সহজিয়া কড়চা-মনমোহনের সফর ও আওয়ামী লীগের ভবিষ্য ৎ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

চব্বিশটি বছর বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের পর এক অকল্পনীয় পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ তাদের পুরোনো বন্ধুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্র দুটি হতে পারে, কিন্তু দুই দেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য অভিন্ন। রাজনীতির কারণে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের পর্দা নেমে এলেও তাদের মনের মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই।


দুই দেশের জনগণই দুই দেশের জনগণের বন্ধু। বন্ধুত্বের অর্থ এই নয় যে তাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই মতপার্থক্য ঘটবে না। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে খাবে, না ভুনা গরুর গোশত দিয়ে খাবে—তা নিয়েও তো দুই বন্ধুর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে।
একাত্তরে জনগণের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সেই বন্ধুত্বকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিসেস গান্ধীর সাহায্য-সহযোগিতা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং তা স্বীকার করা না-করায় কিছুই আসে যায় না।
পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বদেশে বিজয়ী বীর হিসেবে প্রত্যাবর্তনের মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ভারত সফরে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, কলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি যে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন, তার তা ৎ পর্য সীমাহীন। দুই দেশের মানুষের বন্ধুত্ব সেদিনই একটি স্থায়ী রূপ নেয়। কলকাতা সফরের গল্প এক-আধটু বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে শোনার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার মতো নগণ্য মানুষেরও হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, জাতীয় বীর, কলকাতা সফর করে আসার ছয় সপ্তাহ পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। মিসেস গান্ধীর ঢাকা সফর ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯ মার্চ ’৭২ তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন।
এখন অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে, মুক্তিযুদ্ধের তিন মাস পরে যখন বহু মানুষের হাতে অস্ত্র রয়ে গিয়েছিল, মিসেস গান্ধীর সফর নিয়ে কোনো রকম নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি ছিল না। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল একেবারেই নাজুক। ভারতীয় সেনারা তখনো এখানে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাস্তাঘাটে লেফট রাইট করতেন না। জঙ্গি শব্দটির তখন প্রচলন হয়নি এখনকার মতো। স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে আমার বন্ধু হুমায়ুন আজাদের আহত হওয়ার দিন পর্যন্ত ৩৫ বছর আমি সাংবাদিকতায় ছিলাম। কিন্তু কোনো দিন আমি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড তো দূরের কথা, আইডেনটিটি কার্ডও করিনি। তাতে বঙ্গবন্ধু ও অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে সফর করায় কোনো অসুবিধা হয়নি। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার অভিজ্ঞতা অনেকের মতো আমারও আছে। সেদিন তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে শিহরিতই হয়েছিলাম। শুধু হ্যান্ডশেক নয়, দু-একটা কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গেও। এখন যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেখানে ছিল জাতীয় সংসদ। তিনি সেখানে গিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন।
বাহাত্তর সাল থেকে আমার বহু লেখায় এবং পরবর্তীকালে সাক্ষা ৎ কারে আমি দুটি ব্যাপারে দাবি জানিয়েছি, কিন্তু কোনো মানুষের সায় বা সমর্থন পাইনি। এক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সৈনিকদের স্মরণে একটি ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ করা, এবং দুই. ইন্দিরা গান্ধীর নামে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ। [মেসবাহ কামালের সঙ্গে সাক্ষা ৎ কার। সমাজ চেতনা, বিশেষ সংখ্যা, মার্চ-এপ্রিল ১৯৯৬]
গত ৩৯ বছরে ভারতের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। সেগুলো রাষ্ট্রীয় সফর নয়, বিভিন্ন উপলক্ষে। একাধিকবার আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের দীর্ঘ সাক্ষা ৎ কার নিয়েছি। তিনি চম ৎ কার সাদাসিধা মানুষ। দুই দেশের সম্পর্ক-উন্নয়ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁর একটি সাক্ষা ৎ কার আমি প্রকাশ করেছিলাম মতিউর রহমান সম্পাদিত ভোরের কাগজ-এ।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরটি ছিল মিসেস গান্ধীর সফরের পরে কোনো ভারতীয় নেতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফর। হ্যান্ডশেক করা তো দূরের কথা, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগটিও পাইনি। আমাদের মতো লোকের তা পাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তাঁর সফর নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, তার কিছুমাত্র পূরণ হয়নি।
গত চল্লিশ বছরে আমরা প্রশাসনে এমন কোনো কর্মকর্তা তৈরি করতে পারিনি, যাঁরা দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে একটি প্রশাসন চালাতে পারেন। চার দশকে এমন কোনো বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিক সৃষ্টি করতে পারিনি, যাঁরা তাঁদের যেকোনো স্বার্থের বিনিময়ে দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করবেন। এক বছর যাব ৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আয়োজন চলেছে। কয়েকবার পিছিয়েছেও। তারপর যা হলো, তা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। এ দায় আমাদের স্বীকার করতে হবে।
ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তারা যা করে, তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই করে। বাংলাদেশ থেকে দিল্লি ফিরে গিয়ে ২৪ ঘণ্টা না যেতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এই সফর নিয়ে আমাদের পার্লামেন্টের কোনো ভূমিকা নেই। ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে নয়, মাত্র দুজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু ব্যক্তি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দুজনও ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব না থাকলে ভারতের উদ্বেগের কারণ নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ না থাকলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের উদ্বেগের এক শ ভাগ কারণ রয়েছে। শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেন। কিন্তু তাঁর সময়েই যদি মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জোরদার হয় এবং তা হয় ভারতের কোনো কোনো রাজনীতিক ও আমলার কারণে, তা হবে বেদনাদায়ক। আগে ভারতের সমালোচনা করত সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। ড. মনমোহনের সফরের পরে যদি প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ভারতের সমালোচনা শুরু করেন, তা দুই দেশের সম্পর্ককে মারাত্মক ক্ষতি করবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরও উত্থান ঘটতে পারে।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে, বলতে গেলে বৈরিতামূলক। মওলানা ভাসানী গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে চিকি ৎ সাধীন। আমি তাঁর সাক্ষা ৎ কার নিতে গিয়েছিলাম। ভাসানীর সাক্ষা ৎ কার মানে শুধু তিনিই বলে যাবেন, আর কারও কথা বলার উপায় নেই। কোনো রকমে তাঁকে একটু থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আশি বছর যাব ৎ লড়াই-সংগ্রাম করলেন, জেলজুলুম সহ্য করলেন, শেষ পর্যস্ত কী পেলেন? আপনি কি সন্তুষ্ট, না হতাশ?’
