২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-গুলিবিদ্ধ রফিক by আমানুল হক
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তখন আমি চাকরি করি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, আর্টিস্ট হিসেবে। আমার দুটো কাজ ছিল—ছাত্রদের জন্য পোস্টার সাইজ ছবি আঁকতে হতো, প্রফেসররা সেই ছবি দেখে ডেমোনেস্ট্রেশন দিতেন; আবার জটিল রোগী এলে ছবিও তুলতে হতো, রোগীর ট্রিটমেন্ট নেওয়ার পর কী ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, সেগুলো রেকর্ড রাখার জন্য। তখন আমার বয়স ছিল ২৯ প্রায়। চাকরি করি, ছবি তোলা ও আঁকার কাজ করি।
সেদিন সকাল থেকেই একটা প্রস্তুতি ছিল।
মেডিকেল কলেজটা ছিল আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেটা পাকিস্তান আমল ভুললে চলবে না; খুব কট্টরপন্থী, ধর্মনির্ভর একটা সময়। প্রগতিশীলতার বড় অভাব ছিল। কিন্তু আমার প্রগতিশীল মানুষ, রাজনীতিবিদ প্রমুখের সঙ্গেই ওঠবসা, পরিচয় ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, গাজিউল হকসহ অনেকের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের কারণে আগেই ধারণা হয়েছিল ওই দিন কোনো অঘটন ঘটতে পারে, যে কারণে আমার ক্যামেরাটা সব সময় আমার গলাতেই থাকত। এটা আমার একটা অভ্যাস ছিল। সেদিন সকালবেলা থেকেই ক্যামেরাটা লুকিয়ে প্যান্টের পকেটে ভরে ফেলেছি। আমি জানি যে পুলিশ চারদিকে ঘিরে রেখেছে। ক্যামেরাটা লুকিয়ে রাখাটাই নিরাপদ ছিল। আসল ব্যাপারটা কিন্তু ঘটল বিকেলবেলা। তার আগে, সকাল থেকেই স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে, জনতা দলবেঁধে স্লোগান দিতে দিতে—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ১৪৪ ধারা মানি না’ বলতে বলতে, কাঁটাতারের বেড়া ছিল, সেসব ডিঙিয়ে আমতলায় জমায়েত হয়। সেই বিখ্যাত আমতলায়, যেটাকেন্দ্রিক আন্দোলনটা নাটকীয় পরিসমাপ্তি হয়েছিল।
একটা কথা বলা দরকার, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং মেডিকেল কলেজ একই বিল্ডিংয়ের মধ্যে ছিল। আর কলাভবনের পাশেই ছিল আমতলা। একটা আমগাছ ছিল, সেটাকে কেন্দ্র করেই সেদিন সভাটা বসল—আমতলার বিখ্যাত সেই সমাবেশে ছিলেন গাজীউল হক, অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আবদুল মতিন, গোলাম মাওলা। গোলাম মাওলা তখন ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি। আরও ছিলেন অলি আহাদ প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বে আমতলায় সমাবেশ শুরু হয়। সেই সমাবেশেই ঠিক হবে—১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সিদ্ধান্ত এভাবে স্থির হয়—হয় পাঁচজন করে অথবা দশজন করে দলে বিভক্ত হয়ে ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটক দিয়ে তারা বাইরে গিয়ে জমায়েত হবে। তারপর মিছিল করে তারা বাজেট অধিবেশনে যাবে। তখন সংসদ ছিল, এখন যেখানে জগন্নাথ হল আছে ওই জায়গায়।
পাঁচজন পাঁচজন করে, কারো কারো মতে দশজন দশজন করে ছাত্ররা বেরিয়ে পড়ে, তখন লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, ধরপাকড়, অ্যারেস্টও শুরু হয়ে যায়। প্রথমে মেয়েরা ছিল না। তবে প্রথমে একদল বের হওয়ার পরে মেয়েরা বের হয়। এবং তাদেরও একই অবস্থা হয়—লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো চলতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার যে বিরোধ, সেটা আর কমার কারণও ছিল না, কমেওনি। এটা বাড়তেই থাকে। ছাত্র-জনতার ইটপাটকেল এবং পুলিশের বেপরোয়া টিয়ারগ্যাস—টিয়ারগ্যাস কী সাংঘাতিক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, তা ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ওখানে উপস্থিত ছিলাম, ফলে ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছি।
