অমর একুশে-মাতৃভাষার সর্বজনীনতা by মোহীত উল আলম

বৃহস্পতিবার ঠিক বেলা তিনটার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। দিনটি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। স্থান ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা। চিত্রগ্রাহক আমানুল হকের ক্যামেরায় ধরা পড়ল শহীদ রফিকউদ্দিনের গুলি-খাওয়া মাথার মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে থাকার ছবি। একুশের প্রথম শহীদ।


একই দিনে মারা যান আরও চারজন—বরকত, জব্বার, সালাম আর বালক অহিউল্লাহ। এর পরদিন মারা যান শফিউর।
উপরিউক্ত শহীদদের রক্ত দানে সৃষ্টি হলো অমর একুশের, যার ভ্রূণ থেকে জন্ম নিল বাংলাদেশ এবং ২০০০ সালে ইউনেসকো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ যেন একজন শিশুর বিশ্বনাগরিকে পরিণত হওয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলা ভাষার এ জয়যাত্রার ওপর কিছু চিন্তার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য আজকের রচনা।
আঞ্চলিক ভাষা ও জাতীয় ভাষার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে প্রথমে একটি প্রশ্ন তুলছি। প্রথম আলোর একটি বিগত সংখ্যায় মাতৃভাষার সর্বজনীনতার ওপর একটি কলাম ছাপালে জনৈক পাঠক প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের সবার মাতৃভাষা যে বাংলা, এটা আপনাকে কে বলল। আমার মায়ের ভাষা চট্টগ্রামের।’ ভারতীয় সরস ইংরেজি লেখক খুশবন্ত সিং বলেছিলেন, ‘আমার মাতৃভাষা ইংরেজি, কিন্তু আমার মা একবর্ণ ইংরেজি জানেন না।’ (তবে সরদারজির কথাটি মানতে আমাদের একটি ঢোঁক গিলতে হবে। কেননা জন্মগতভাবে তিনি পাঞ্জাবি, যদিও লিখেছেন সারা জীবন ইংরেজিতে।) ভাষাবিদ গোলাম সারোয়ার চৌধুরী আমাকে জানালেন, এ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এ জন্য, সব জাতীয় বা মাতৃভাষার উৎপত্তিই আসলে আঞ্চলিক ভাষা থেকে। রাজধানীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ভাষাই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিকভাবে পরিপুষ্ট হয়ে প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জন করে জাতীয়, মাতৃ বা রাষ্ট্রভাষায় পরিগণিত হয়। মোটামুটি সব বিশ্বভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে এ তত্ত্ব প্রায় নির্ভুল মনে হয়। ল্যাটিন রোমকেন্দ্রিক, ইংরেজি লন্ডনকেন্দ্রিক এবং বাংলা কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষা হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকরণ, ব্যবহার ও উচ্চারণের এত বিপুল তফাত দেখে বছর দশেক আগে এ প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছিল যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আসলেই বাংলাভাষা-জাত কি না। সাহিত্য বিশারদ আবদুল করিম, ড. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখসহ চট্টগ্রামবাসীর লেখা পড়ে রায় পেলাম, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বস্তুত বাংলা ভাষারই একটি অপভ্রংশ রূপ এবং আরাকানি রাজত্বের প্রভাবে এটি বিপুলভাবে সংকরায়িত হয়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রায় নিঃসম্পর্কিত একটি আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। তাই অন্য যেকোনো জেলার লোকের মতো চট্টগ্রামের লোকের মাতৃভাষা বা জাতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। চট্টগ্রামের কেউ শুধু আঞ্চলিক ভাষা জানলেও তার মাতৃভাষা ধর্তব্য হবে বাংলা বলে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃভাষার সঙ্গে বোধশক্তির উদয় বা বোধগম্য তৈরি হওয়ার স্বাভাবিক সম্পর্কটি: ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।’ রবীন্দ্রনাথের এক বড় ভাই, সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনিয়েছিলেন কথাটি। এ কথা খণ্ডন করার জন্য দেশে একটি ক্ষেত্র তৈরি আছে। যেমন যে বাঙালি শিশু ছোটকাল থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে বড় হয়েছে, তার পক্ষে বাংলা না জেনেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব, এমনকি লেখালেখির জগতেও। বছর দুয়েক আগে হোটেল ওয়েস্টিনের এক সমাবেশে ভারতীয় বাঙালি কিন্তু ইংরেজি ভাষার বিশ্বব্যাপী পরিচিত ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি যে ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নিয়েছেন, এর জন্য বাংলা ভাষার ব্যবহার না করার প্রশ্নে তাঁর মনে কখনো কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল কি না। তিনি পরিষ্কার বললেন, না, কখনো তাঁর মনে এ প্রশ্ন আসেনি। অমিতাভের দ্য শ্যাডোলাইনস ও দ্য গ্লাস প্যালেস উপন্যাস দুটি মূলত পাক-ভারত উপমহাদেশে দেশ বিভাগের মতো রাজনৈতিক অর্বাচীনতার বিরুদ্ধে এক মর্মস্পর্শী মানবিক দলিল। কিন্তু তিনি এ বিষয়েও সচেতন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ প্ররোচনায় একটি দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক সাম্প্রদায়িক কূটনৈতিক চাল থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং যার ফল স্বরূপ যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, এর একটি দৃশ্য আগে উল্লিখিত খুশবন্ত সিংয়ের উপন্যাস ট্রেইন টু পাকিস্তান-এ বর্ণিত হয়: এক ট্রেনবাহী মুসলমানের লাশ গেল অমৃতসর থেকে লাহোরে এবং আরেক ট্রেনবাহী হিন্দুর লাশ গেল লাহোর থেকে অমৃতসরে। তাই আশা করা হয়েছিল, অমিতাভ পলাশীর যুদ্ধের পেক্ষাপট নিয়েও উৎসাহিত হয়ে একটি উপন্যাস ওই পটভূমিতে লিখবেন। কারণ, তাঁর প্রতিভা ইতিহাস-সচেতনতা ও সৃজনশীল কাহিনি রচনার সমন্বয় সাধনে পটু। পরে একটি সভায় তাঁকে পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে কোনো উপন্যাস রচনা করার পরিকল্পনা আছে কি না এ-সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হলে তিনি ঝটতি প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন। তাঁর নাকচের ফলে ধারণা করা যায়, পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) নবাব সিরাজদ্দৌলার পতন আর ব্রিটিশদের প্ররোচণায় ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের মধ্যে তিনি কোনো সম্পর্ক খুঁজে পান না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার বীজটি তিনি উদ্ঘাটন করতে চান না। অথচ যে অশুভ বীজটির কারণে পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানে বাংলা ভাষা নিগৃহীত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, যেটি থেকে মুক্তি পেতে অমর একুশে এবং ঘটনা পরম্পরায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
অমিতাভ ঘোষের এ বিফলতার কারণে উপস্থিত শ্রোতাদের মনে হয়তো এ প্রশ্ন উঠেছিল যে পলাশীর যুদ্ধ আর ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্কটি নিয়ে তিনি কি গভীরভাবে চিন্তা করেননি; না করলে কেন করেননি। এ প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনার ধারায় ভারতীয় ইংরেজি ভাষায় রচনাকারী লেখকদের প্রসঙ্গে একটি কথা বলা হয়, তাঁদের উপন্যাসে ভারতীয় প্রবাসীদের জীবন ও দ্বান্দ্বিকতা হচ্ছে মূল বিষয়, কিন্তু মূল ভারতবর্ষের প্রকৃত মানুষের জীবনকাহিনি থাকে অবাঞ্ছিত কিংবা প্রান্তিক, যদিও অরবিন্দ আদিগার দ্য হোয়াইট টাইগার এ দিক থেকে ব্যতিক্রম।
মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে গভীর বোধসম্পন্নতা ও বোধগম্য তৈরি হয়, সেটি বিদেশি ভাষার মাধ্যমে কখনো হয় না। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্মারকপত্র ২০১২-তে ‘অমর একুশের ষাট বছর’ শীর্ষক একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা লিখেছেন। সেখানে মাতৃভাষার সর্বগামিতার প্রশ্নে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কিম্বার্লি ল্যাংগুয়েজ রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তা জুন অস্কারের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। যিনি বলেছেন, ‘আপনি নিজের অনুভূতি যেভাবে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন, সেভাবে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনি অনুভব করতে এবং বুঝতে পারছেন কী বলা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক তা মাথায় ঢুকছে না।’ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছদটি গভীর বোধ বাড়ানোর জন্য মাতৃভাষার সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা। রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছেন, ‘ছেলেরা মাতৃভাষা একটু একটু করে বাঁধ বেঁধে বেঁধে পাকা করে শেখে না। তারা যা জেনেছে এবং যা জানে না সমস্তই তাদের উপর অবিশ্রাম বর্ষণ হতে থাকে...হতে হতে কখন যে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে ওঠে তা টেরই পাওয়া যায় না।’
মাতৃভাষার এ ‘অবিশ্রাম বর্ষণের’ কারণে ব্যক্তিগত চৈতন্য, বোধ, জাতিগত শিক্ষা, বোধগম্যসহ জাতীয় ধীশক্তি বাড়ে। সহজভাবে জিনিসটি বোঝানো যায়: শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচিতে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্টভাষা হিসেবে যখন যুক্ত করার কথা বলেছিলেন, তখন তাঁর যুক্তি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক (তখন ছয় কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল চার কোটি ৪০ লাখ) বাংলায় কথা বলে। এতৎসংখ্যক লোকের জীবনবোধ গড়ে উঠবে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে লাগল, তখন বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলে সংশয় বাড়তে থাকে। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক বছরের মধ্যে যখন ১৯৪৮ বা ’৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি কার্জন হলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’
ড. শহীদুল্লাহর বক্তব্যের ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা, তথা যেকোনো ভাষার, নিহিত চরিত্র হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান উভয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবনবোধ, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে—এটা হবে মূল লক্ষ্য। সেখানে বাংলাকে গর্হিত করে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে তিনি বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্টভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে—এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
বঙ্গবন্ধুর এ ক্ষোভযুক্ত বাণী যে পেক্ষাপটে উচ্চারিত হয়েছিল, সে প্রেক্ষাপট যে এখনো খুব বদলেছে তা নয়। যা বদলাচ্ছে সেটা যে বাংলার প্রতি প্রীতি বা বাংলায় দক্ষতা বেড়ে গেছে বলে বদলাচ্ছে তা নয়, বেড়েছে ইংরেজির প্রতি প্রীতি বজায় থেকে এবং নানা কারণে ইংরেজিতে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। অর্থাৎ ওই চেতনা এখনো কাজ করছে যে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বুঝি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
বুদ্ধির মুক্তি ও জ্ঞানের পথে দেশের কিছু মানুষকে নয়, সব মানুষকে সহযাত্রী করতে চাইলে বাংলা ভাষার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
 অধ্যাপক মোহীত উল আলম: সভাপতি, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.