ভাষা ব্যবহারে যত্নশীল হওয়া দরকার by ফাতেমা তুজ জোহরা
'চিন্তা', 'সংকল্প' এবং 'অনুভব'_এ তিনের জন্যই মানুষ অন্য ইতরপ্রাণী থেকে উন্নততর। আর এ তিনের সমন্বয় ঘটিয়ে মানুষ তার নিজস্ব ভাবনা অন্যের কাছে পেঁৗছে দিতে একমাত্র যে অবলম্বনের আশ্রয় নেয় তার নামই-ভাষা। এ ভাষা-ই কোনো জাতির অন্যতম পরিচয় বাহক। তাই কোনো জাতিকে গ্রাস করতে হলে প্রথম আক্রমণ ঘটে তার ভাষার ওপর।
ঠিক এমনি এক ঘটনার কারণেই জন্ম হয় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির মতো ঘটনা। সে দিনের ঘটনা আজ আমাদের কারো অজানা নয়। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই চারপাশে ধ্বনিত হয় ভাষার কথা, কবিতা আর গান। যদিও 'একুশ' মানে 'চেতনার মুক্তি' আর 'একুশে ফেব্রুয়ারি' মানে 'বাঙালি মুক্তির প্রথম সংগ্রাম', তথাপি বর্তমান প্রজন্মের কাছে 'একুশ' কিংবা 'ফেব্রুয়ারি' মানে যেন কেবল বাংলা গান, কবিতা আর কথার পার্বণের কাল মাত্র।
বাংলা ভাষার ইতিহাস আমাদের জানান দেয়, সংস্কৃত অপভ্রংশ থেকে পালি ও প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে গড়ে উঠে আজকের এই বাংলা ভাষা। কিন্তু সদ্যজাত সেই বাংলার সঙ্গে আজকের এই বাংলার লিখিত কিংবা মৌখিক উভয় ক্ষেত্রেই বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শুধু ভাষা কেন যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রেই ক্রমাগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কেননা, কোনো কিছুই স্থবির নয় আর স্থবিরতা মানেই মৃত্যু। তা ছাড়া ভাষার উত্তরোত্তর বিকাশ সাধনের জন্য স্থান, কাল ভেদে পরিবর্তন আসবেই। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের দিনে ভাষার পরিবর্তন অবাস্তব কিছু নয়। কিন্তু পরিবর্তন হওয়া উচিত গঠনমূলক এবং আগ্রাসনমুক্ত। অথচ, আমাদের বর্তমান তরুণদের কথ্য ভাষার নামকরণ করা হয়েছে 'ডিজুস ভাষা' নামে। কারণ, বর্তমান তরুণরা (বিশেষত শহুরে) সাধারণত যে ভাষাতে কথা বলাকে তাদের 'স্ট্যাটাস ম্যাটার' বা 'স্টাইল' হিসেবে মনে করে সে ভাষাতে মূলত বাংলা বর্ণের বিকৃত উচ্চারণ হয়। এর মূল অনুসন্ধান করলে যে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টত খোলা চোখেই ধরা পড়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো, বিশ্বায়নের এ যুগে এক ভাষার ওপর অন্যকোনো ভাষার আগ্রাসন। আর আমাদের ভাষার ওপর ক্রমান্বয়ে হামলা এবং বীরবিক্রমে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা। ফলে কেবল যে ভাষার উচ্চারণ বিকৃতিই ঘটছে তা নয় উপরন্তু বর্ণমালার ওই বর্ণগুলোও অস্তিত্বের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিয়ে একটু আলোচনা করা যাক_হিন্দি বর্ণমালায় 'য' এই বর্ণটি নেই। তাই তারা 'যুবরাজ'-কে বলে 'ইয়ুবরাজ' কিংবা 'যাত্রা'-কে বলে 'ইয়াত্রা'। যা কিনা আমাদের এখনকার তরুণরা স্টাইল হিসেবেই দেখে। তাই আমাদের বর্ণমালায় 'য'-এর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তারা 'ইয়ুবরাজ' কিংবা 'ইয়াত্রা' বলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
যেকোনো দেশের অবস্থা কিংবা ভাষার পরিবর্তন বা পরিশোধনে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অতুলনীয়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিকল্প মিডিয়া এবং টেলিভিশনের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শহর-নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের চায়ের দোকানেও আজকাল টেলিভিশন দেখতে পাওয়া যায়। তাই এ যন্ত্রটির সাহায্যে প্রচারিত যেকোনো প্রচারণা অতিদ্রুত এবং কার্যকরীভাবে মানুষের কাছে পেঁৗছে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানাদির মূল লক্ষ্য ব্যবসা বা অর্থোপার্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যবসার সহজতম হাতিয়ার হিসেবে তারা কুক্ষিগত করেছে ভাষাকে। আমাদের প্রচলিত কথ্যভাষার নাম করে যেসব ভাষা নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও অন্য অনুষ্ঠানাদিতে ব্যবহৃত হয় তা প্রকৃত অর্থে ভাষার বিকৃতিকরণের অন্যরূপ মাত্র। কেবল, প্রিন্ট মিডিয়া ভাষার বিকৃতিতে এখনো গা ভাসিয়ে দেয়নি। কিন্তু তাই বলে ভাষা সংরক্ষণ ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য তেমন অনড় ও কঠিন কোনোরূপ কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ, এখনই উপযুক্ত সময় ভাষাকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করে গঠনমূলক ভাবে বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সমগ্র ভাষাকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিতে হলে ভাষা গবেষকদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার বিকাশে ভাষা গবেষণা কেন্দ্র এবং গবেষকদের প্রতি অধিকতর যত্নশীল হওয়া সরকারের একান্ত দায়িত্ব। আমাদের বর্তমান পাঠদান পদ্ধতি বিশেষত উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করা হয় তা আমাদের ভাষার পক্ষে কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে মূল ধরে এর পাশাপাশি ইংরেজি পাঠদান পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ সর্বস্তরের সহজলভ্যতা ভাষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা শিল্প, সাহিত্যের জন্য এক অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পরিশেষে বলতে হয়, আমরা যদি এখনই আমাদের ভাষার প্রতি একান্ত যত্নশীল এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে না পারি তবে হয়তো যে ভাষা আজ আমাদের গৌরবের পরিচায়ক সে ভাষাই একদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠবে লজ্জার এবং অবহেলার বস্তু।