মেডিকেল কলেজের বারান্দায় ছিলাম আমরা, গুলির শব্দ আমি নিজ কানে শুনেছিলাম। কিন্তু সেকালে একটা ব্যাপার ছিল, হাতঘড়ি খুব কম লোকেরই থাকত। এবং অফিস-আদালতে দেয়ালঘড়িও খুব বেশি থাকত না। ফলে সঠিক সময়টা চট করে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। যখন গুলি হয়েছিল, দুপুর গড়িয়ে, কেউ বলেন যে তিনটা কুড়ি মিনিট, কেউ বলেন চারটা। দৈনিক আজাদ-এ একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যে রিপোর্ট বের হয়েছিল, আজাদ ছিল তখনকার অগ্রণী পত্রিকা, সেখানে লেখা হয়েছিল বেলা চার ঘটিকায়। আমার বন্ধু ভাষাসৈনিক এম আর আখতার মুকুল, উনি আমাকে বলেছিলেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে তাঁর হাতঘড়িটা দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার হাতে ঘড়ি ছিল, আমি মিলিয়ে দেখেছি, সেই সময়টা ছিল তিনটা দশ মিনিট।
যা-ই হোক, হঠাৎ গুলির আওয়াজ পেলাম। বুঝতেই পারলাম, গুলি যখন চলল, একটা অঘটনও ঘটে গেছে। তখন আমরা আরও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি—কী হয়, কী হচ্ছে! তারপর দেখা গেল যে বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতা একটা রক্তমাখা দেহ ধরাধরি করে নিয়ে আসছে হাসপাতালে, ইমার্জেন্সির দিকে। আমি এগিয়ে গেলাম। যেতেই ভেতর থেকে একজন চিৎকার করে নাটকীয়ভাবে বলে উঠল—ওরা গুলি করেছে। ওরা মেরে ফেলেছে।
তখনো রক্তপাত হচ্ছে। যারা নিয়ে এসেছিল দেহটি, একদম রক্তাক্ত অবস্থায়; কিন্তু তখনো জীবিত। সে ছিল আবুল বরকত। তারপর তাকে ভর্তি করা হয় এবং রাত আটটার পরে, সালাম আহত হয়েছিল।
তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হয়েছিল শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। তার বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। গ্রামের নাম পারিল বড়ধার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেরে ফেলার জন্য গুলি চালিয়েছিল, আগেই ঠিক করেছিল এটা, অবস্থাদৃষ্টে আমার তাই মনে হয়েছে। আর একটা ব্যাপার হলো, আমরা জানতে পেরেছিলাম যে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে যেসব রোগী ভর্তি ছিল, তাদের বেশ কয়েকজনকে ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার আগে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। তাতে বোঝা যায়, ওরা আন্দাজ করতে পেরেছিল, ছাত্রদের গুলি লাগলে ওখানে ভর্তি হবে। এ কারণে সিটগুলো খালি করে দিয়েছিল। গুলিবর্ষণ হবে, সিট দরকার হবে—এই পরিকল্পনা তাদের মনে ছিল। ওই ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে।
মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন—তার মাঝে একটা দেয়াল ছিল। সেই দেয়ালটা আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল, যাতে এদিক থেকে ওদিকে, আমতলার ওখান থেকে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ, যেখানে অসংখ্য মানুষের জমায়েত, যাতায়াতের সুবিধার হয়।
শহীদ বরকতের ছবি তোলার ব্যাপারটা ছিল নাটকীয়। গুলিবর্ষণের এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ছবিটা তুলেছিলাম।
