রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়? by সাইফুল সামিন
ভারত-পাকিস্তান তখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে বিতর্কটা শুরু হয়ে গেছে। বিতর্ক—পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। ‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’; কী হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর দেশ বিভাগের পর তো কথাই নেই। এটিই ছিল পূর্ব বাংলার সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রশ্ন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলার তত্কালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ভাষার প্রশ্নটি ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই তখনকার সংবাদপত্রেও এই বিতর্কের প্রতিফলন দেখা যায়। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়ের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশ করে ভাষার প্রশ্নটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
জন্মের আগে ভাষার দাবি
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই পশ্চিমা নেতারা এমন মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন যে একমাত্র উর্দুই হবে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ-সমর্থক পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়। বাংলা ভাষার পক্ষে তখন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে দৈনিক ইত্তেহাদ। ১৯৪৭ সালেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে, এ আশঙ্কায় সর্বপ্রথম পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করে এর প্রতিবাদ করেন মোহাম্মদ আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দৈনিক ইত্তেহাদের রবিবাসরীয় বিভাগে আবদুল হকের ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুই পর্বে ছাপা হয়। শুরু থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতিও ছিল বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার। ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষা বিষয়ে আবদুল হকের ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ শিরোনামে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সে সময়ে দৈনিক আজাদে বাংলা ভাষাকে সমর্থন করে লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়।
ভাষার প্রশ্নে দ্বিমুখী আজাদ
দেশ বিভাগের আগে ভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে শুরু থেকেই এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি ছিল রহস্যে ঘেরা। আজাদে কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে আবার কখনো বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর আজাদের এই চরিত্র কিছুটা পরিবর্তিত হয়। তা সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে পত্রিকাটির কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান ছিল না।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’?
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পুস্তিকাটিতে অন্যান্যের সঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের ভাষা-সম্পর্কিত প্রবন্ধ ছাপা হয়।
বাংলা ভাষার শত্রু মর্নিং নিউজ
প্রথম থেকেই মর্নিং নিউজ পত্রিকাটি বাংলা ভাষার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে পত্রিকাটিতে অব্যাহতভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশিত হতো। ১৯৪৭ সালে ১৭ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয় কলামে উর্দু সমর্থকদের একটি তাত্ত্বিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে উর্দুকে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই সম্পাদকীয়তে বাঙালি মুসলমানদের তথাকথিত ‘দো-আঁশলা’ সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণকল্পে উর্দু ভাষা-নির্ভর একটি তৃতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ভাষার পক্ষে ইত্তেহাদ
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছিল। এর অন্যতম নিদর্শন হলো—পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা ভাষার কোনো স্থান না থাকা। বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের এই একচোখা নীতিকে তত্কালীন মন্ত্রী ফজলুর রহমান ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দায় এড়িয়ে যান। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দৈনিক ইত্তেহাদ এই প্রসঙ্গে ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
বাংলার পক্ষে গণপরিষদে প্রস্তাব
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষা-বিষয়ক প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে লিয়াকত আলী খান, তমিজুদ্দিন খান, নাজিমুদ্দিনসহ মুসলিম লীগের নেতারা যেসব বক্তব্য দেন, তাঁর বিরুদ্ধে ৪ মার্চ নওবেলাল পত্রিকায় অনেক বিবৃতি ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়।
দ্বৈত ভূমিকায় আজাদ
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘খাওয়াজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভোট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না, আমাদের মতে তার উপরোক্ত মন্তব্য মোটেই সত্য নয়।’ আজাদের সম্পাদকীয়তে এ ধরনের বক্তব্য বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির জোরালো সমর্থনকেই নির্দেশ করে। কিন্তু একই বছর মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বাত্মকভাবে উর্দুকেই সমর্থন করেছে। এ সময় ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’, ‘পাসবান’; সিলেটের ‘আসাম হেরাল্ড’, ‘যুগভেরী’ উর্দুর পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে। তবে এ পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষাবিরোধী পত্রিকাগুলোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল।
