নিভৃতে কাঁদে আজ মায়ের ভাষা by সনেট দেব
একুশ বাঙালি জাতির, একুশ বিশ্ববাসীর। রফিক, শফিক, বরকত, সালামদের রক্ত আজ কথা বলছে বিশ্বজুড়ে। দেশের সীমানা পেরিয়ে বায়ান্ন আজ নোঙর করেছে বিশ্ব বন্দরে। দেশে-বিদেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মাতৃভাষার প্রেমের এই অমর গাথা আমাদের একুশ।
দেশের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত ছিল এই একুশেই। তাই একুশ আমাদের দুর্লভ অহংকার, একুশ আমাদের চেতনার সূর্যোদয়। আজ এই একুশ বিশ্ববাসীর এক সুলভ অলংকার।
আজ আমাদের পুরো দেশ পশ্চিমা ভাষা ও সংস্কৃতিকে যেভাবে আপন করে নিতে শুরু করেছে, তা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষার চেতনা কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আমরা পাচ্ছি এক অশনিসংকেত। যদি এখনই মাতৃভাষার সংরক্ষণে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিই, সেই অশনিসংকেত সমাজের সর্বস্তরে পেঁৗছানো না যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখের ভাষায় থাকবে বিদেশি ভাষার অপদখল। আমাদের মায়ের ভাষা পেঁৗছাবে বিকৃতির চরম পর্যায়ে। এ চরম সত্যকে উপলব্ধি করে কবিগুরু বড় আক্ষেপ করে বলেছেন, 'আমরা রাষ্ট্রক্ষেত্রে স্বরাজ পাবার জন্য প্রাণপণ দুঃখ স্বীকার করি কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বরাজ পাবার উৎসাহ জাগেনি বললেই চলে।' সাতচলি্লশ, বায়ান্ন আর একাত্তর পেরিয়ে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা বিদেশি ভাষার আগ্রাসন থেকে মুক্ত তো হতে পারিইনি বরং তা আমাদের ভাষাকে আরো যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে।
একসময় আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল শুধু আমাদের নিজের প্রাণের ভাষার জন্য, নিজেদের মায়ের ভাষার জন্য। কিন্তু আজ আর তা শুধু আমাদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। বিশাল সমুদ্রের বিস্তারে একটি প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ যেমন প্রবাহিত হয় সমুদ্রজুড়ে, ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির মাতৃভাষাপ্রেম, প্রেরণা ও চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। এ বিস্তৃতি চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে ইউনেসকোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর তখন থেকে বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতি উন্নত শির নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এক নতুন রূপে। কারণ একমাত্র আমরাই সেই জাতি, যারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম মায়ের ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসার স্বরূপ। মাতৃভাষার জন্য আমরা জীবন দিতেও পিছপা হইনি।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতির অবাধ আহ্বানে অতিক্রম করেছি কুসংস্কার, বিদ্বেষ ও হীনমন্যতার প্রতিবন্ধকতা। আমাদের জাতীয়তাবোধের চেতনা, মুক্তি সংগ্রাম, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের ঐকান্তিকতা আমাদের নিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধের এসব ঘটনাপ্রবাহের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে। ভাষা হলো একটি বিমূর্ত বিষয়। স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের অন্য সব দাবি যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, দৈহিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ; সে তুলনায় মাতৃভাষার অধিকার একটি প্রান্তিক প্রাপ্তি। বস্তুত, আমাদের অধিকার অর্জনের জন্যই একটা মানসিক প্রস্তুতি চাই, যা সৃষ্টি হয় একটি মূল্যবোধ এবং একটি চেতনার সঞ্চারণে। বায়ান্নতে মাতৃভাষার অর্জন ছিল তেমনই একটি মূল্যবোধ।
যে ভাষার জন্য এত রক্ত, এত ত্যাগ সেই ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পর যখন দেখি ভাষাশহীদদের প্রতি মাত্র দায়সারাভাবে এক দিনই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, সচেতন মহলেও ঘটে ভাষার বিকৃত ব্যবহার_তখন আক্ষেপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আফসোস, আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চাই। যে ভাষার জন্য ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ, সে ভাষার কথা বেমালুম ভুলে যাই। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারের বেদিকে ধুয়েমুছে ঝকঝকে, তকতকে করে নানা রঙে রাঙিয়ে তুলি। দিন শেষে একে একে হারিয়ে যায় শেষ রেশটুকুও। ভাষার রক্ষণাবেক্ষণ সে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের প্রতীক আমাদের শহীদ মিনার। কত লেখালেখি, কত মিছিল-সমাবেশ, কত মানববন্ধন! তবু বেরিয়ে আসা গেল না সেই চিরাচরিত বলয় থেকে। আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিজড়িত স্মৃতি রক্ষা করতে না পারি, তাহলে ভাষাশহীদদের এ আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে।
