উত্তর জনপদে শীতের তাণ্ডবঃ সাহায্যের হাত বাড়ান
পৌষের শীতে কাঁপছে সারা দেশ। তীব্র, মাঝারি ও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত ক’দিন ধরে, সে সঙ্গে ঘন কুয়াশা। বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি শীতাক্রান্ত দেশের উত্তরাঞ্চল। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে তীব্র শীতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। শীতজনিত রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অগণিত মানুষ।
শীতবস্ত্রের অভাবে ছিন্নমূল ও স্বল্প আয়ের মানুষ ঘরের বাইরে বেরুতে পারছে না। অনাহারে-অর্ধাহারে বিপন্ন হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। কোথাও কোথাও সারাদিনেও সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। অনেকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। ঘন কুয়াশার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে যানবাহন চলাচল। সব মিলিয়ে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে পৌষের শৈত্যপ্রবাহে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের একাধিক জেলায় শীত ও কুয়াশাজনিত রোগে বিপুল পরিমাণ বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আসন্ন বোরো আবাদ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
শীতের এই বহুমুখী আক্রমণের মুখে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সার্বিক সাহায্য-সহায়তা মোটেই যথেষ্ট নয়। প্রশাসনের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ শীতের কাপড় পাওয়া গেছে, জনসংখ্যার অনুপাতে তা খুবই অপ্রতুল। ঠাণ্ডাজনিত অসুখ-বিসুখ মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্যের অভাব মেটানোর পর্যাপ্ত তত্পরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এবার সবচেয়ে শীত নেমেছে সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। ৩ জানুয়ারি তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের প্রকোপে মারা গেছে ১৬ জন। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, রাজশাহী বিভাগসহ, কুষ্টিয়া ও শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকার ঝুঁকি রয়েছে। এসব অঞ্চলে শীতে কাহিল হতদরিদ্র মানুষের কাছে দ্রুত শীতবস্ত্র পৌঁছে না দিতে পারলে দুর্ভোগের মাত্রা স্বভাবতই বেড়ে যাবে। স্রেফ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত লোকদের বাঁচাতে সাধারণ ওষুধপথ্য সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। এরই মধ্যে বয়স্ক ও শিশুদের ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়াসহ রোগ-সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। কোথাও কোথাও হাসপাতালে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না বলে খবর পাওয়া গেছে। এদিকে আগাম দুঃসংবাদের আরেক পটভূমি তৈরি করেছে এবারের শীত। জানা গেছে, বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরের ৮ জেলার ৩৫টি উপজেলার কয়েক লাখ বোরো চাষীর ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীত ও কুয়াশায় এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ শতাংশ বোরো বীজতলা ধ্বংসের পথে। এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে ১৩ হাজার হেক্টর জমির বীজতলা। সংশ্লিষ্ট কৃষকদের নতুন করে বীজতলা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শীতের প্রকোপ না কমলে পরিস্থিতি আরও সঙ্কটজনক হতে পারে। এছাড়া রাতভর ঘন কুয়াশার কারণে রাজশাহী অঞ্চলে আলুর ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। আমের মুকুল ঝরে পড়ার জন্যও এই কুয়াশা ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। এ অবস্থায় সাধারণ কৃষকরা ফসল রক্ষায় তত্পর হতে পারছেন না শীতের উপদ্রবে। গরিব শ্রমিক যেতে পারছেন না কাজে, রোজগার বন্ধ তাদের।
শীতাক্রান্ত মানুষের প্রথম দাবি শীতবস্ত্র এবং অসুখের ওষুধ। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা খুবই সামান্য। সম্প্রতি প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন এবং দলের সবাইকে এ কাজে তত্পর হতে আহ্বান জানিয়েছেন। দৈনিক আমার দেশ শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে ঢাকা ও রাজশাহী অঞ্চলে। সরকারি দলসহ সব রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও দ্রুত সাহায্য কার্যক্রমের উদ্যোগ জোরদার করা দরকার। সরকারপক্ষ থেকে আরও আগেই এ ব্যাপারে আগাম কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত ছিল। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত শীতের শুরুতেই পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন ছিল জরুরি। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও সেই অভিযোগ, সরকারিভাবে শীতবস্ত্রসহ অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী পৌঁছেনি শীতার্ত জনপদে। সামনেই মাঘ মাস। কাজেই পৌষেই শীত যাবে এমন নয়। এ কথা মাথায় রেখে শীতবস্ত্র বিতরণসহ শীতার্ত লোকের চিকিত্সা নিশ্চিত করতে ওষুধ-পথ্য, গরিবদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রাখা দরকার। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দিকেও নজর দিতে হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের। পাশাপাশি ধনাঢ্য মানুষ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, গণপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোকেও মানবিক কারণে দাঁড়াতে হবে বিপন্ন মানুষের পাশে। নিশ্চয়ই দুস্থ মানুষ তাদের সাহায্য-সহানুভূতির ন্যায্য দাবিদার।
No comments