ইউরোপ-দায়হীন উক্তির পরিণতি by ফারুক যোশী

ক্রান্তিকালে জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে একধরনের দায়হীন উক্তিই করছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। এতে করে জাতীয় ঐক্য শিথিল হচ্ছে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো মূলত ব্রিটেন এবং আমেরিকা যেন নুইয়ে পড়ছে ঋণের বোঝায়। ইউরোপের অন্য দেশগুলোও সেই একই পথে।
পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষের চাকচিক্যময় জীবনধারার মানসিকতায় এখন এক বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে উন্নত দেশগুলোর এই দৈন্য। গ্রিস তার দেউলিয়াত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে হাত পেতেছে। ইইউ ও গ্রিস এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বড় ধরনের সাহায্য প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে তাদের গত ২১ জুলাইর ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিদের একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায়। ইতালির অবস্থাও তথৈবচ।
গত তিন-চার বছর থেকেই এ দীনতা ক্রমশ গ্রাস করছে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে খ্যাত ব্রিটেনকে। দেশটির অর্থনীতি যেন থমকে পড়েছে। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক রিপোর্টে বেরিয়েছে দেশটির ভয়াবহ বেকারত্বের চিত্র। ২.৫ মিলিয়ন মানুষ বেকার। সরকারকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই বেকারদের অভিশাপ। দেশীয় সমাজ-রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস নির্মূলের ব্লেয়ার-বুশের তথাকথিত সূত্রে সারা পৃথিবীতে নেমে এসেছে নৈরাজ্য, লাখো লাখো নারী-শিশু-কিশোর হত্যাকাণ্ডে মানবতা হয়েছে বিপন্ন। মানবতা ভূলুণ্ঠিত করার একটা বৃহৎ অর্থ জোগান দিতে হয়েছে ব্রিটেনের মানুষেরই ট্যাক্সের অর্থ দিয়ে। আর সে কারণে সারা ইউরোপেই যেন চলছে ধীর কিংবা মন্থরগতি, অন্য অর্থে অর্থনীতিতে মন্দা। গত বছর তিনেক থেকে অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে আটকে থাকা ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মতোই ব্রিটেনও বেরিয়ে আসতে পারছে না মন্দার কবল থেকে। আইএমএফের যে অর্থনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্রতাত্তি্বকরা বলেছিলেন, ব্রিটেন ২০১১ সালে বেরিয়ে আসবে মন্দার করাল গ্রাস থেকে; তারাই বলছেন, আগামী বছরেও এটা সম্ভব নয়। এ রকম রাষ্ট্রীয় অবস্থার মাঝে ব্রিটেনের সাধারণ নাগরিকরা যেন আগের মতো নেই। সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে; কিন্তু কথাবার্তায় আছে এমন সব অসংলগ্নতা, যাতে করে ক্ষোভ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এমন সব কথাবার্তা বলছেন, যাতে মনে হচ্ছে মানুষের অধিকারগুলোই যেন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মাত্র মাস দেড়েক আগের ব্রিটেনে দাঙ্গার কথা ধরা যাক। এই দাঙ্গায় প্রতিফলিত হয়েছে অসাম্য আর বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট অপরাধপ্রবণতায় জড়িত তরুণ-তরুণীদের অপরাধের চিত্র। অথচ ডেভিড ক্যামেরন বলছেন উল্টো কথা। সিঙ্গল প্যারেন্টস সমস্যাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, তিনি বলছেন ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার কথা। কিন্তু উল্টো পিঠে একটিবারও সরকার কিংবা ডেভিড ক্যামেরন ধারণায়ই আনতে পারছেন না, সমাজব্যবস্থা ভেঙে যায় কেন? দীর্ঘদিনের একটি মজবুত ভিতের ওপর টিকে থাকা ব্রিটেনের সমাজব্যবস্থায় আঘাত