একুশ-পরিবার থেকে রাষ্ট্র- যোগাযোগের ভাষা বাংলা by আমিনুল ইসলাম সুজন

এমনিতেই পৃথিবীতে অনেক ভাষাই সংকটে রয়েছে, অনেক ভাষাই ভিনদেশি ভাষার প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলা হয়তো সংকটময় অবস্থায় নেই। কিংবা বিলীন হওয়ার মতো অবস্থাও তৈরি হয়নি। কিন্তু আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, বলা যায় না রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষাই হয়তো একশ' বছর পর সংকটে পড়তে পারে ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির গর্বের মাস। ঐতিহ্যের মাস। ভাষার মাস।


যেহেতু ভাষার সঙ্গে কৃষ্টি-সংস্কৃতির সম্পর্ক সুনিবিড়; যেহেতু কৃষ্টি-সংস্কৃতি প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ভাষা, যেহেতু কৃষ্টি-সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভাষাই প্রধান নিয়ামক, সেহেতু এ মাসকে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রক্ষার মাসও বলা যেতে পারে। কেউ কেউ বাঙালি জাতির ঐতিহ্য রক্ষার মাস হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষায় ভাষাশহীদের মাস। মূলত এই ভাষা আন্দোলনের বিজয়ই তৎকালে (বায়ান্ন-পরবর্তী পাকিস্তান শাসনামল) অন্য সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এই ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানি শোষকদের বিপুলভাবে ধরাশায়ী করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও প্রেরণার উৎস ছিল ভাষা আন্দোলন। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের মাধ্যমেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার বীজও রোপিত হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার দাবিকে কেন্দ্র করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত ভাষা আন্দোলন হয়েছে। তাই প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা পরিপূর্ণ বাঙালি হওয়ার ভান শুরু করি। কথোপকথন, লেখনী, বক্তৃতা-বিবৃতি, পড়া ও শোনায় ইংরেজির ব্যবহার যেন না হয়, এ জন্য অনেকেই খুব সতর্ক থাকি। দূরদর্শন বা শ্রুতি গণমাধ্যমগুলো বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। সংবাদপত্রজাতীয় গণমাধ্যমগুলো বিশেষ বিশেষ প্রতিবেদন বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে। গত কয়েক বছর যাবৎ অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ব্লগেও ভাষা দিবস ও ভাষার গুরুত্ব-তাৎপর্য তুলে ধরে নানা লেখনী-অভিমত প্রকাশিত হচ্ছে। এসবই ইতিবাচক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভাষা হিসেবে বাংলা শুধু এই ফেব্রুয়ারি মাসেই মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবার প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই আবার যে সেই!
রক্ত দিয়ে ভাষা রক্ষাকারী জাতির মধ্যে বাঙালিই সর্বশ্রেষ্ঠ এ কারণে যে বাংলা ভাষার দাবিতে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনটি, মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস বা ভাষা শহীদ দিবস এখন আর শুধু বাংলা ভাষাভাষীর দিবসই নয়, এটি সারা পৃথিবীর সব দেশের, সব জাতির, সব মানুষের মাতৃভাষা দিবস।
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম জানা-অজানা অনেক বাঙালির ভাষা রক্ষার দাবিতে যে রক্তদান, সে রক্তদানকে আমরা কতটা শ্রদ্ধা করছি? আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয়_ সব ক্ষেত্রেই কি আমরা বাংলাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করছি? এর উত্তর আমাদের সবারই জানা এবং তা হতাশাজনক। বলে রাখা ভালো, ভাষা হিসেবে সব ভাষারই নিজস্বতা আছে। মৌলিকত্ব আছে। সব ভাষার মানুষের কাছেই তার নিজ নিজ ভাষা সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাপেক্ষা প্রিয়। এটা খুব স্বাভাবিকও। কিন্তু এই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই যেন নিজ ভাষাকে তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যে ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত।
বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বা হিন্দি বা অন্য কোনো ভাষারই কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু নিজ ভাষাকে গুরুত্ব না দিয়ে ইংরেজি বা হিন্দিপ্রীতি আমাদের নতুন এক সংকর প্রজাতির মানুষে পরিণত করছে; যারা না শুদ্ধ বাংলা বলছে, না বলছে শুদ্ধ ইংরেজি বা হিন্দি। তা ছাড়া আমি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে কেনইবা ইংরেজি বা হিন্দি ব্যবহার করব? পেশাগত প্রয়োজনে ইংরেজি বা অন্য যে কোনো ভাষার ব্যবহারই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার আন্তর্জাতিকতা বিবেচনা করে সবাই এখন ইংরেজি শিখুক_ এটা বাংলা ভাষাপ্রেমী হিসেবে আমারও প্রত্যাশা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাংলা যেন কোনোভাবেই গুরুত্বহীন না হয়_ সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রথমেই যদি পারিবারিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা চর্চার বিষয়ে আসি, তবে হতাশাটা এখান থেকেই শুরু। অধিকাংশ উচ্চবিত্ত পরিবারে ইংরেজির চর্চা বেশি। তবে হিন্দিও গত কয়েক বছরে শক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। তাদের মধ্যে বাংলা যেন তৃতীয় ভাষা। অনেকটা বিদেশি ভাষার মতো। কেউ কেউ ইংরেজিতে বা হিন্দিতে কথা বলতে পারাটাকে উচ্চ মর্যাদাকরও মনে করে থাকেন বলে প্রতীয়মান।