আমি মেডিকেল কলেজের বারান্দা থেকে নিচে নেমে এসেছি। সেখানে অনেক লোক জমায়েত ছিল—বরকতের দেহটা নিয়ে এসেছে। নিচে নামতেই দেখা হলো পূর্ব বাংলার প্রচার দপ্তরের সহকারী পরিচালক কাজী মুহম্মদ ইদরিসের সঙ্গে। তিনি খুব আদর্শবাদী সাংবাদিক ছিলেন। উনি আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। মেডিকেল কলেজে তখন একজন ছাত্রী ছিল হালিমা নামে। ফোর্থ ইয়ারে পড়ত। সেই সময় ফোর্থ ইয়ারে যারা পড়ত, ওয়ার্ডের রোগীদের সেবাশুশ্রূষা এবং প্রাথমিক কাজগুলো তারাই করত।
হালিমা কাজী ইদরিসকে ডেকে নিয়ে বলল, যে ছেলেটার কপালে গুলি লেগে মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছে, তার লাশটা মেডিকেল কলেজের পেছন দিকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের পাশেই রাখা আছে। সেখানে যাওয়া বা লাশ দর্শন করা সহজসাধ্য ছিল না। কারণ, পুলিশ চারদিকে ঘিরে রেখেছে। পুলিশের ভয় ছিল। সেটা প্রটেক্টেড। এর মধ্য থেকেই পুলিশ আবার চেষ্টা চালাচ্ছে, কীভাবে লাশ গুম করে ফেলা যায়। অনেক লাশই তারা গায়েব করে দিয়েছিল। কারণ, আজিমপুর গোরস্থানে কবর আছে মাত্র দুজনের। তখন হালিমা বলল, গুলিবিদ্ধ ছেলেটির লাশ সে দেখাতে পারে কাজী ইদরিসকে। ইদরিস বলল, ‘হ্যাঁ, আমি দেখতে চাই।’ হালিমা তখন সেই ঘরে ইদরিসকে নিয়ে যায়। কাজী ইদরিস পরে বলেছিলেন, ‘লাশটা দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। হালিমাকে বললাম কোনোভাবে লাশটার ছবি তোলা যায় কি না।’ হালিমা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সেই ব্যবস্থা করতে পারব, যদি সে রকম কোনো ফটোগ্রাফার এক মিনিটের মধ্যে কাজটি করে ফেলতে পারে।’
তখন দেশে ফটোগ্রাফার বেশি ছিল না। ভাষা আন্দোলনের ছবি তুলেছিলাম আমরা মাত্র তিনজন। এর মধ্যে একজন তো খুবই বিখ্যাত। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। উনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি আমানুল হক। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের পুত্র মুহম্মদ তকীউল্লাহ। উনি অবশ্য খুব কম ছবি তুলেছিলেন। এই তিনজনের কথাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তখন সমস্ত ঢাকায় যত পত্রিকা ছিল, সব পত্রিকায় ফটোগ্রাফার ছিল না। এবং অল্প পত্রিকার ফটোগ্রাফার ছিল।
তো, ইদরিস সাহেব ভিড়ের মধ্যে এসে খুঁজছেন—আমানুল হককে কোথায় পাওয়া যায়। ঘটনাচক্রে ফরচুনেটলি আমি সেখানে ছিলাম, দেখা হয়ে গেল। আমি তখন ফুলহাতা হাওয়াই শার্ট পরেছিলাম। প্যান্টের পকেটে ক্যামেরাটি লুকানো ছিল। উনি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন, ‘আপনি কি ছবি তুলতে পারবেন?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হ্যাঁ, তুলতে পারব। সে আবার হালিমার কাছে গেল। বলল, আমি আমানুলের সঙ্গে যাব না। সে একাই ছবি তুলে আনবে তোমার সঙ্গে গিয়ে। তুমি তাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেবে। আমি তখন হালিমার ইশারায় সেই ঘরে গেলাম, ক্যামেরা ঠিকঠাক করে। সেই ঘরটি ছবি তোলার মতো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। ভালো আলো ছিল না। তখন আমার কাছে যে ক্যামেরাটি ছিল, সেটি নিলামে কেনা। বাংলাবাজারে একটা অবাঙালিদের নিলামঘর থেকে মাত্র ১০০ টাকায় কেনা। আর সেটার মধ্যে ছবি তোলার ফ্ল্যাশের কোনো বন্দোবস্তই ছিল না। ফোকাস করা যেত না। খুব অনুন্নত টাইপের ক্যামেরা। আর ওই ঘরটার মধ্যে আলোর