শহীদ মিনার-বিশ্বে অদ্বিতীয়অসাম্প্রদায়িক প্রতীক by ফারুক ওয়াসিফ
চাকুরে মা-বাবা একুশের ছুটিতে গ্রামে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। এদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া আদিবের মন ভীষণ খারাপ। সইতে না পেরে একসময় সে বলেই ফেলল, ‘বাবা, তাহলে কাল শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারব না!’ বাবা-মায়ের দুই জোড়া হাত থমকে গেল। তাঁরা নির্বাক।
প্রথম কথা ফুটল বাবার মুখে; বললেন, ‘না, বাবা, আমাদের গ্রামেও তো শহীদ মিনার আছে। তুমি সেখানেই ফুল দিয়ো!’ সত্যিই আজ তুমি যেখানেই যাবে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে কোনো না কোনো শহীদ মিনার। বাংলাদেশ যদি শহীদের দেশ হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ শহীদ মিনারেরও দেশ।
এ এক বিস্ময়, বাংলাদেশের এমন জায়গা মিলবে না, যেখানে শহীদ মিনার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নেই। শহর তো দূরের কথা, শহীদ মিনারহীন গ্রামও কম পাওয়া যাবে। স্থায়ী শহীদ মিনারের পাশাপাশি একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই পাড়ার মোড়ে, মাঠের পাশে, গলির মুখে, এমনকি বাড়ির আঙিনাতেও অজস্র শহীদ মিনার ক্ষণিকের জন্য মাথা তোলে। এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে একুশের প্রভাতফেরি শহীদ মিনারমুখী হয় না। গত ষাট বছর ধরে এমনটা হয়ে আসছে। সব জাতি-ধর্মের এবং ভাষাভাষী মানুষের এতে সমান অধিকার। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের পরের বছরগুলোতে শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে ‘সেক্যুলার’ মানবিক চেতনার কেন্দ্র, সংস্কৃতি উদ্যাপনের প্রতীক।
পাশ্চাত্য থেকে রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অনেক কিছু ধার করেছি আমরা। কিন্তু এ কথা বোধকরি নিশ্চয় করে বলা যায়, ভাষাভিত্তিক সেক্যুলার চেতনার উদ্গাতা বাংলাদেশের মানুষ এবং তাদের অবদানেই এই চেতনা ও তার প্রতীক শহীদ মিনার বিশ্বায়িত হচ্ছে। বাঙালি জাতির ইতিহাসেও এত শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক প্রতীকের জন্ম হয়েছিল কিনা জানা নেই। ভাষা আন্দোলন এবং শহীদ মিনার উভয়ই আরেকটা সত্য তুলে ধরে যে, ভাষা নিজেই একটা রাজনৈতিক ক্ষেত্র, সেই ক্ষেত্রে যা মাথা তুলবে তার চরিত্রও তাই হবে রাজনৈতিক।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর কোনো জাতীয় ঘটনার স্মরণে এত বেশি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক স্থাপত্য নির্মিত হয়নি। উপাসনা কেন্দ্র ছাড়া আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে এত বেশি বন্দনাও দেয়নি কোনো জাতি। সারা বিশ্বের বাঙালিদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণার স্থায়ী উৎস এই শহীদ মিনার। একুশে স্মরণে নির্মিত সব শহীদ মিনার কেবল অতীতের স্মারক নয়, তা বর্তমানেও জীবন্ত। কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই নয়, সারা বছরই শহীদ মিনারগুলোতে চলে সাংস্কৃতিক আয়োজন। শহীদ মিনার তাই ভাষা আন্দোলনের স্মারক নয় শুধু, তা বর্তমানেও জীবন্ত এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রতিবাদের সংহতিতে, শোকের গাম্ভীর্যে, বিজয়ের উদ্যাপনে শহীদ মিনারেই ছুটে আসে মানুষ। রাজনৈতিক সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মরণসভা থেকে শুরু করে জাতির কৃতী সন্তানদের অন্তিম বিদায়ের মঞ্চও হয় শহীদ মিনার।
জাতীয় স্মৃতিসৌধও চরিত্রগত দিক থেকে শহীদ মিনারের মতো নয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতীক। আর শহীদ মিনার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে জাতীয় চেতনাকে এগিয়ে নেওয়ার আধার। জাতীয় স্মৃতিসৌধ রাষ্ট্রিক, শহীদ মিনার সামাজিক।
বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশি বাঙালি সমাজ আছে, সেখানেই মাথা তুলছে এই আত্মপরিচয়ের প্রতীক। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে আর ওল্ডহ্যামেও তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার। গত বছর রোমের ইৎজাক রাবিন পার্কে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলের একটি শহীদ মিনার। ২০০৫ সালে জাপানের রাজধানীতে শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কেও দাঁড়িয়ে আছে একটি শহীদ মিনার। আমেরিকাতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েকটি শহীদ মিনার। একুশের উদ্যাপনও এখন বৈশ্বিক ঘটনা। বিশ্বের আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীক এত মর্যাদা আর জনপ্রিয়তা পায় বলে জানা নেই।
আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক স্ট্যাচু অব লিবার্টি বিশ্বে বহুল পরিচিত স্থাপত্য। কিন্তু এটা স্থানেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে এর অজস্র অনুকৃতি পণ্য হিসেবে বিক্রি হলেও এর সর্বজনীন ও বৈশ্বিক মর্যাদা নেই। হিরোশিমায় পারমাণবিক ট্র্যাজেডি স্মরণে জাপানে হিরোশিমা শান্তি উদ্যান, হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর ও ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাদের স্মরণে মনুমেন্ট বা ভাস্কর্য বিদ্যমান। এগুলোর একক কোনো আদল নেই। এগুলোর সবই কেবল ইতিহাসের স্মারক; বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা এগুলো বহন করে না। শহীদ মিনার যেভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির দিশা হিসেবে গণ্য হয়, সে রকম গুরুত্ব এগুলো পায় না। আকার-অবয়বে যেমনই হোক, প্রতিটি শহীদ মিনারই একই চেতনা ও আকর্ষণ বহন করে। বাংলাদেশের শহীদ মিনার একটি ও অনন্য হলেও গ্রামগঞ্জে, স্কুল-কলেজে, পার্কে-উদ্যানে এর যত প্রমাণ আকারের অনুকৃতি হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনীয় কিছু বিশ্বে তাই দুর্লভ।
দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার মিলবে। সরকারি হিসাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে রয়েছে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা ও ইউনিয়নের মিলিত সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৪৭টি। এসবের কতটিতে শহীদ মিনার স্থাপিত আছে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। এ বিষয়ে কোনো জরিপও এখন পর্যন্ত হয়নি। তার পরও বলা যায়, এসবের অর্ধেকেও যদি শহীদ মিনার থেকে থাকে, সেই সংখ্যাটিও বিরাট। এই হিসাবে বাংলাদেশে শহীদ মিনারের আনুমানিক সংখ্যা কমপক্ষে এক লাখেরও বেশি। এর সঙ্গে একুশের লগ্নে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারগুলোর সংখ্যা যোগ করলে ব্যাপকতা আরও বাড়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও একুশের ঘটনা ও শহীদ মিনারের অবস্থান একেবারে কেন্দ্রে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ গোড়াতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ নির্মাণে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনারের ভূমিকা অপরিমেয়। ছাত্র-তরুণেরাই ছিল একুশ থেকে একাত্তরের প্রধান সংগ্রামী। এখনো তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের মঞ্চ হয়ে ওঠে শহীদ মিনার। কোনো এলাকায় বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকলে তারাই সরব হয় বেশি।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা দেশের সব শহীদ মিনার ভেঙে ফেলেছিল। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার সময় তারা দম্ভ করে বলেছিল, ‘হার ঘর শহীদ মিনার বানা দেঙ্গা।’ অর্থাৎ প্রতিটি ঘরকেই শহীদ মিনার বানিয়ে দেব। হ্যাঁ, তারা প্রায় প্রতিটি ঘরেই কাউকে না কাউকে শহীদ করেছিল। আর সেই শহীদদের উত্তরসূরিরা দেশ থেকে বিশ্ব পর্যন্ত শহীদ মিনার বানিয়ে জবাব দিচ্ছে, ‘আমাদের প্রতিটি ঘরেই শহীদ, আমাদের প্রতিটি প্রাঙ্গণেই শহীদ মিনার।’
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments