অপসংস্কৃতির হাত থেকে ভাষা রক্ষা এখন জরুরি by সাবিব আল রহমান

আমরা আজকে যে মাতৃভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি তা কোনো সহজ অর্জন নয়। আমরা বাংলা ভাষার ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চিত্র।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন জোরপূর্বক তাদের উর্দুকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল তখন আমাদের


বীর সন্তানরা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাঁদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন একটি জাতির জন্য মাতৃভাষা কতটা গুরুত্বের।
তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার সঙ্গে ১৯৫২ যেভাবে জড়িত তেমনিভাবে জড়িয়ে রয়েছে একুশও। এই একুশ আমাদের জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় দিনের মর্যাদা লাভ করেছে। এই একুশ বাঙালি জাতির অহংকার।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেই আমরা বাংলা ভাষাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাই এবং আজ তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে বিশ্বের মানুষের মনে চেতনা সঞ্চারকারী দিন হিসেবে পরিচয় লাভ করছে। আমাদের এই কষ্টার্জিত বাংলা ভাষা যেন কোনোভাবে বিলুপ্ত না হয় সে জন্য দরকার এর উপযুক্ত সংরক্ষণ। আর এর সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির দায়িত্ব আমাদের সবার। ভাষার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যেমন সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সতর্কতার দরকার এর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। মাতৃভাষা যেন খনির মতো অনন্ত রক্ত সম্পদের আকর। খনির মতো বাংলা ভাষাও অজস্র ঐশ্বর্য ও সম্ভাবনায় ভরপুর। ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে সরকার ও গণমাধ্যম। এদের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উত্তম সংরক্ষণ ও
সমৃদ্ধি সম্ভব।
সরকার বিভিন্ন বই-পুস্তকের মাধ্যমে ভাষা সম্প্রসারণের যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রশংসার দাবিদার। আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য গণমাধ্যমও ভূমিকা রাখছে। আমাদের ভাষাকে ভালোভাবে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের গণমাধ্যমকে ভাষার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে নাটক-চলচ্চিত্র রচনা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ অপসংস্কৃতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে কলুষিত করছে। তাই সরকারের প্রয়োজন বাংলা ভাষাকে সংরক্ষণ করার স্বার্থে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির হাত থেকে ভাষাকে রক্ষা করা। বাঙালির মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে তেমনি বৈচিত্র্য রয়েছে বাংলা ভাষার মধ্যে। আমাদের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যেমন গারো, মারমা, সাঁওতাল আমাদের অংশ তেমনি তাদের যে উপজাতীয় ভাষা তাও আমাদের বাংলা ভাষার অংশ। তাই এরও রয়েছে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা। তাই ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষাকে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এর জন্য সরকার বিভিন্ন ভাষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষাকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারে। বাংলা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা। তাই এর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার মাত্রাটাও অত্যন্ত প্রখর। আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষায় যখন বিদেশি ভাষার আগমন ঘটে তা কখনো আমাদের জন্য মঙ্গলের বলে বিবেচিত হতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে একটি শিশু বেড়ে ওঠে সঠিকভাবে। এর সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশু ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। কিন্তু শুনতে অত্যন্ত কষ্টের হলেও সত্য যে আজ আমাদের বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। অনেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গিয়ে দেশের প্রতি, দেশের ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও শ্রদ্ধাহীনতার মনোভাব তৈরি করছে। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরে গর্বে ফেটে পড়ছেন। তাই বিদেশি ভাষার কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পেতে না পারলে আমাদের অতি কষ্টে অর্জিত বাংলা ভাষা ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
আমাদের মাতৃভাষা অর্জনের ইতিহাস যেমনি কষ্টের তেমনি গর্বের এবং অহংকারের। কষ্টার্জিত মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার। বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমাদের ভাষার প্রচার-প্রসার ঘটাতে হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। গণমাধ্যমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে বিভিন্ন সংবাদপত্র মাধ্যম, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি।
গণমাধ্যমগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার-প্রসারের দ্বারা আন্তর্জাতিক অজ্ঞানে বাংলা ভাষার বর্তমানে যে স্থান তা আরো এগিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করি।

No comments

Powered by Blogger.