এখনও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকরঃ নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করুন
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি অংশে বলা হয়েছিল—ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হবে। আওয়ামী মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর উপজেলা নির্বাচন হয়েছে।
তারপর প্রায় বছর পার হতে চললো, উপজেলা পরিষদ কার্যকর হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ ক্ষমতা বুঝে পাননি এখনও। আর ইউনিয়ন পরিষদগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে দু’বছর আগেই। এই মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও উপজেলা পরিষদের সদস্য। অধিকাংশ পৌরসভা ও দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত নির্বাচনও আটকে আছে। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরিই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। এতে স্থানীয় সরকার নয়, আমলাতন্ত্রই শক্ত-পোক্ত হচ্ছে, যা ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থী। নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা স্থানীয় সরকারের নামে এভাবে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করার অভিযোগ তুলেছেন। নিজেদের অধিকার এবং শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন দেনদরবার করে হতাশ হয়েই তারা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
শুনে আশ্চর্য হতে হয়, উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব এতদিনেও ঠিক করা হয়নি। তাদের জন্য ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এ অবস্থায় যাবতীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভোগ করছেন এমপি ও ইউএনও। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে এতে উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। প্রায় এক বছর হতে চললো তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। সবক্ষেত্রেই তাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা খবরদারি করছেন। সরকারের এতদসংক্রান্ত নতুন প্রজ্ঞাপনে ইউএনওদের ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তারাই উপজেলা পরিষদ কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (এসিআর) তৈরি করবেন। এ অবস্থায় নির্বাচিত উপজেলা প্রতিনিধিরা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ার আশঙ্কার মুখে পড়েছেন। সরকারি দলের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাও এমন পরিস্থিতি মানতে নারাজ। ফলে দলমত নির্বিশেষে তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের মনের ক্ষোভ যেমন গভীর হয়ে উঠছে, তেমনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এমন অবস্থায় সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জারিকৃত সরকারি প্রজ্ঞাপনে কেবল ইউএনওদের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিরোধিতা করে অবিলম্বে এটা পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের পদমর্যাদা, কর্মবণ্টন ও সুযোগ-সুবিধা সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং সব কাজে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করাসহ সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণভাবে জাতীয় সম্পদ বরাদ্দ, জাতীয় বাজেটের স্থানীয় পর্যায়ে বরাদ্দের শতকরা ৭০ ভাগ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার আলোকে উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করার দাবি তোলা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রতিনিধিদের উত্থাপিত দাবিগুলো বিবেচনায় না নিয়ে পারা যাবে না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানেও সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাষ্ট্র উত্সাহদান করিবেন—এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তাহলে কেন বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটা মোটেই বোধগম্য নয়।
সরকারের এক বছরে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থা তা সমর্থন করে না। এই বাস্তবতা সরকারি দলের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে সন্দেহ নেই।
No comments