তাঁর কথার মধ্যে উটকো প্রশ্ন করলে তিনি ধমক দিতেন। বহু বড় বড় ক্ষমতাবান মানুষকে তাঁর ধমক খেতে হয়েছে। মওলানা আমাকে বকা দিলেন না, কোনো রকম রাগেরও প্রকাশ দেখা গেল না তাঁর মধ্যে। একটু চুপ করে রইলেন। ছ্যাঁচা পান মুখে দিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিত নরম বেদনাহত কণ্ঠে বললেন, ‘বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্যে অনুশীলন দলের হিন্দু-সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে কাজ করেছি। লক্ষ্য ছিল, ইংরেজ শাসকদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করব। এ দেশের মানুষই এ দেশ চালাবে। সুখ-দুঃখ যা-ই থাক কপালে, আমাদের ভাগ্য আমরাই গড়ে তুলব। একপর্যায়ে দেখলাম, সন্ত্রাসবাদীরা বেশি দূর যেতে পারবে না। ওদের নীতি-আদর্শের ভিত্তি বড় দুর্বল। বড় সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক। এ দেশের ৫২ ভাগ কৃষক তাঁতি জেলে কামার কুমারের কথা ওরা ভাবে না। ওদের থেকে বিদায় নিলাম।’
মওলানা বলতে লাগলেন, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনীতি ভালো লাগল, যোগ দিলাম কংগ্রেসে। দুই-তিন বছরের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী শুরু করলেন অসহযোগ আন্দোলন। মনে করলাম, এবার ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে হবে। পিকেটিং করে জেলে গেলাম। অহিংস আন্দোলনে কাজ হলো না। দশ-বারো বছর বাংলায় ও আসামে কংগ্রেস নেতা গান্ধী, মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে কাজ করলাম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে যোগ দিলাম মুসলিম লীগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলাম। মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে সব ধর্মবর্ণের মানুষ সমান। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝলাম, যে পাকিস্তান চেয়েছিলাম, এ পাকিস্তান সে পাকিস্তান নয়। জালেমদের ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক, বণিক, শিল্পপতি ও জালেম শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার স্বীকার করে না। পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করি। এত দামে আর কোনো দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে নাই।’
বাংলাদেশ তো এখন স্বাধীন। হুজুর, আপনার হতাশার কারণটা একটু বলুন। সবিনয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি।
ইস্পাতের মতো শক্ত নেতা ভাসানী অনেকটা স্বগতোক্তির মতো আস্তে আস্তে বললেন, ‘সাধারণ মানুষ আপাতত যত দুর্বলই হোক, নিজের অস্তিত্বের সংগ্রামে একদিন তার জয় হবেই। হতাশা তো আছেই। আমি মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। মতিলালের নাতনি, জওহরলালের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতিতে তিনি আমার মেয়ের মতো। আমাকে খুব সম্মান করেন। কিন্তু তাঁর রাজনীতি তাঁর, আমার রাজনীতি আমার। আমার হতাশার কথাই বলো, আর কষ্টের কথাই বলো, এই উপমহাদেশের ভারতের, পাকিস্তানের, বাংলাদেশের—সাধারণ মানুষের দুঃখ গেল না। আমার কষ্ট ওইখানে মতিলাল, জওহরলালদের সঙ্গে রাজনীতি করলাম মানুষের মুক্তির জন্য। আজ বাংলাদেশের স্বার্থে ভারত সরকারের সমালোচনা করলে মানুষ মনে করে আমি সাম্প্রদায়িক। এই দেশে ভারতবিরোধিতা হিন্দুবিরোধিতায় রূপ নেয়। এতে আমি কষ্ট পাই। ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষকে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার কারণে চাপে রাখতে চায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দূর করা যাবে না।’
কয়েক দিন যাব ৎ মওলানার কথাগুলো আমার বারবার মনে পড়ছিল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন বন্ধুত্ব রচনার বিরল দায়িত্ব বর্তেছে যে দুজনের ওপর, তাঁদের উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু এটুকু বলব, এমন কোনো ব্যাপারে অংশীদার হবেন না, যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন এবং তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্য ৎ বিবর্ণ ও হতাশাব্যঞ্জক করে দেয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.