রত্নবাংলা থেকে বাংলা অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে বর্তমান চলিত প্রমিত বাংলায় এসে পেঁৗছেছে। ভাষাতাত্তি্বকরা তাঁদের ঘামঝরা পরিশ্রমের বদৌলতে যে ভাষাকে দিয়েছেন আধুনিক রূপ, সেই ভাষা আজ শুধুই এ প্রজন্মের তথাকথিত আধুনিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হারাচ্ছে স্বকীয়তা। এ প্রজন্মের হাই-হ্যালো ভাষা যেন ঠোঁটের আগায় প্রাণহীন লিপস্টিক। অথচ এ প্রজন্মের সচেতনতা আর সদিচ্ছা আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষাকে সব অসংগতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একই সঙ্গে সরকার ও গণমাধ্যমের প্রখর দূরদৃষ্টিরও প্রয়োজন সমানভাবে। শিক্ষানীতিতে ভাষার ব্যাকরণকে অধিক গুরুত্বদান, বাংলা পাঠদানের ওপর জোরদান, বাংলা বইয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটানো, বাংলা শিল্প ও সাহিত্যকে আধুনিক পাঠকের উপযোগী করা, ভাষার উন্নয়ন, গবেষণার জন্য অতিরিক্ত তহবিল গঠনের মতো যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ এ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারে। মায়ের চোখের জল আর ভাইয়ের রক্তে যে ভাষা আজ আমাদের হয়ে উঠেছে, তা আমাদেরই ধরে রাখতে হবে। প্রতিটি গণমাধ্যমকে সে জন্য হতে হবে ভাষা আগলে ধরার একেকটি হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যারা এ বাংলারই সন্তান, যাদের মাতৃভাষা হয়তো হুবহু বাংলা নয়, তাদের কথাও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ আমরা তো মায়ের মুুখে শেখা বুলির জন্যই বক্ষবিদীর্ণ শোণিতধারা প্রবাহিত করেছি। মাতৃভাষার জন্যই তো এ রক্তাক্ত নদী পার হওয়া। আর এসব জাতি, যাদের আমরা উপজাতি বলি, তাদের মায়ের মুখের বুলিও তো তাদের প্রিয় মাতৃভাষা। তাই বাংলা মায়ের সেই সন্তানদের প্রতিও আমাদের সমান শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হবে।
হীরার ঔজ্জ্বল্য যেমন বোঝা যায় কাচের সংস্পর্শে এলে, তেমনি ভাষাও তার মাহাত্ম্য খুঁজে পায় অন্য ভাষার সংস্পর্শে এলে। তাই বলে মাতৃভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ কখনোই উৎকর্ষ বাড়াতে পারে না। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বায়নের প্রভাবে আজ আমাদের ভাষাও অনেক ভাষার সংস্পর্শ পেয়েছে। কিন্তু অতিমাত্রায় বিদেশি ভাষার চর্চা এবং তার ব্যবহার আমাদের ভাষাকে ম্লান করে দিতে চাইছে। আমাদের উচিত বিদেশি ভাষার যথোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা, কিন্তু বিকিয়ে দেওয়া নয়। বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা। তার পরও এ ভাষার নিজস্বতা রক্ষা করতে হলে এই প্রজন্মকে আড়মোড়া দিয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি পলে স্মরণ রাখা উচিত, এই বাংলা ভাষার পরিচয়েই আমরা বিশ্বশান্তির অগ্রযাত্রায় অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। বায়ান্নতে রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা অর্জন, সময়ের হাত ধরে পাওয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি_সব কিছুই একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে হবে। রক্তের দামে যে মুখের ভাষা চিরদিনের জন্য কিনেছি, আজ সময় হয়েছে মেধার জোরে সেই ভাষাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার। তাহলেই প্রতিটি একুশের সকালে সাদা-কালো বসনে খালি পায়ে হাতে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিয়ে শহীদ ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারব_
'মোদের গরব মোদের আশা
আমরি বাংলা ভাষা'
কবির ছন্দের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে এ প্রজন্ম আরো উচ্চৈঃস্বরে বলবে_একুশ, তুমি আমাদের দিয়েছ মাতৃভাষা, দিয়েছ অহংকার করার স্পর্ধা। তাই আমরা তোমায় ম্লান হতে দেব না কখনো; বরং তোমাকে তোমার যোগ্য স্বর্ণাসনে অধিষ্ঠিত করব। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
No comments