গঠিত হলো সংগ্রাম পরিষদ
কয়েকটি পত্রিকা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়। গণপরিষদের সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় এ খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। ১৩ মার্চ সরকার কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃত বাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করে। ওই দিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পত্রিকাগুলো এসে পৌঁছালে পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত করে।
উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তনে তিনি আবারও বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। ছাত্রদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক ‘না’, ‘না’ বলে এর প্রতিবাদ করেন।
‘বেশী সত্য আমরা বাংগালী’
ভাষা বিতর্কের এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। এ সম্মেলনে মূল সভাপতির অভিভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাংগালী।...মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাংগালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপী-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।’ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর এ বক্তব্য দৈনিক আজাদসহ পূর্ব বাংলার কয়েকটি পত্রিকায় তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি সৈনিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কি দেখিলাম’ শীর্ষক বিবরণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য সম্পর্কে কটূক্তি করে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান পুরোহিতের যোগ্য কথাই বটে।’
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত
১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাংলা ভাষাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা ছিল এ ষড়যন্ত্রের একটি রূপ। আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষা সংস্কার কমিটির ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি বিবৃতি দেন। ১৯৫০ সালের ৪ অক্টোবর দৈনিক আজাদে শহীদুল্লাহর ওই বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়।
ভাষা আন্দোলনে নতুন জোয়ার
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর কয়েক বছর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তেমন কোনো কার্যকারিতা ছিল না। তাই বলে বাংলার সচেতন জনগণের মন থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি মুছে যায়নি। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে সংগ্রাম পরিষদের পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রতীক ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
অবশেষে এল সেই রক্তস্নাত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সকালেই ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তত্কালীন আমতলায় বসে সভা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে চলে তর্ক-বিতর্ক। সভা চলার ঘণ্টাখানেক পরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেন সভাপতি গাজীউল হক। মুহূর্তেই স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একদল ছাত্রছাত্রী। এরপর দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। বেলা তিনটার দিকে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট পুলিশ। ভাষার দাবিতে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই। এ ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। সংবাদপত্রেও এর প্রতিফলন ঘটে।
ভাষার প্রশ্নে সোচ্চার আজাদ
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে পূর্ববর্তী রহস্যময়তার জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ। একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ গুলিবর্ষণ ও হতাহতদের তালিকা এবং ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। দৈনিক আজাদের ওই টেলিগ্রামে ব্যানার শিরোনাম করা হয়েছিল, ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। মুসলিম লীগ সরকার দৈনিক আজাদের এ সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করে। এ ছাড়া পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনারও উদ্বোধন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে আজাদের ভূমিকা ছিল সোচ্চার। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ তিন দিন আজাদের শিরোনামগুলো ছিল বলিষ্ঠ। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে আজাদের সম্পাদকীয় কলামেও জোরালো বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। ‘তদন্ত চাই’, ‘ভুলের মাশুল’, ‘পদত্যাগ করুন’ ইত্যাদি শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আজাদ।
ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই মর্নিং নিউজ
শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ ছিল উর্দু ভাষার সমর্থক। প্রথম থেকেই তারা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও উগ্র প্রচারণা চালায়। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনাকেও তারা বিকৃত করে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে মর্নিং নিউজের কট্টর বিরোধিতামূলক মনোভাবের কারণে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়। আর পত্রিকাটির সম্পাদক মহসীন আলী তাঁর আজিমপুরের বাসভবন থেকে পালিয়ে গভর্নরের বাসায় আশ্রয় নেন।
সংবাদের অবস্থা ত্রিশঙ্কু