দৈবসিক হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে একুশের মাহাত্ম্য আজ ম্লান হতে চলেছে। তাজা রক্তের বিনিময়ে যে ভাষার অধিকার অর্জিত হলো, তার মর্যাদা আজ নিজ দেশেই পরবাসী। ইংরেজি শিখতে আপত্তি নেই কিন্তু আমাদের ভাষায় তার অনধিকার প্রবেশ রুখতে হবে। জেগে উঠুক বাংলাদেশ ভাষার অম্লান সুরভিতে, এ হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার।
আজ আমাদের পুরো দেশ পশ্চিমা ভাষা ও সংস্কৃতিকে যেভাবে আপন করে নিতে শুরু করেছে, তা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষার চেতনা কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আমরা পাচ্ছি এক অশনিসংকেত। যদি এখনই মাতৃভাষার সংরক্ষণে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিই, সেই অশনিসংকেত সমাজের সর্বস্তরে পেঁৗছানো না যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখের ভাষায় থাকবে বিদেশি ভাষার অপদখল। আমাদের মায়ের ভাষা পেঁৗছাবে বিকৃতির চরম পর্যায়ে। এ চরম সত্যকে উপলব্ধি করে কবিগুরু বড় আক্ষেপ করে বলেছেন, 'আমরা রাষ্ট্রক্ষেত্রে স্বরাজ পাবার জন্য প্রাণপণ দুঃখ স্বীকার করি কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বরাজ পাবার উৎসাহ জাগেনি বললেই চলে।' সাতচলি্লশ, বায়ান্ন আর একাত্তর পেরিয়ে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা বিদেশি ভাষার আগ্রাসন থেকে মুক্ত তো হতে পারিইনি বরং তা আমাদের ভাষাকে আরো যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে।
একসময় আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল শুধু আমাদের নিজের প্রাণের ভাষার জন্য, নিজেদের মায়ের ভাষার জন্য। কিন্তু আজ আর তা শুধু আমাদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। বিশাল সমুদ্রের বিস্তারে একটি প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গ যেমন প্রবাহিত হয় সমুদ্রজুড়ে, ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির মাতৃভাষাপ্রেম, প্রেরণা ও চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। এ বিস্তৃতি চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে ইউনেসকোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর তখন থেকে বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতি উন্নত শির নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এক নতুন রূপে। কারণ একমাত্র আমরাই সেই জাতি, যারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম মায়ের ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসার স্বরূপ। মাতৃভাষার জন্য আমরা জীবন দিতেও পিছপা হইনি।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতির অবাধ আহ্বানে অতিক্রম করেছি কুসংস্কার, বিদ্বেষ ও হীনমন্যতার প্রতিবন্ধকতা। আমাদের জাতীয়তাবোধের চেতনা, মুক্তি সংগ্রাম, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের ঐকান্তিকতা আমাদের নিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধের এসব ঘটনাপ্রবাহের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে। ভাষা হলো একটি বিমূর্ত বিষয়। স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমাদের অন্য সব দাবি যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, দৈহিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ; সে তুলনায় মাতৃভাষার অধিকার একটি প্রান্তিক প্রাপ্তি। বস্তুত, আমাদের অধিকার অর্জনের জন্যই একটা মানসিক প্রস্তুতি চাই, যা সৃষ্টি হয় একটি মূল্যবোধ এবং একটি চেতনার সঞ্চারণে। বায়ান্নতে মাতৃভাষার অর্জন ছিল তেমনই একটি মূল্যবোধ।
যে ভাষার জন্য এত রক্ত, এত ত্যাগ সেই ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পর যখন দেখি ভাষাশহীদদের প্রতি মাত্র দায়সারাভাবে এক দিনই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়, সচেতন মহলেও ঘটে ভাষার বিকৃত ব্যবহার_তখন আক্ষেপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আফসোস, আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চাই। যে ভাষার জন্য ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ, সে ভাষার কথা বেমালুম ভুলে যাই। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারের বেদিকে ধুয়েমুছে ঝকঝকে, তকতকে করে নানা রঙে রাঙিয়ে তুলি। দিন শেষে একে একে হারিয়ে যায় শেষ রেশটুকুও। ভাষার রক্ষণাবেক্ষণ সে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের প্রতীক আমাদের শহীদ মিনার। কত লেখালেখি, কত মিছিল-সমাবেশ, কত মানববন্ধন! তবু বেরিয়ে আসা গেল না সেই চিরাচরিত বলয় থেকে। আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসবিজড়িত স্মৃতি রক্ষা করতে না পারি, তাহলে ভাষাশহীদদের এ আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে।
দৈবসিক হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে একুশের মাহাত্ম্য আজ ম্লান হতে চলেছে। তাজা রক্তের বিনিময়ে যে ভাষার অধিকার অর্জিত হলো, তার মর্যাদা আজ নিজ দেশেই পরবাসী। ইংরেজি শিখতে আপত্তি নেই কিন্তু আমাদের ভাষায় তার অনধিকার প্রবেশ রুখতে হবে। জেগে উঠুক বাংলাদেশ ভাষার অম্লান সুরভিতে, এ হোক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার।
No comments