আসার পেছনে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দায় বর্তায়। অথচ এ ব্যর্থতার দায় না নিয়ে ক্যামেরন রক্ষণশীল আচরণ করেই চাইছেন এ সমাজ তিনি জোড়া লাগিয়ে দেবেন। তিনি কুঠারাঘাত করতে চাইছেন বছর বছর ধরে চলমান বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ওপর। এসব সুযোগ-সুবিধা কোনো কোনো সময় এমনকি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করতেও পিছপা হচ্ছে না অনেকেই। দাঙ্গা-পরবর্তী কিছু অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। কারারুদ্ধ হচ্ছে অনেকেই। এই অপরাধীদের কেউ কেউ সরকারি ফ্ল্যাটে বসবাসকারী এমনকি তাদের মা-সহ বের করে দেওয়ার ডেভিড ক্যামেরনের পরিকল্পনাকে অনেকেই মানবতাবিরোধী হিসেবে মন্তব্য করছেন। তথাকথিত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে অতি সম্প্রতি ক্যামেরন সরকার ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম স্টুডেন্টদের (বিষণ্ন ও জনবিচ্ছিন্ন) ওপর বিশেষ নজরদারি করার একটা ফরমান জারি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি এই নজরদারির সরকারি নির্দেশনাকে মুসলিম জনগোষ্ঠী তো বটেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেকেই ভালোভাবে দেখছেন না। গত সপ্তাহে এক বক্তৃতায় ক্যামেরন ইংরেজি না জানা মানুষদের একভাবে শাসিয়েছেন। বক্তৃতায় বলেছেন, বেকারদের মাঝে যারা ইংরেজি জানেন না, ইংরেজি না জানার কারণে চাকরি পেতে যারা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের বেনিফিট কেটে দেওয়া হবে। ইংরেজি না জানা বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রায় ৭০ হাজার বেকার যদিও আছে, কিন্তু মোট বেকারদের বাকি ১.৮ মিলিয়ন বেকারদের বেনিফিটের কী হবে সেটা তিনি বলতে পারেননি। এই যখন সরকার প্রধানদের কথাবার্তা, ঠিক সে সময়েই বোমা ফাটিয়েছেন এক সময়ের কনজারভেটিভ দলের নেত্রী ব্যারোনেস শ্রীলা ফ্লেদার। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি কমিউনিটি বেনিফিটের লোভে বেশি সন্তান নেয়। তার এ কথাটি লুফে নিচ্ছে মূলধারার কাগজগুলো। লেখা হচ্ছে প্রবন্ধ-নিবন্ধ। অথচ এ কথাটি সঠিক নয়। বেনিফিটের একটা বড় অংশ যায় শ্বেতাঙ্গ বংশোদ্ভূতদের পরিবারকে বাঁচাতে আর ডেভিড ক্যামেরনের ব্রোকেন সোসাইটি জোড়া লাগানোর কাজেই।
এভাবে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বিশেষত সংখ্যালঘু অর্থাৎ অবহেলিত গোষ্ঠীর প্রতি একধরনের উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছে। বর্তমান মন্দাবস্থায় ব্যয় সংকোচন নীতি হয়তো অব্যাহত থাকবেই। ঢালাও অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি সেক্টরে চাকরিচ্যুতদের নতুন কর্মসংস্থানের জন্য প্রাইভেট সেক্টরে আশানুরূপ চাকরিও সৃষ্টি হচ্ছে না। এ অবস্থায় চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন ৮১ বিলিয়ন পাউন্ডের স্কিম হাতে নিয়েছেন। বিভিন্ন সেক্টর থেকে আগামী চার বছরে তিনি এ ৮১ বিলিয়ন পাউন্ড তোলে আনতে হাউস অব কমন্সে তার বক্তৃতায় নতুন তত্ত্বের কথা বলেছেন। সব মিলিয়ে ব্রিটেন যে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই ক্রান্তিকালে জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে একধরনের দায়হীন উক্তিই করছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। এতে করে জাতীয় ঐক্য শিথিল হচ্ছে। বহুজাতিক সমাজ-সভ্যতায় পারস্পরিক সন্দেহ দানা বাঁধতে সহায়তা করছে এ রকম দায়িত্বহীন উক্তি।

ফারুক যোশী :কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.