অন্য ভাষার আগ্রাসনে বাংলা জৌলুস হারাচ্ছে! by শ্রাবন্তী দাশ

বাঙালি একমাত্র জাতি যারা পেরেছে ভাষার জন্য রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করতে। তাই তো দেশ-দেশান্তরে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই মহান একুশের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে, আরো পেয়েছি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা।


আমাদের বাংলা ভাষা একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ভাষা। আমাদের মাতৃভাষার মতো এমন শ্রুতিমধুর ভাষা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কিন্তু কালক্রমে এবং অন্যান্য বিদেশি ভাষার আগ্রাসনে আমাদের এ মাতৃভাষা ক্রমেই তার জৌলুশ হারাচ্ছে। আমাদের তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের কিছু অতি আধুনিক মানুষ আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। বাংলা ভাষায় অসংগতিপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় শব্দের ব্যবহার কখনো কখনো পাল্টে ফেলছে বাক্যের অর্থ, আমাদের করছে বিব্রত। বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তার সবটুকু হারানোর আগেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
একুশের তাৎপর্য এ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসতে পারি আমরা অর্থাৎ তরুণরাও। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ফেসবুকে এ-সংক্রান্ত একটি সাইট আমরা খুলতে পারি। সেখানে আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য, সচিত্র প্রতিবেদন ও ছবি দেওয়া থাকবে; যা থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের এ গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পাঠচক্র ও আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে এভাবে বিস্তৃত হবে একুশের চেতনা। যেহেতু আমরা প্রাণ দিয়েছিলাম বাংলা ভাষার জন্য, তাই এই দিনটি ইংরেজি তারিখে পালন না করে বাংলা তারিখ ৮ই ফাল্গুন হিসেবে পালন করা বেশি যুক্তিসংগত বলে মনে করি।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার এবং গণমাধ্যমগুলো সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকার তার বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে করে আমাদের ভাষার পরিচিতি ও ইতিহাস অন্যান্য দেশে পরিচিতি পাবে। দেশের সরকারি-বেসরকারি সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির ব্যবস্থা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য সাময়িকীতে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোর উচিত তাদের সব কাজকর্মে বাংলা ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্যও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত। কারণ এগুলোও আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিরই একটি অংশ। এসব ভাষার সংরক্ষণ ও ভাষাভাষিদের নিজেদের মনোভাব প্রকাশের যথাযথ সুযোগ দেওয়া আমাদেরই দায়িত্ব।
যেকোনো দেশের ভাষার গঠন একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুদূর অতীতকাল থেকে বহু বিদেশি শব্দ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষা বর্তমান রূপ পেয়েছে। বাংলা ভাষার ক্রমপরিবর্তনশীলতাকে ইতিবাচকভাবেই দেখা উচিত। ভাষার সমৃদ্ধির জন্য এ পরিবর্তন অপরিহার্য। তবে এ পরিবর্তন ঘটা উচিত অবশ্যই আমাদের নিজেদের ভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেই। এ ভাষাতেই আমরা প্রথম মা বলতে শিখেছি। তাই ভাষা ও মা আমাদের কাছে প্রায় সমার্থক। আবেগ এবং যুক্তি উভয় বিচারেই এ ভাষার বিকাশ ও উন্নয়নে আরো অনেক গবেষণার মাধ্যমে বাংলা ভাষার শেকড় সন্ধান করতে হবে, যেতে হবে এর অস্তিত্বের গভীরে।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পর থেকে 'একুশে ফেব্রুয়ারি' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ঘটেনি ভাষার সত্যিকার আন্তর্জাতিকীকরণ। তাই বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ করতে বিশ্বের যেসব দেশে বাংলা ভাষাভাষি মানুষ আছে, সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। সে সব দেশে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে, যাতে সেখানে বসবাসকারী শিশুরা সপ্তাহে অন্তত এক দিন বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ পায়। এ ছাড়া আমরা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করি, তারা যদি আমাদের সবার ওয়াল বাংলা লেখা দিয়ে সাজাই তবে সারা বিশ্বের কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করবে। এভাবেই আমাদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ করা সম্ভব হবে। আমাদের মাতৃভাষা একদিন বিশ্ব দরবারে সেরা ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা বাংলাকে একটি মর্যাদাপূর্ণ ভাষা হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে পারব।

No comments

Powered by Blogger.