সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিতঃ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর কাজ সংসদকে অধিক কার্যকর করা এবং পাশাপাশি সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু গত এক বছরে আমরা তার উল্টো চিত্রই দেখেছি। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর অসহযোগিতা ও অনীহাই দিন দিন বড় হয়ে উঠেছে।
যেন অলক্ষেই দুটি পক্ষ মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এটা যাই হোক, সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে কাম্য হতে পারে না। জাতীয় সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও সংসদীয় ব্যবস্থাকে সচল করতে সক্ষম হয়নি মহাজোট সরকার। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই প্রায় অর্ধশত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হলেও সেগুলো এক বছরেই নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র আমলাতন্ত্রের দাপটই দৃশ্যমান।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গঠিত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিসহ ৪৮টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এরই মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার সুপারিশ ও নির্দেশনা দেয়ার কথা ঘটা করে প্রচার করেছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেগুলো গ্রাহ্য করার প্রয়োজনবোধ করেনি। নির্দিষ্ট সময় পার হলেও বেশিরভাগই ফাইল চাপা পড়ে আছে। ২০ ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি সরকারের এক বছরে। কয়েকটি স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সদস্য এজন্য সুনির্দিষ্টভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মন্ত্রণালয়ের অনীহার অভিযোগ তুলেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ অধীনস্থ দফতর-অধিদফতরে বিরাজমান অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় সংশ্লিষ্ট কমিটির পক্ষ থেকে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করা হলেও কারোরই টনক নড়েনি।
জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজানো এবং অনিয়মের জন্য দায়ী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সময় বেঁধে দিয়ে নির্দেশনা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। নামকাওয়াস্তে গুরুত্বহীন কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত করে বেশিরভাগই ফেলে রেখেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, জ্বালানি, পানিসম্পদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, তথ্য, শিক্ষা, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতিরা এসব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি তাদের শতাধিক সুপারিশের মধ্যে মাত্র ২৭টি বাস্তবায়ন হওয়ায় সাংবাদিকদের সামনে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি। জজকোর্টের দুই বিচারপতির চাকরিচ্যুতি ও পুনর্বহাল নিয়ে অনিয়মের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন বিষয়ক উপদেষ্টাকে তলব করা হলেও তিনি আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। মান বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কমিটিকেই পিছটান দিতে হয়েছে। একই অবস্থা সরকারি প্রতিষ্ঠানবিষয়ক স্থায়ী কমিটির। তারা দুদকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ তিন কর্মকর্তাকে তলব করলেও কেউ সাড়া দেয়ার গরজ দেখাননি। স্পিকারের শরণাপন্ন হয়েও সুবিধা করতে পারেনি স্থায়ী কমিটি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক দুই উপদেষ্টাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করলেও এ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও একই ভূমিকা পালন করেছে। এসবের জন্য আইনি দুর্বলতাকে দায়ী করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের পক্ষ থেকে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে; কিন্তু সে সুপারিশও গুরুত্ব পায়নি সরকারের কাছে।
এই যদি হয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর সুপারিশমালার পরিণতি, তাহলে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার বিষয়টি শিকেয় উঠবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে অবশ্য বিরোধী দলের ভূমিকার প্রশ্ন তোলা অবান্তর। মহাজোট সরকার যদি আমলাতন্ত্রের বাঁধনে বাঁধা পড়ে থাকে, তবে কোনো ঘোষণাই তা যত গলা ফাটিয়েই বলা হোক, ফল দেবে না। সরকারের প্রথম বছরের এই চিত্র গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে মানুষের আশাবাদী না হওয়ার জন্য যথেষ্ট বলা যায়।
No comments