অভাব—তবু আমি সাহস করে ছবিটা তুললাম। ছবি ডেভেলপ, প্রিন্ট করতে হলো লুকিয়ে। গোপনে। কারণ, পুলিশ জানতে পারলে সিজ করবে। অত্যন্ত গোপনে কাজগুলো করলাম। পরস্ফুিটন, প্রিন্ট নির্মাণ। কাজী ইদরিস এতই উৎসাহী ছিলেন। তিনি অফিস থেকে ফিরে আমি যে বাড়িটাতে থাকতাম, সেখানে গিয়ে ছবিটা দেখলেন। ছবি দেখে তিনি বেশ খুশি হলেন। আমরা অনেকগুলো কপি করছিলাম। আমরা একটা কপি দিলাম এস এম মোহসিন সাজুকে। আর একটা কপি দিলাম ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মাজেদ খানকে। তৃতীয় কপিটি সরবরাহ করলাম দৈনিক আজাদ-এ। ছাপার জন্য ব্লক তৈরি হলো। কিন্তু রাত দুইটার দিকে সম্পাদক বা মালিকপক্ষের আপত্তিতে আজাদ-এ ছাপা হলো না। আজাদ-এ ছাপা হলে খুব বিস্ফোরক একটা ব্যাপার হতো। মাজেদ খানকে যে কপিটি দেওয়া হয়েছিল, সেটা ব্লক তৈরি করতে ছাত্রদের দিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্ররা সেটা দিয়ে পোস্টার তৈরি করে। অনেকগুলো কপি করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ হামলা করে সব কপি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। ফলে পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ার আর সুযোগ থাকল না। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য ওই ছবি দিয়ে পোস্টার করে কাজে লাগানো হয়।
১৯৫২ সালে আমি তরুণ ছিলাম। ছবিটা তোলার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক ঝুঁকি আছে জেনেও কাজটি করেছি। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আমার অবস্থা খুব খারাপ হবে, সেটা জানতাম। তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা, আনুগত্য থেকে কাজটি করেছি। ভাষার প্রতি এই আনুগত্য সাধারণ মানুষেরও ছিল। ফলে ভাষার বিজয়টা সম্ভব হয়েছিল। ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমে এই বিজয় অর্জন হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একধরনের আবেগ ও দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এই কর্মসাধন করেছি। দায়বদ্ধতার কারণ না থাকলে এত ঝুঁকির মধ্যে আমরা কোনোক্রমেই যেতাম না।
মেডিকেল কলেজটা ছিল আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেটা পাকিস্তান আমল ভুললে চলবে না; খুব কট্টরপন্থী, ধর্মনির্ভর একটা সময়। প্রগতিশীলতার বড় অভাব ছিল। কিন্তু আমার প্রগতিশীল মানুষ, রাজনীতিবিদ প্রমুখের সঙ্গেই ওঠবসা, পরিচয় ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান, গাজিউল হকসহ অনেকের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের কারণে আগেই ধারণা হয়েছিল ওই দিন কোনো অঘটন ঘটতে পারে, যে কারণে আমার ক্যামেরাটা সব সময় আমার গলাতেই থাকত। এটা আমার একটা অভ্যাস ছিল। সেদিন সকালবেলা থেকেই ক্যামেরাটা লুকিয়ে প্যান্টের পকেটে ভরে ফেলেছি। আমি জানি যে পুলিশ চারদিকে ঘিরে রেখেছে। ক্যামেরাটা লুকিয়ে রাখাটাই নিরাপদ ছিল। আসল ব্যাপারটা কিন্তু ঘটল বিকেলবেলা। তার আগে, সকাল থেকেই স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে, জনতা দলবেঁধে স্লোগান দিতে দিতে—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ১৪৪ ধারা মানি না’ বলতে বলতে, কাঁটাতারের বেড়া ছিল, সেসব ডিঙিয়ে আমতলায় জমায়েত হয়। সেই বিখ্যাত আমতলায়, যেটাকেন্দ্রিক আন্দোলনটা নাটকীয় পরিসমাপ্তি হয়েছিল।