মধ্যবিত্ত সংকটে থাকা এক শ্রেণীর মানুষ। এদের অনেকের মধ্যে উচ্চবিত্তবান না হওয়ার একটা হতাশা কাজ করে। নানাভাবে এ হতাশা দূর করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ ইংরেজি ভাষার চর্চা করছেন, সন্তানদের ইংরেজি ভাষার চর্চায় উৎসাহ ও সহযোগিতা করছেন। পাশাপাশি বাসায় সবাই হিন্দির চর্চা ও ব্যবহার করছেন সমান্তরালে। মধ্যবিত্ত পরিবারে হিন্দিতে কথা বলতে পারাটা সন্তানের অতিরিক্ত যোগ্যতা বিবেচনা হলেও বাংলায় শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারা বা লিখতে না পারাটা অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
নিম্নবিত্তদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিন্দি সিনেমা, হিন্দি ধারাবাহিক। এদের কাছে ইংরেজি অনেক দূরের ভাষা হলেও হিন্দিটা খুব আপন। এরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যতটুকু পড়ছেন তার অধিকাংশ বাংলায় পড়লেও পারিবারিক আবহে শিশু থেকে বৃদ্ধ_ সবাই হিন্দি ভাষার প্রয়োগ করেন। এদের কাছেও বাংলার কদর ক্রমশ কমছে। বস্তি এলাকায়ও যদি কোনো পরিবারে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে, তখন কোনো গানের আওয়াজ কর্ণগোচর হলে লক্ষ্য করবেন সেটা হিন্দি গান।
বলা হয়, পরিবারই প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরিবার থেকেই সামাজিকতার শিক্ষা শুরু হয়। সুতরাং আমাদের প্রধানত তিন স্তরের পরিবারগুলোতে বর্তমানে ভাষার চর্চা/ব্যবহারের যে রীতি প্রচলিত_ তা ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ভাষা চর্চা বা ব্যবহারের যে শিক্ষা পরিবার থেকে শিশুরা পাচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সামাজিকতায়ও। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, অধিকাংশ তরুণ হিন্দির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছে বা তাদের হিন্দির প্রতি মোহগ্রস্ত করতে আমাদের অভিভাবকরাই উৎসাহ দিচ্ছেন।
প্রায় এক যুগের প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি কিংবা এখনও দেখছি, অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক পর্যায়েও ভাষা হিসেবে বাংলার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি আইন ও নীতিমালা, গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখেছি, এসব লেখা হয় প্রথমে ইংরেজিতে। মূলত ঋণদাতা গোষ্ঠীর পরামর্শ (প্রকারান্তরে নির্দেশনা) অনুযায়ী আইন বা নীতি করতে গিয়েই কতিপয় সুবিধাবাদী পরামর্শক (যারা বিদেশি ঋণদাতা গোষ্ঠীর স্থানীয় চর হিসেবে পরিগণিত হতে পারে) আইন বা নীতিমালা বা গবেষণা প্রতিবেদন ইংরেজিতে রচনা করেন। যাতে করে খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এসব বিষয়ে নিয়ে কথা বলার সুযোগ না পায়। কিংবা আগ্রহ বোধ না করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশেও এখনও প্রকৃত অর্থে ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। উচ্চবিত্ত পরিবারের যারা ইংরেজি জানেন, তাদের মধ্যে দেশের কোনো আইন বা নীতি বা কোনো গবেষণা প্রতিবেদন ইংরেজি কী বাংলা হলো_ তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, যারা এখনও ইংরেজিকে নিজের ভাষার মতো আয়ত্ত আনতে পারেননি, তারা এসব আইন বা নীতি বা গবেষণা প্রতিবেদন ইংরেজি ভাষায় রচিত বলে মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
এ ছাড়া প্রশাসনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, আমন্ত্রণপত্রের ক্ষেত্রেও অনেকেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করেন। বিভিন্ন প্রতিবেদনও ইংরেজিতে তৈরি হয়। সৌভাগ্য যে, এখনও হিন্দি ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেনি অধিকাংশ মানুষ। আমি জানি না এটা কেন হয়, আমাদের উচ্চ আদালতেও ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হতে দেখছি। দু'একটি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে দেখেছি, আদালতের নির্দেশনা ইংরেজিতে প্রদান করা হয়েছে। এমনিতেই পৃথিবীতে অনেক ভাষাই সংকটে রয়েছে, অনেক ভাষাই ভিনদেশি ভাষার প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলা হয়তো সংকটময় অবস্থায় নেই। কিংবা বিলীন হওয়ার মতো অবস্থাও তৈরি হয়নি। কিন্তু আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, বলা যায় না রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষাই হয়তো একশ' বছর পর সংকটে পড়তে পারে।
এই যে পরিবার থেকে রাষ্ট্র_ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, কিংবা পারিবারিক আবহে হিন্দি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে_ এটা শুভ লক্ষণ নয়। কেউ কেউ ইংরেজি ভাষার আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিতে পারেন। ইংরেজি শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন, এর চর্চা, ব্যবহারও প্রয়োজন। কিন্তু সেটা শুধু যখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, তখনই করতে হবে। যে যোগাযোগের উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বাঙালি, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলা হতে হবে একমাত্র ভাষা। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ_ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত সব যোগাযোগের মাধ্যম হবে বাংলা। সে জন্য প্রয়োজনীয় আইন, নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

আমিনুল ইসলাম সুজন : সাংবাদিক
aisujon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.