আজও কাঁদে ভাষা শহীদের আত্মা by রেজাউল আলম নোমান

১. ১৯৪৭ সালে ইংরেজ দস্যুরা চলে গেলে প্রশ্ন ওঠে ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা কী হবে। উর্দু না বাংলা_এই প্রশ্নে পুরো পূর্ববাংলা ঐক্যবদ্ধ হয় বাংলা ভাষার পক্ষে। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা, যার গভীর প্রভাব পরবর্তী প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের মধ্যে দেখা গেছে এবং যার গুরুত্ব এখন পর্যন্ত


কমেনি। সহজ কথায় ভাষা আন্দোলন বা ০৮ ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক, অধিকার আদায়ের প্রথম বিদ্রোহ।
২. যেকোনো জাতির জন্য তার ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমানে বাংলা ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণের জন্য সবার আগে কবি, সাহিত্যিক, গণমাধ্যমকর্মী এবং সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং সংরক্ষণের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান 'বাংলা একাডেমী'। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজই হচ্ছে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণ। অথচ এর নামের অর্ধেক হচ্ছে ইংরেজি। এমনিভাবে আমাদের বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠিত। তাই বাংলা ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির জন্য সবার আগে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নামকরণে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৩. বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা ব্যবহারের অসংগতির কথা বললে বলতে হয়, বাংলা ভাষার পুরোটাই অসংগতিপূর্ণ। এই অসংগতি শুরু হয়েছে সমাজের শিক্ষিত সমাজ থেকে, যাঁরা কথায় কথায় ইংরেজি বলতে গর্ববোধ করেন। ফলে মিথ্যা অহমিকার কুপ্রবাহে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভুল উচ্চারণে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছে এবং এই অসংগতি বর্তমান প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে অবহেলার বিষয় করে তুলেছে।
৪. ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল উচ্চ আদালত থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পরেও বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি কোথাও বরং দিনে দিনে বাংলা ভাষা বাংলাদেশেই নির্বাসিত হচ্ছে। তাই সরকার ও গণমাধ্যমকে একযোগে জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য কাজ করতে হবে। যেমন চাকরির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় দক্ষতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করতে হবে। গণমাধ্যমের উচিত শুধু ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে কাজ না করে সারা বছর প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
৫. ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণের জন্য সরকারকে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমীর গবেষণাধর্মী কাজ করতে হবে। যা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে সহায়তা করবে। এসব জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই-পুস্তক রচনার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
৬. প্রাচীন চর্যাপদ ও পালি থেকে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, ১৯৫২ পর্যন্ত বাংলা ভাষার ওপর বিভিন্ন বিদেশি ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে বর্তমানে বাংলা ভাষার ওপর ইংরেজি ভাষার প্রভাব এতটাই প্রবল যে মনে হয় আমাদের ভাষাসৈনিক ও শহীদের রক্ত ঝরেছে ইংরেজি ভাষার জন্য। এই প্রভাব এতটাই লজ্জার যে আমরা আজকে ৮ ফাল্গুন ভুলতে বসেছি একুশে ফেব্রুয়ারির আড়ালে। ভাষার মাসে আমাদের জাতীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন, তখনো তাঁরা বিনা লজ্জায় ইংরেজি শব্দের ব্যাপক অপপ্রয়োগ করে কথা বলেন। ইংরেজিতে কথা বলতে পারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি সর্বস্তরের অবহেলায় বহু শ্রুতিমধুর বাংলা শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ভাষার প্রভাবে বর্তমান প্রজন্ম বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাই আমাদের সরকার ও গণমাধ্যমের উচিত বিশ্বভাষার দাবিদার বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষার কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর না হয় বাংলা ভাষার স্থান হবে শুধু অভিধানে।
৭. বাংলা ভাষা বিশ্বভাষা হবে_এটা এখন সময়ের দাবি। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিককরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে জাতিসংঘে আবেদন করেছেন। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে হলে সরকার ও দেশের গণমাধ্যমকে একযোগে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন_(ক) বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা, (খ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের মাতৃভাষায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তুলে ধরা ও বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচারণা চালানো।

No comments

Powered by Blogger.