একটা কথা বলা দরকার, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং মেডিকেল কলেজ একই বিল্ডিংয়ের মধ্যে ছিল। আর কলাভবনের পাশেই ছিল আমতলা। একটা আমগাছ ছিল, সেটাকে কেন্দ্র করেই সেদিন সভাটা বসল—আমতলার বিখ্যাত সেই সমাবেশে ছিলেন গাজীউল হক, অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আবদুল মতিন, গোলাম মাওলা। গোলাম মাওলা তখন ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি। আরও ছিলেন অলি আহাদ প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বে আমতলায় সমাবেশ শুরু হয়। সেই সমাবেশেই ঠিক হবে—১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সিদ্ধান্ত এভাবে স্থির হয়—হয় পাঁচজন করে অথবা দশজন করে দলে বিভক্ত হয়ে ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটক দিয়ে তারা বাইরে গিয়ে জমায়েত হবে। তারপর মিছিল করে তারা বাজেট অধিবেশনে যাবে। তখন সংসদ ছিল, এখন যেখানে জগন্নাথ হল আছে ওই জায়গায়।
পাঁচজন পাঁচজন করে, কারো কারো মতে দশজন দশজন করে ছাত্ররা বেরিয়ে পড়ে, তখন লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, ধরপাকড়, অ্যারেস্টও শুরু হয়ে যায়। প্রথমে মেয়েরা ছিল না। তবে প্রথমে একদল বের হওয়ার পরে মেয়েরা বের হয়। এবং তাদেরও একই অবস্থা হয়—লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো চলতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার যে বিরোধ, সেটা আর কমার কারণও ছিল না, কমেওনি। এটা বাড়তেই থাকে। ছাত্র-জনতার ইটপাটকেল এবং পুলিশের বেপরোয়া টিয়ারগ্যাস—টিয়ারগ্যাস কী সাংঘাতিক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, তা ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ওখানে উপস্থিত ছিলাম, ফলে ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছি।
মেডিকেল কলেজের বারান্দায় ছিলাম আমরা, গুলির শব্দ আমি নিজ কানে শুনেছিলাম। কিন্তু সেকালে একটা ব্যাপার ছিল, হাতঘড়ি খুব কম লোকেরই থাকত। এবং অফিস-আদালতে দেয়ালঘড়িও খুব বেশি থাকত না। ফলে সঠিক সময়টা চট করে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। যখন গুলি হয়েছিল, দুপুর গড়িয়ে, কেউ বলেন যে তিনটা কুড়ি মিনিট, কেউ বলেন চারটা। দৈনিক আজাদ-এ একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যে রিপোর্ট বের হয়েছিল, আজাদ ছিল তখনকার অগ্রণী পত্রিকা, সেখানে লেখা হয়েছিল বেলা চার ঘটিকায়। আমার বন্ধু ভাষাসৈনিক এম আর আখতার মুকুল, উনি আমাকে বলেছিলেন। নাটকীয় ভঙ্গিতে তাঁর হাতঘড়িটা দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার হাতে ঘড়ি ছিল, আমি মিলিয়ে দেখেছি, সেই সময়টা ছিল তিনটা দশ মিনিট।
যা-ই হোক, হঠাৎ গুলির আওয়াজ পেলাম। বুঝতেই পারলাম, গুলি যখন চলল, একটা অঘটনও ঘটে গেছে। তখন আমরা আরও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি—কী হয়, কী হচ্ছে! তারপর দেখা গেল যে বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতা একটা রক্তমাখা দেহ ধরাধরি করে নিয়ে আসছে হাসপাতালে, ইমার্জেন্সির দিকে। আমি এগিয়ে গেলাম। যেতেই ভেতর থেকে একজন চিৎকার করে নাটকীয়ভাবে বলে উঠল—ওরা গুলি করেছে। ওরা মেরে ফেলেছে।
তখনো রক্তপাত হচ্ছে। যারা নিয়ে এসেছিল দেহটি, একদম রক্তাক্ত অবস্থায়; কিন্তু তখনো জীবিত। সে ছিল আবুল বরকত। তারপর তাকে ভর্তি করা হয় এবং রাত আটটার পরে, সালাম আহত হয়েছিল।
তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হয়েছিল শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। তার বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। গ্রামের নাম পারিল বড়ধার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেরে ফেলার জন্য গুলি চালিয়েছিল, আগেই ঠিক করেছিল এটা, অবস্থাদৃষ্টে আমার তাই মনে হয়েছে। আর একটা ব্যাপার হলো, আমরা জানতে পেরেছিলাম যে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে যেসব রোগী ভর্তি ছিল, তাদের বেশ কয়েকজনকে ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার আগে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। তাতে বোঝা যায়, ওরা আন্দাজ করতে পেরেছিল, ছাত্রদের গুলি লাগলে ওখানে ভর্তি হবে। এ কারণে সিটগুলো খালি করে দিয়েছিল। গুলিবর্ষণ হবে, সিট দরকার হবে—এই পরিকল্পনা তাদের মনে ছিল। ওই ঘটনা তা-ই প্রমাণ করে।
মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন—তার মাঝে একটা দেয়াল ছিল। সেই দেয়ালটা আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল, যাতে এদিক থেকে ওদিকে, আমতলার ওখান থেকে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ, যেখানে অসংখ্য মানুষের জমায়েত, যাতায়াতের সুবিধার হয়।
শহীদ বরকতের ছবি তোলার ব্যাপারটা ছিল নাটকীয়। গুলিবর্ষণের এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ছবিটা তুলেছিলাম।
আমি মেডিকেল কলেজের বারান্দা থেকে নিচে নেমে এসেছি। সেখানে অনেক লোক জমায়েত ছিল—বরকতের দেহটা নিয়ে এসেছে। নিচে নামতেই দেখা হলো পূর্ব বাংলার প্রচার দপ্তরের সহকারী পরিচালক কাজী মুহম্মদ ইদরিসের সঙ্গে। তিনি খুব আদর্শবাদী সাংবাদিক ছিলেন। উনি আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। মেডিকেল কলেজে তখন একজন ছাত্রী ছিল হালিমা নামে। ফোর্থ ইয়ারে পড়ত। সেই সময় ফোর্থ ইয়ারে যারা পড়ত, ওয়ার্ডের রোগীদের সেবাশুশ্রূষা এবং প্রাথমিক কাজগুলো তারাই করত।
হালিমা কাজী ইদরিসকে ডেকে নিয়ে বলল, যে ছেলেটার কপালে গুলি লেগে মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছে, তার লাশটা মেডিকেল কলেজের পেছন দিকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের পাশেই রাখা আছে। সেখানে যাওয়া বা লাশ দর্শন করা সহজসাধ্য ছিল না। কারণ, পুলিশ চারদিকে ঘিরে রেখেছে। পুলিশের ভয় ছিল। সেটা প্রটেক্টেড। এর মধ্য থেকেই পুলিশ আবার চেষ্টা চালাচ্ছে, কীভাবে লাশ গুম করে ফেলা যায়। অনেক লাশই তারা গায়েব করে দিয়েছিল। কারণ, আজিমপুর গোরস্থানে কবর আছে মাত্র দুজনের। তখন হালিমা বলল, গুলিবিদ্ধ ছেলেটির লাশ সে দেখাতে পারে কাজী ইদরিসকে। ইদরিস বলল, ‘হ্যাঁ, আমি দেখতে চাই।’ হালিমা তখন সেই ঘরে ইদরিসকে নিয়ে যায়। কাজী ইদরিস পরে বলেছিলেন, ‘লাশটা দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। হালিমাকে বললাম কোনোভাবে লাশটার ছবি তোলা যায় কি না।’ হালিমা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সেই ব্যবস্থা করতে পারব, যদি সে রকম কোনো ফটোগ্রাফার এক মিনিটের মধ্যে কাজটি করে ফেলতে পারে।’
তখন দেশে ফটোগ্রাফার বেশি ছিল না। ভাষা আন্দোলনের ছবি তুলেছিলাম আমরা মাত্র তিনজন। এর মধ্যে একজন তো খুবই বিখ্যাত। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। উনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি আমানুল হক। তৃতীয় ব্যক্তি হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের পুত্র মুহম্মদ তকীউল্লাহ। উনি অবশ্য খুব কম ছবি তুলেছিলেন। এই তিনজনের কথাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তখন সমস্ত ঢাকায় যত পত্রিকা ছিল, সব পত্রিকায় ফটোগ্রাফার ছিল না। এবং অল্প পত্রিকার ফটোগ্রাফার ছিল।
