উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ একুশের চেতনার পরিপন্থী by মোস্তফা মাহবুব রাসেল

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য নিছক একটি দিবস বা তারিখ নয়। এর চেয়েও আরো যেসব কারণে দিনটিকে বিশেষ হিসেবে সাধারণত মনে করা হয়, তার মধ্যেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা আছে। যাঁরা ধর্মীয় চেতনা ভাঙিয়ে রাজনীতি করছেন, তাঁদের দৌড় ওই স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত।


যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভাঙিয়ে রাজনীতি করছেন, '৪৭-পরবর্তী এই দেশের গোটা ইতিহাসের মালিকানাই তাঁরা দাবি করেন। স্বভাবতই তার মধ্যে ভাষা আন্দোলনও বাদ যায় না। গাজীউল হক-আবদুল মতিনের মতো আরও অন্য সক্রিয় ভাষাসৈনিকের লেখনি এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের তুলনামূলক বিচারে সহায়তা করতে পারে। ১৪৪ ধারা ভাঙার যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই ভাষা আন্দোলনের নায়ক সাজানো হচ্ছে এই আমলে। শুধু মহান ভাষা আন্দোলন নয়, আমাদের দেশের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলোতে পিছিয়ে থাকা, আপসকামী চরিত্রগুলোই ইতিহাসের পাতার বেশির ভাগটা জুড়ে আছে। প্রকৃত নায়করা থেকে যাচ্ছেন আড়ালে কিংবা সামান্যই তাঁদের স্বীকৃতি মিলছে। সঠিক ইতিহাস থেকে আমরা কেবল বঞ্চিতই হচ্ছি না, আমাদের রাজনৈতিক মননে বিরাজ করছে বিরাট বিভ্রান্তি।
গরিমা না করেই বলা যায়, বাংলা ভাষা বিশ্বের অনেক ভাষার চেয়েই সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এই ভাষা যেমন বর্ণমালার দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধ হয়েছে ভাব প্রকাশের বহুমাত্রিক যোগ্যতার দিক দিয়ে। যেমন, আরবি ভাষায় 'প' এবং ইংরেজি ভাষায় 'ত'সহ বহু বর্ণ ও চিহ্নের অনুপস্থিতি রয়েছে, যা বাংলা ভাষায় আমরা ব্যবহার করি। বাংলায় একই বাক্যের মাধ্যমে অনেক রকমের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। যাহোক, ভাষা সমৃদ্ধ হয় ওই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মূলত উৎপাদন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের মধ্য দিয়ে। মানুষের চিন্তা-চেতনার ওপর, তার স্বাধীন ক্রিয়াকলাপের ওপর যখন ধারাবাহিকভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়, তার ভাব প্রকাশের সামর্থ্যও ততই লোপ পায়। ভাষা হয়ে পড়ে দরিদ্র। আবার যদি ওই বাধাগুলোকে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে আবার ভাষা আগের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে যায়, সমৃদ্ধ হয়। ভাষা সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরের প্রয়োজন নেই। মানুষের স্বাধীন সত্তাকে যত সমৃদ্ধ করা যাবে, ভাষাও ততই সমৃদ্ধ হবে, সংরক্ষিত হবে। শিল্প-সাহিত্যের স্বাধীন বিকাশ ভাষা সংরক্ষণের একটি বিশেষ উপায়। তবে এই বিকাশ যদি ঘটে বাজারকে কেন্দ্র করে, মুনাফাকে কেন্দ্র করে, তাহলে ভাষা দরিদ্র হতে বাধ্য; এবং তা একসময় বিপন্ন হতে পারে।
অসংগতি নয়, মিডিয়া এবং বাজার ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিকাশের নামে অনেক ধরনের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। বাজারি সাহিত্য জনপ্রিয়তার লোভে ক্রমবিকাশমান মধ্যবিত্তের উদ্ভট চটকদার ভাষা ও শব্দে বোঝাই হচ্ছে। কথা বলার সময় বাংলা-ইংরেজির মিশেল এখন লেখার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। বাংলা সংবাদপত্রের পাতার নাম রাখা হচ্ছে ইংরেজিতে। এফএম রেডিওতে চলছে হরদম ভাষার বিকৃতি। হিন্দি এবং হলিউডি সংস্কৃতির ইংরেজি ভাষার প্রতাপ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
ভাষা ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকার ও গণমাধ্যমকে প্রথমত ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দেশপ্রেমিক হতে হবে, হতে হবে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন। বাংলাদেশের সংবিধানে পর্যন্ত ভাষার সঠিক প্রয়োগের প্রতি যত্নশীলতা দেখা যায় না। বহুজাতিক কম্পানি নয়, সরকারকেই এ দেশের সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধান এবং ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিতে হবে। গণমাধ্যমকে তুলে ধরতে হবে দেশের সঠিক ইতিহাস। এ দেশের জনগণকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে।
ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা তো পরের বিষয়, তাদের সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষীদের মানসিকতায় বিরাজ করে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীগুলোকে যদি গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং বাংলার পাশাপাশি তাদের নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবেই তাদের ভাষা তারা নিজেরাই সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে।
পু্ঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভাষার প্রভাব শুধু ভাবের বিনিময়কেই শক্তিশালী করে না, পুঁজি এবং বাজার বিস্তারেও ভূমিকা রাখে। আবার, বাংলা ভাষার ওপর সোমালীয় বা লাতিন আমেরিকান কোনো ভাষার প্রভাব আমরা দেখি না, দেখি প্রধানত ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার প্রভাব, যা এ দেশে মার্কিন ও ভারত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যকেই নির্দেশ করে। এই ভাষা দুটির আধিপত্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশগতিকে ভয়াবহভাবে বাধা দিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.