সংবাদের তত্কালীন মালিক ছিলেন নূরুল আমিন। আর পত্রিকাটিতে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলেন বাংলা ভাষার সমর্থক। তা সত্ত্বেও মালিকানার কারণে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করছিল। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের খবরও সংবাদে খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুব্ধ জনতা রথখোলা মোড়ে সংবাদ অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসটি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশের গুলিবর্ষণের কারণে তা সম্ভব হয়নি। সংবাদের ভাষা আন্দোলন-বিরোধী এ ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি থেকে তরুণ সাংবাদিক মুস্তফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী পদত্যাগ করেন।
পাকিস্তান অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ
ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় বেশ গুরত্বসহকারে প্রকাশিত হতো। এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া এ ঘটনায় পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম এবং মালিক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অকুতোভয় সাপ্তাহিক সৈনিক
সরকার একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার ব্যাপারে পত্রিকাগুলোকে শুধু প্রেসনোট ছাপার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাংলা ভাষা-সমর্থক পত্রিকাগুলো সরকারের সে নির্দেশ অমান্য করে। ট্যাবলয়েড সাইজের চার পৃষ্ঠার পত্রিকা সাপ্তাহিক সৈনিক একুশে ফেব্রুয়ারি বের করে বিশেষ সংখ্যা। সেদিন পত্রিকাটিতে লাল কালিতে ব্যানার করা হয়, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ।’ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন তথ্যের সংযোজনে এ বিশেষ সংখ্যার তিনটি সংস্করণ বের করে সাপ্তাহিক সৈনিক। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ সৈনিক অফিস ঘেরাও করে এবং পত্রিকাটির সম্পাদক আবদুল গফুর এবং প্রকাশক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে পত্রিকাটির প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলন সমর্থক অন্যান্য পত্রিকা
বাংলা ভাষা-সমর্থক অন্যান্য দৈনিকের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ ও দৈনিক আমার দেশ। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদ ছাত্রদের নিয়ে দৈনিক মিল্লাতে ব্যানার শিরোনাম করা হয়েছিল, ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’ এ ঘটনার পর মিল্লাতের সম্পাদক মো. মোদাব্বেরের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে পরে নূরুল আমিন বিষয়টির সমাধান করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক চাষীর একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয় ঢাকা থেকে। পুলিশ ওই দিন সন্ধ্যায় চাষীর অফিস ঘেরাও করে মুদ্রণ সরঞ্জাম ও সব পত্রিকা নিয়ে নেয়।
ভাষা আন্দোলনে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকও জোরালো ভূমিকা পালন করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘দেশের অযুত কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদের ঘোষণা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের হোতা সরকারের বিচার চাই প্রকাশ্য গণআদালতে।’
মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা ভঙ্গ হয় ভাষা ইস্যুতে। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এ বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল সংবাদপত্রে। আর সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে তা হয়ে ওঠে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সেই সময়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র বাংলা ভাষার পক্ষে পালন করেছিল সোচ্চার ভূমিকা। কোনো কোনোটি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চালিয়েছিল নির্লজ্জ প্রচারণা। আর ভাষার প্রশ্নে কয়েকটি পত্রিকা ছিল দ্বৈত ভূমিকায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা বিতর্কের অবসান ঘটে। রক্তের দামে বাঙালি কেনে তার মাতৃভাষা—‘বাংলা’।
জন্মের আগে ভাষার দাবি
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই পশ্চিমা নেতারা এমন মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন যে একমাত্র উর্দুই হবে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ-সমর্থক পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়। বাংলা ভাষার পক্ষে তখন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে দৈনিক ইত্তেহাদ। ১৯৪৭ সালেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে, এ আশঙ্কায় সর্বপ্রথম পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করে এর প্রতিবাদ করেন মোহাম্মদ আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দৈনিক ইত্তেহাদের রবিবাসরীয় বিভাগে আবদুল হকের ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুই পর্বে ছাপা হয়। শুরু থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতিও ছিল বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার। ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষা বিষয়ে আবদুল হকের ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ শিরোনামে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সে সময়ে দৈনিক আজাদে বাংলা ভাষাকে সমর্থন করে লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়।
ভাষার প্রশ্নে দ্বিমুখী আজাদ
দেশ বিভাগের আগে ভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদে বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে শুরু থেকেই এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি ছিল রহস্যে ঘেরা। আজাদে কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে আবার কখনো বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর আজাদের এই চরিত্র কিছুটা পরিবর্তিত হয়। তা সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে পত্রিকাটির কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান ছিল না।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’?