বাংলা ভাষার ইতিহাস আমাদের জানান দেয়, সংস্কৃত অপভ্রংশ থেকে পালি ও প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে গড়ে উঠে আজকের এই বাংলা ভাষা। কিন্তু সদ্যজাত সেই বাংলার সঙ্গে আজকের এই বাংলার লিখিত কিংবা মৌখিক উভয় ক্ষেত্রেই বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শুধু ভাষা কেন যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রেই ক্রমাগত পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কেননা, কোনো কিছুই স্থবির নয় আর স্থবিরতা মানেই মৃত্যু। তা ছাড়া ভাষার উত্তরোত্তর বিকাশ সাধনের জন্য স্থান, কাল ভেদে পরিবর্তন আসবেই। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের দিনে ভাষার পরিবর্তন অবাস্তব কিছু নয়। কিন্তু পরিবর্তন হওয়া উচিত গঠনমূলক এবং আগ্রাসনমুক্ত। অথচ, আমাদের বর্তমান তরুণদের কথ্য ভাষার নামকরণ করা হয়েছে 'ডিজুস ভাষা' নামে। কারণ, বর্তমান তরুণরা (বিশেষত শহুরে) সাধারণত যে ভাষাতে কথা বলাকে তাদের 'স্ট্যাটাস ম্যাটার' বা 'স্টাইল' হিসেবে মনে করে সে ভাষাতে মূলত বাংলা বর্ণের বিকৃত উচ্চারণ হয়। এর মূল অনুসন্ধান করলে যে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টত খোলা চোখেই ধরা পড়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো, বিশ্বায়নের এ যুগে এক ভাষার ওপর অন্যকোনো ভাষার আগ্রাসন। আর আমাদের ভাষার ওপর ক্রমান্বয়ে হামলা এবং বীরবিক্রমে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা। ফলে কেবল যে ভাষার উচ্চারণ বিকৃতিই ঘটছে তা নয় উপরন্তু বর্ণমালার ওই বর্ণগুলোও অস্তিত্বের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিয়ে একটু আলোচনা করা যাক_হিন্দি বর্ণমালায় 'য' এই বর্ণটি নেই। তাই তারা 'যুবরাজ'-কে বলে 'ইয়ুবরাজ' কিংবা 'যাত্রা'-কে বলে 'ইয়াত্রা'। যা কিনা আমাদের এখনকার তরুণরা স্টাইল হিসেবেই দেখে। তাই আমাদের বর্ণমালায় 'য'-এর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তারা 'ইয়ুবরাজ' কিংবা 'ইয়াত্রা' বলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
যেকোনো দেশের অবস্থা কিংবা ভাষার পরিবর্তন বা পরিশোধনে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অতুলনীয়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিকল্প মিডিয়া এবং টেলিভিশনের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শহর-নগর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের চায়ের দোকানেও আজকাল টেলিভিশন দেখতে পাওয়া যায়। তাই এ যন্ত্রটির সাহায্যে প্রচারিত যেকোনো প্রচারণা অতিদ্রুত এবং কার্যকরীভাবে মানুষের কাছে পেঁৗছে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানাদির মূল লক্ষ্য ব্যবসা বা অর্থোপার্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যবসার সহজতম হাতিয়ার হিসেবে তারা কুক্ষিগত করেছে ভাষাকে। আমাদের প্রচলিত কথ্যভাষার নাম করে যেসব ভাষা নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও অন্য অনুষ্ঠানাদিতে ব্যবহৃত হয় তা প্রকৃত অর্থে ভাষার বিকৃতিকরণের অন্যরূপ মাত্র। কেবল, প্রিন্ট মিডিয়া ভাষার বিকৃতিতে এখনো গা ভাসিয়ে দেয়নি। কিন্তু তাই বলে ভাষা সংরক্ষণ ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য তেমন অনড় ও কঠিন কোনোরূপ কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ, এখনই উপযুক্ত সময় ভাষাকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করে গঠনমূলক ভাবে বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সমগ্র ভাষাকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিতে হলে ভাষা গবেষকদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার বিকাশে ভাষা গবেষণা কেন্দ্র এবং গবেষকদের প্রতি অধিকতর যত্নশীল হওয়া সরকারের একান্ত দায়িত্ব। আমাদের বর্তমান পাঠদান পদ্ধতি বিশেষত উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করা হয় তা আমাদের ভাষার পক্ষে কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে মূল ধরে এর পাশাপাশি ইংরেজি পাঠদান পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ সর্বস্তরের সহজলভ্যতা ভাষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বাংলা শিল্প, সাহিত্যের জন্য এক অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পরিশেষে বলতে হয়, আমরা যদি এখনই আমাদের ভাষার প্রতি একান্ত যত্নশীল এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে না পারি তবে হয়তো যে ভাষা আজ আমাদের গৌরবের পরিচায়ক সে ভাষাই একদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠবে লজ্জার এবং অবহেলার বস্তু।
No comments