উ ৎ সব-মনু নদে নৌকাবাইচ
দুপুরের পরই পাল্টে গেল চেহারা। যে নদীর দুই পাড়ে দাঁড়ানো বৃক্ষের বাতাসে দোল খাওয়া ছাড়া নির্জন, নীরব; মাঝেমধ্যে বর্ষার জলে দু-একটি বালুবাহী নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই, সেই নদীটি হঠা ৎ করেই সরব হয়ে উঠল। দুই পাড়ে কিলবিল করা হাজারো মানুষ। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মানুষে মানুষে সয়লাব।
নদীতে ছোট-বড় অনেক নৌকা। এটা ছিল ১০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মনু নদের ছবি।
এমনিতে বর্ষাকালে মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি উ ৎ সের খরস্রোতা এই নদীটি হয়ে ওঠে ভয়ংকর। দুই পারের গ্রামবাসীর চোখের ঘুম কেড়ে নেয় স্রোতের গর্জন। আতঙ্কের সঙ্গে চলে তখন মানুষের বাস—কখন নদী পাড় ভাঙে, কখন হয়ে ওঠে কূলবিনাশী। নদী এমন হলে তার পরিণতি কী হতে পারে? মানুষ তা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছে। ডোবে ফসল, ডোবে রাস্তাঘাট, মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ এখন ভুলে গেছে মনুর সেই ভয়ংকর রূপটি। মানুষের চোখে এখন মনু আদরের, উ ৎ সবের এক রুপালি শরীর। তার বুকে এখন সাঁতার কেটে মাছের মতো ছুটে চলবে রঙিন নৌকা। মাঝি ও পাইকের ছন্দময় বৈঠা চালানো এবং তাদের মুখে মুখে সারিগান হবে। মানুষের তাই অধীর অপেক্ষা।
দুপুর গড়িয়ে যেতেই পাড়ে পাড়ে মানুষের আর ঠাঁই নেই। যেখানেই দাঁড়ানোর একটু সুযোগ আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে, বসে কত রকমের মানুষ। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ। শুধু কি তীরেই মানুষ? মৌলভীবাজার শহরের উঁচু দালান, নদীপারের ঘরবাড়ির ছাদে, জানালায়, বারান্দায় মানুষের মুখ। সবার চোখ মনুর বুকে। মনু নদের চাঁদনীঘাটের সেতুর কাছ থেকে বলিয়ারবাগ খেয়াঘাট পর্যন্ত একই চেহারা। মাঝেমধ্যেই দু-একটা বিচ্ছিন্ন ইঞ্জিনের নৌকা, কিংবা দৌড়ের নৌকা ছুটে যায়। তাতেই হইচই। দর্শকদের আর ধৈর্যে কুলোয় না। চি ৎ কার, চেঁচামেচি চলছে হরদম। এ তো নদীপারের কথা। শহরের চিত্রটাও নৌকাবাইচের সময় হঠা ৎ করে পাল্টে যায়। শহরের রাস্তা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। চিরচেনা মানুষ, রিকশা-গাড়ির জটলা নেই। অনেক দোকানপাটও এ সময় বন্ধ হয়ে যায়।
বেলা দুইটার দিকে শুরু হয় নৌকাবাইচ। মনু নদের সেতুর কাছ থেকে শুরু হয় দৌড়। শেষ হয় বলিয়ারবাগ খেয়াঘাটের কাছে। সে এক চোখ-ধাঁধানো সময়। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নৌকা সামনে থেকে উধাও। তীব্র গতিতে নৌকাগুলো জেতার জন্য প্রাণপণ ছুটে চলে। কোনো হিংসা-প্রতিহিংসা নেই। নির্মল এক আনন্দ। পানিতে বৈঠার ছলা ৎ ছলা ৎ শব্দ, ঢেউ। মুখে জারিগান। একেক নৌকায় একেক রকমের গান। ‘...এশকের খেলুয়া নাও মিরাশে দৌড়াও, মনরে মাসুকের ঘাটে জলদি লইয়া যাও...।’ এ ছাড়া বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের অনেক গানও মাঝিদের মুখে মুখে। সঙ্গে ঢোলের দ্রিমি দ্রিমি ও করতালের ঝনঝন আওয়াজ। নৌকাগুলোর নামও বেশ জমকালো। পঙ্খিরাজ, অজ্ঞান ঠাকুর, জয় জগন্নাথ, জলপবন, মধুকুঞ্জ...। মৌলভীবাজার জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে সাতটি নৌকা এই নৌকাবাইচে অংশ নেয়। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার দফা নৌকার বাইচ হলো। দর্শকের উ ৎ সাহের কমতি নেই। খাওয়াদাওয়া ভুলে সেই দুপুরবেলা তীরে এসে ঠাঁই হয়েছে। শেষ না দেখে যাওয়া যাবে না। শেষ দৌড় হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। এবার ফেরার তাড়া। মুখে মুখে বিভিন্ন নৌকার কেরামতি নিয়ে তখন সরব সবাই।
রাজনগর উপজেলার বাজুয়া গ্রামের আবদুর নূর (৬০) বলেন, ‘অনেক নৌকা দৌড়াইছি। বহু রকমের নৌকা ছিল। হাওরে ও নদীতে নৌকার দৌড় হতো। এখন তো আগের মতো দই (থইথই করা) পানি নেই।’ জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকেই এ অঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকাবাইচ প্রায় নিয়মিত ছিল। পাকিস্তান আমলে ১৪ আগস্ট মনু নদের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার থানার ঘাট এলাকায় প্রতিবছর নৌকাবাইচ হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাঝেমধ্যে বিরতি গেলেও মনু নদে নৌকাবাইচের রেওয়াজ এখনো চলছে। এবারের নৌকাবাইচে প্রথম হয়েছে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থেকে আগত নৌকা জলপবন, দ্বিতীয় হয়েছে মৌলভীবাজার সদরের উলুয়াইলের এরশাদ মিয়ার নৌকা এবং তৃতীয় হয়েছে মিনা বশিরের নৌকা। প্রথম পুরস্কার ছিল নগদ ১০ হাজার টাকা ও ২৯ ইঞ্চি টেলিভিশন, দ্বিতীয় আট হাজার টাকা ও ২১ ইঞ্চি টেলিভিশন ও তৃতীয় ছয় হাজার টাকা ও ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশন। এ ছাড়া নৌকাবাইচে অংশ নেওয়া প্রতিটি নৌকাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে মেলা শেষ হলেও অনেক দিন মানুষের মনে এই নৌকাবাইচের জলতরঙ্গ ও বাজনার রিনিঝিনি শব্দ বাজতে থাকবে।
আকমল হোসেন
প্রথম আলোর মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
No comments