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। পুস্তিকাটিতে অন্যান্যের সঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের ভাষা-সম্পর্কিত প্রবন্ধ ছাপা হয়।
বাংলা ভাষার শত্রু মর্নিং নিউজ
প্রথম থেকেই মর্নিং নিউজ পত্রিকাটি বাংলা ভাষার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে পত্রিকাটিতে অব্যাহতভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশিত হতো। ১৯৪৭ সালে ১৭ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয় কলামে উর্দু সমর্থকদের একটি তাত্ত্বিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে উর্দুকে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই সম্পাদকীয়তে বাঙালি মুসলমানদের তথাকথিত ‘দো-আঁশলা’ সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণকল্পে উর্দু ভাষা-নির্ভর একটি তৃতীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ভাষার পক্ষে ইত্তেহাদ
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছিল। এর অন্যতম নিদর্শন হলো—পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা ভাষার কোনো স্থান না থাকা। বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের এই একচোখা নীতিকে তত্কালীন মন্ত্রী ফজলুর রহমান ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দায় এড়িয়ে যান। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দৈনিক ইত্তেহাদ এই প্রসঙ্গে ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
বাংলার পক্ষে গণপরিষদে প্রস্তাব
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষা-বিষয়ক প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে লিয়াকত আলী খান, তমিজুদ্দিন খান, নাজিমুদ্দিনসহ মুসলিম লীগের নেতারা যেসব বক্তব্য দেন, তাঁর বিরুদ্ধে ৪ মার্চ নওবেলাল পত্রিকায় অনেক বিবৃতি ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়।
দ্বৈত ভূমিকায় আজাদ
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘খাওয়াজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভোট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না, আমাদের মতে তার উপরোক্ত মন্তব্য মোটেই সত্য নয়।’ আজাদের সম্পাদকীয়তে এ ধরনের বক্তব্য বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির জোরালো সমর্থনকেই নির্দেশ করে। কিন্তু একই বছর মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বাত্মকভাবে উর্দুকেই সমর্থন করেছে। এ সময় ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’, ‘পাসবান’; সিলেটের ‘আসাম হেরাল্ড’, ‘যুগভেরী’ উর্দুর পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে। তবে এ পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষাবিরোধী পত্রিকাগুলোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল।
গঠিত হলো সংগ্রাম পরিষদ
কয়েকটি পত্রিকা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়। গণপরিষদের সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় এ খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। ১৩ মার্চ সরকার কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃত বাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করে। ওই দিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পত্রিকাগুলো এসে পৌঁছালে পুলিশ তা বাজেয়াপ্ত করে।
উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তনে তিনি আবারও বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। ছাত্রদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক ‘না’, ‘না’ বলে এর প্রতিবাদ করেন।
‘বেশী সত্য আমরা বাংগালী’
ভাষা বিতর্কের এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। এ সম্মেলনে মূল সভাপতির অভিভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাংগালী।...মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাংগালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপী-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।’ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর এ বক্তব্য দৈনিক আজাদসহ পূর্ব বাংলার কয়েকটি পত্রিকায় তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি সৈনিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কি দেখিলাম’ শীর্ষক বিবরণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য সম্পর্কে কটূক্তি করে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান পুরোহিতের যোগ্য কথাই বটে।’
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত
১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাংলা ভাষাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা ছিল এ ষড়যন্ত্রের একটি রূপ। আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষা সংস্কার কমিটির ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি বিবৃতি দেন। ১৯৫০ সালের ৪ অক্টোবর দৈনিক আজাদে শহীদুল্লাহর ওই বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়।
ভাষা আন্দোলনে নতুন জোয়ার
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর কয়েক বছর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তেমন কোনো কার্যকারিতা ছিল না। তাই বলে বাংলার সচেতন জনগণের মন থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি মুছে যায়নি। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে সংগ্রাম পরিষদের পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রতীক ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
অবশেষে এল সেই রক্তস্নাত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সকালেই ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তত্কালীন আমতলায় বসে সভা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে চলে তর্ক-বিতর্ক। সভা চলার ঘণ্টাখানেক পরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দেন সভাপতি গাজীউল হক। মুহূর্তেই স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একদল ছাত্রছাত্রী। এরপর দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। বেলা তিনটার দিকে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট পুলিশ। ভাষার দাবিতে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই। এ ঘটনা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। সংবাদপত্রেও এর প্রতিফলন ঘটে।
