কবিকে নম্র হতে হয় by আল মাহমুদ
আমি যদি কবি বা লেখক না হতাম তাহলে কী হতাম? নিশ্চয়ই চাষাভূষাই হতাম। কারণ, লেখা ছাড়া আমার মন যে আর একটি বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে থাকে, সেটা হলো চাষবাস। কারণ, এই একটি কাজ আমি শিশুকাল থেকেই দেখে এসেছি। আমার নানা ছিলেন একজন জোত্জমির মালিক। ধান কাটা হয়ে গেলে উঠোনে মলন চড়াতেন।
গরু-বাছুরগুলো ধানের শীষের উপর ঘুরে ঘুরে মলন দিত। নানা উঠোনে বসে তার এক কৃষক বন্ধুর সঙ্গে এই কাজটি অতি উত্সাহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতেন।
একদিন আমার নানা হঠাত্ তার কৃষক বন্ধুকে ধাক্কা দিয়ে পাশে শুয়ে পড়লেন। আর বেশি নড়াচড়া করতে পারলেন না। সে সময়কার বড় ডাক্তার দ্রুত তাকে দেখে গেলেন। হাতের বইটি দিয়ে পায়ে আঘাত করে আফসোস করেছিলেন। নানার দেহ শক্ত হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি শ্বাস টেনে জীবিত ছিলেন। এই ঘটনাটি আজও আমার মনে গভীর দাগ কেটে রয়েছে। তার মৃত্যু হয়েছিল বলা যায় অল্প বয়সে। তার বিশাল সম্পত্তি ছিল। টাকাকড়ি, জমিজমা বিত্ত-বেসাত কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই আমার নানা মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মানুষের মৃত্যুর অনেক স্মৃতি আছে আমার মধ্যে। এর মধ্যে আমার দাদির মৃত্যুর স্মৃতি অত্যন্ত জাগরুক; কিন্তু নানার মৃত্যুটি ছিল আমাদের পরিবারের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এখন আর সব কথা এই মুহূর্তে আমি স্মরণ করতে পারছি না।
নানার মৃত্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন আমার মা। আমরা ছিলাম সব সময় আমার মামুবাড়ির ওপর নির্ভরশীল। এক কথায় বলা যায়, মামুদের খেয়ে মানুষ। আমি কখনও একথা স্বীকার করতে গ্লানিবোধ করিনি যে, আমরা অর্থাত্ আমার মা, মামুদের ওপরই অর্থাত্ বাপেরবাড়ির ওপর কর্তৃত্ব করে আমাদের ভরণপোষণ করতে সদা গর্ববোধ করতেন। ইনি ছিলেন একই বাড়ির বউ এবং একই পরিবারের মেয়ে। আমার দাদা ও নানা ছিলেন সহোদর ভাই। আমার দাদা ঈষত্ গরিব ছিলেন; কিন্তু ছিলেন খুই শৌখিন। আমার নানা ছিলেন ধনী, জমিজমার মালিক এবং বিশাল চারণভূমির ওপর কর্তৃত্বকারী। তবে আমার দাদাকে আমার নানা খুবই সম্মানের চোখে দেখতেন। তার বড় ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য ছিল অটুট। কোনো অবস্থাতেই মাথা তুলে কথা বলতে পারতেন না।
এসব কাহিনী নিশ্চয়ই আমি আমার কোনো আত্মজীবনীমূলক অধ্যায়ে লিখব বলে স্থির করে রেখেছি।
কবি না হলে আমি কী হতাম? নিশ্চয়ই কিষাণ হতাম। কারণ, ওই একটা কাজই আমি একদা অন্তর দিয়ে চর্চা করার চেষ্টা করতাম। আমাদের বাড়ির চাষবাস দেখার জন্য ইসমাইল এবং ধনু নামে দু’জন দশাসই কিষাণ ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা কাজ করত। রাতে যাওয়ার সময় খাওয়ার পর আমার মায়ের কাছে এসে লুকিয়ে তাদের পরিবারের মেয়েদের জন্য ভাত চাইত। আমার মা পাত্র ভরে ভাত-তরকারি, কাঁচামরিচ এসব নিয়মিত দিয়ে দিতেন। এজন্যই দেখতাম মুনিমানুষরা আমার মায়ের প্রতি খুবই অনুগত ছিল। আমার মায়ের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে এরা বাড়তি খাবার লুকিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যেত। এভাবেই আমার মা আমার নানাবাড়ির সবারই প্রিয় পাত্রী কিংবা বলা যায় অন্নদাত্রী মা হয়ে উঠেছিলেন।
হায়, আজ যখন এসব কথা ভাবি তখন আমার দু’চোখ সিক্ত হয়ে আসে। আমার মা সত্যি ছিলেন এক অসাধারণ অন্নপূর্ণা মাতা।
বলতে যাচ্ছিলাম কবি না হলে আমি কী হতাম? হয়তো কিছুই হতাম না। গ্রাম্য বাউণ্ডুলে হতাম। বরং যা হয়েছি অর্থাত্ কবি—এটাই ছিল আমার হয়ে ওঠার নির্ধারিত নিয়তি।
আমি আফসোস করি না। ফরিয়াদ জানাই না। বরং নীরবে নিঃশব্দে আমার প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। মানুষ না হয়ে অন্য কিছুও তো হতে পারতাম। তার চেয়ে বরং মানুষ হওয়ার আনন্দটা আমার মর্মে সঠিকভাবে প্রবিষ্ট করিয়ে দাও প্রভু। আর আমার চোখে কাজলের মতো পরিয়ে দাও স্বপ্ন। শুধু স্বপ্ন দিয়েই আমি কঠোর বাস্তবতাকে উল্লঙ্খন করে আমার গন্তব্যে পৌঁছে যাব। আমি তো লিখেছি প্রচুর। দেখেছি প্রচুর; কিন্তু নিজের স্বার্থে ব্যবহার করিনি এর সবটুকু। তবুও আমি কি অসুখী? না তো। মনে তো হয় না আমি অসুখী। আমি যদি মাঠের চারণ হতাম, গেয়ে যেতাম নিজের আত্মবৃত্তান্ত তাহলে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে এসে আমাকে ঘিরে ফেলত। বৃক্ষলতা আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করত।
আমি কখনও ভাবি না আমি অসুখী। সুখ আসলে কী বস্তু এটা কি মানুষ জানে? জানে না বলেই সুখী মানুষের কান্নায় পৃথিবী আজ জড়ো জড়ো।
সুখ নামের শুকপাখি আমি কখনও নিজের জন্য ডেকে আনিনি। আমি নিজে নিজের পরিচয় দেই দুঃখী মানুষ হিসেবে। কারণ, আমার চেয়ে দুঃখ ও প্রতারিত পরান আমি তো খুব বেশি দেখতে পাইনি। আমি সদা সুখের চিন্তা করি না। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সর্বাবস্থায় নিজেকে সমর্পিত করে বাঁচতে হয়। আমি ভয় পেয়ে পালাই না। যখন কোনো প্রতিযোগিতায় আমার জয় হয় আমি মাথা নুইয়ে থাকি। কারণ, উদ্ধতমস্তক কবিতার কার্যকারণ আবিষ্কার করতে পারে না। কবিকে নম্র হতে হয়, বিনম্র হতে হয়। একই সঙ্গে বিনীত হতে হয়। কারণ, সবাই তো কবিতা লিখতে পারে না। এর জন্য মাতৃগর্ভ থেকে কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে গড়াগড়ি যেতে হয়।
লেখকঃ কবি
No comments