বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩২০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। বশির আহমেদ, বীর প্রতীক সাহসী এক সফল যোদ্ধার কথা রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড়। অ্যামবুশের (ফাঁদ) জন্য উপযুক্ত স্থান। বশির আহমেদসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিলেন পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে।


ওত পেতে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকলেন পাকিস্তানি সেনাদের জন্য। সময় গড়াতে থাকে। একসময় তাঁরা দূরে দেখতে পেলেন পাকিস্তানি সেনাদের। সামনে একদল রাজাকার। রাজাকাররা তাঁদের লক্ষ্য নয়। বশির আহমেদরা চুপচাপ থাকলেন। পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র গর্জে উঠল তাঁদের সবার অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের কোনো সুযোগই পেল না। নিহত হলো বেশির ভাগ। এ ঘটনা কালেঙ্গা জঙ্গলে। ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
কালেঙ্গা জঙ্গল হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা গোপনে অবস্থান করছিলেন কালেঙ্গা জঙ্গলে। ২০-২১ তারিখে একদল পাকিস্তানি সেনা কালেঙ্গা জঙ্গলে আসে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেননি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা মাইনের আঘাতে দু-তিনজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা আবার সেখানে আসে। এদিনও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কোনো বাধা দেননি।
২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সিন্দুরখান-কালেঙ্গার রাস্তার দুই পাশে অ্যামবুশ পেতে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁরা আগেই খবর পেয়েছিলেন পাকিস্তানিরা আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ের যেসব স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেখান থেকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনাদের বেশির ভাগ দেখা যাচ্ছিল। তাদের সামনে ছিল ২২-২৫ জন রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেননি। রাজাকাররা কোনো বাধা না পাওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা বেশ নিশ্চিত মনে এবং কিছটা বেপরোয়াভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা অ্যামবুশের মধ্যে আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালান। অ্যামবুশের মধ্যে পড়া বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হয়। তারা প্রতিরোধের কোনো সুযোগই পায়নি।
পাকিস্তানি সেনারা আসছিল বিস্তৃত এলাকাজুড়ে। অনেকে অ্যামবুশের বাইরে ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা পরিখা খনন করে তার ভেতরে ছিলেন। অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন অফিসারসহ ৬০-৭০ জন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আবদুল মান্নান (বীর উত্তম) শহীদ হন। এই অ্যামবুশে বশির আহমেদ যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
বশির আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সৈনিক হিসেবে ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন জয়দেবপুরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বশির আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১২৯।
বশির আহমেদ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই চাকরি করেন। অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ বল্লবপুর গ্রামে। এখন ঢাকার উত্তরখানে (২০০৭/১, মাস্টারপাড়া) বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম ছফর আলী খন্দকার। মা নূরের নাহার বেগম। স্ত্রী মঞ্জুরা বেগম। তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর ফেনীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবু তাহের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.