ভাষার প্রশ্নে সোচ্চার আজাদ
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে পূর্ববর্তী রহস্যময়তার জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ। একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ গুলিবর্ষণ ও হতাহতদের তালিকা এবং ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। দৈনিক আজাদের ওই টেলিগ্রামে ব্যানার শিরোনাম করা হয়েছিল, ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। মুসলিম লীগ সরকার দৈনিক আজাদের এ সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করে। এ ছাড়া পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনারও উদ্বোধন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে আজাদের ভূমিকা ছিল সোচ্চার। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ তিন দিন আজাদের শিরোনামগুলো ছিল বলিষ্ঠ। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে আজাদের সম্পাদকীয় কলামেও জোরালো বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। ‘তদন্ত চাই’, ‘ভুলের মাশুল’, ‘পদত্যাগ করুন’ ইত্যাদি শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে আজাদ।
ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই মর্নিং নিউজ
শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ ছিল উর্দু ভাষার সমর্থক। প্রথম থেকেই তারা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও উগ্র প্রচারণা চালায়। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনাকেও তারা বিকৃত করে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে। বাংলা ভাষার প্রশ্নে মর্নিং নিউজের কট্টর বিরোধিতামূলক মনোভাবের কারণে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়। আর পত্রিকাটির সম্পাদক মহসীন আলী তাঁর আজিমপুরের বাসভবন থেকে পালিয়ে গভর্নরের বাসায় আশ্রয় নেন।
সংবাদের অবস্থা ত্রিশঙ্কু
সংবাদের তত্কালীন মালিক ছিলেন নূরুল আমিন। আর পত্রিকাটিতে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলেন বাংলা ভাষার সমর্থক। তা সত্ত্বেও মালিকানার কারণে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করছিল। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের খবরও সংবাদে খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুব্ধ জনতা রথখোলা মোড়ে সংবাদ অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসটি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশের গুলিবর্ষণের কারণে তা সম্ভব হয়নি। সংবাদের ভাষা আন্দোলন-বিরোধী এ ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি থেকে তরুণ সাংবাদিক মুস্তফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী পদত্যাগ করেন।
পাকিস্তান অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ
ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় বেশ গুরত্বসহকারে প্রকাশিত হতো। এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া এ ঘটনায় পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম এবং মালিক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অকুতোভয় সাপ্তাহিক সৈনিক
সরকার একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার ব্যাপারে পত্রিকাগুলোকে শুধু প্রেসনোট ছাপার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাংলা ভাষা-সমর্থক পত্রিকাগুলো সরকারের সে নির্দেশ অমান্য করে। ট্যাবলয়েড সাইজের চার পৃষ্ঠার পত্রিকা সাপ্তাহিক সৈনিক একুশে ফেব্রুয়ারি বের করে বিশেষ সংখ্যা। সেদিন পত্রিকাটিতে লাল কালিতে ব্যানার করা হয়, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ।’ ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন তথ্যের সংযোজনে এ বিশেষ সংখ্যার তিনটি সংস্করণ বের করে সাপ্তাহিক সৈনিক। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ সৈনিক অফিস ঘেরাও করে এবং পত্রিকাটির সম্পাদক আবদুল গফুর এবং প্রকাশক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে গ্রেপ্তার করে। এর ফলে পত্রিকাটির প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলন সমর্থক অন্যান্য পত্রিকা
বাংলা ভাষা-সমর্থক অন্যান্য দৈনিকের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ ও দৈনিক আমার দেশ। একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদ ছাত্রদের নিয়ে দৈনিক মিল্লাতে ব্যানার শিরোনাম করা হয়েছিল, ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’ এ ঘটনার পর মিল্লাতের সম্পাদক মো. মোদাব্বেরের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে পরে নূরুল আমিন বিষয়টির সমাধান করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক চাষীর একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয় ঢাকা থেকে। পুলিশ ওই দিন সন্ধ্যায় চাষীর অফিস ঘেরাও করে মুদ্রণ সরঞ্জাম ও সব পত্রিকা নিয়ে নেয়।
ভাষা আন্দোলনে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকও জোরালো ভূমিকা পালন করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘দেশের অযুত কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদের ঘোষণা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের হোতা সরকারের বিচার চাই প্রকাশ্য গণআদালতে।’
মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা ভঙ্গ হয় ভাষা ইস্যুতে। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এ বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল সংবাদপত্রে। আর সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে তা হয়ে ওঠে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সেই সময়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র বাংলা ভাষার পক্ষে পালন করেছিল সোচ্চার ভূমিকা। কোনো কোনোটি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চালিয়েছিল নির্লজ্জ প্রচারণা। আর ভাষার প্রশ্নে কয়েকটি পত্রিকা ছিল দ্বৈত ভূমিকায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা বিতর্কের অবসান ঘটে। রক্তের দামে বাঙালি কেনে তার মাতৃভাষা—‘বাংলা’।
No comments