তো, ইদরিস সাহেব ভিড়ের মধ্যে এসে খুঁজছেন—আমানুল হককে কোথায় পাওয়া যায়। ঘটনাচক্রে ফরচুনেটলি আমি সেখানে ছিলাম, দেখা হয়ে গেল। আমি তখন ফুলহাতা হাওয়াই শার্ট পরেছিলাম। প্যান্টের পকেটে ক্যামেরাটি লুকানো ছিল। উনি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন, ‘আপনি কি ছবি তুলতে পারবেন?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হ্যাঁ, তুলতে পারব। সে আবার হালিমার কাছে গেল। বলল, আমি আমানুলের সঙ্গে যাব না। সে একাই ছবি তুলে আনবে তোমার সঙ্গে গিয়ে। তুমি তাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেবে। আমি তখন হালিমার ইশারায় সেই ঘরে গেলাম, ক্যামেরা ঠিকঠাক করে। সেই ঘরটি ছবি তোলার মতো উপযুক্ত জায়গা ছিল না। ভালো আলো ছিল না। তখন আমার কাছে যে ক্যামেরাটি ছিল, সেটি নিলামে কেনা। বাংলাবাজারে একটা অবাঙালিদের নিলামঘর থেকে মাত্র ১০০ টাকায় কেনা। আর সেটার মধ্যে ছবি তোলার ফ্ল্যাশের কোনো বন্দোবস্তই ছিল না। ফোকাস করা যেত না। খুব অনুন্নত টাইপের ক্যামেরা। আর ওই ঘরটার মধ্যে আলোর অভাব—তবু আমি সাহস করে ছবিটা তুললাম। ছবি ডেভেলপ, প্রিন্ট করতে হলো লুকিয়ে। গোপনে। কারণ, পুলিশ জানতে পারলে সিজ করবে। অত্যন্ত গোপনে কাজগুলো করলাম। পরস্ফুিটন, প্রিন্ট নির্মাণ। কাজী ইদরিস এতই উৎসাহী ছিলেন। তিনি অফিস থেকে ফিরে আমি যে বাড়িটাতে থাকতাম, সেখানে গিয়ে ছবিটা দেখলেন। ছবি দেখে তিনি বেশ খুশি হলেন। আমরা অনেকগুলো কপি করছিলাম। আমরা একটা কপি দিলাম এস এম মোহসিন সাজুকে। আর একটা কপি দিলাম ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মাজেদ খানকে। তৃতীয় কপিটি সরবরাহ করলাম দৈনিক আজাদ-এ। ছাপার জন্য ব্লক তৈরি হলো। কিন্তু রাত দুইটার দিকে সম্পাদক বা মালিকপক্ষের আপত্তিতে আজাদ-এ ছাপা হলো না। আজাদ-এ ছাপা হলে খুব বিস্ফোরক একটা ব্যাপার হতো। মাজেদ খানকে যে কপিটি দেওয়া হয়েছিল, সেটা ব্লক তৈরি করতে ছাত্রদের দিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্ররা সেটা দিয়ে পোস্টার তৈরি করে। অনেকগুলো কপি করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ হামলা করে সব কপি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। ফলে পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়ার আর সুযোগ থাকল না। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য ওই ছবি দিয়ে পোস্টার করে কাজে লাগানো হয়।
১৯৫২ সালে আমি তরুণ ছিলাম। ছবিটা তোলার ক্ষেত্রে সাংঘাতিক ঝুঁকি আছে জেনেও কাজটি করেছি। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আমার অবস্থা খুব খারাপ হবে, সেটা জানতাম। তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা, আনুগত্য থেকে কাজটি করেছি। ভাষার প্রতি এই আনুগত্য সাধারণ মানুষেরও ছিল। ফলে ভাষার বিজয়টা সম্ভব হয়েছিল। ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমে এই বিজয় অর্জন হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একধরনের আবেগ ও দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এই কর্মসাধন করেছি। দায়বদ্ধতার কারণ না থাকলে এত ঝুঁকির মধ্যে আমরা কোনোক্রমেই যেতাম না।
No comments