ঐতিহ্য-বাংলা সভ্যতার কয়েকটি দিক by অমর্ত্য সেন

অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তার লেখাতে সেই যুগে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে উৎপাদন এবং বাণিজ্যভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদগ্রীব ছিল সে সময়কার পর্তুগিজ, ডাচ্, ফরাসি, ইংরেজ, ডেনিস ও বহু ইউরোপীয় দেশ।


১৭০৩ সালে প্রসিদ্ধ মানচিত্রশিল্পী থর্নটন খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সেদিনের বাংলাদেশি মানচিত্র। সেটিকে বলেছিলেন, ÔThe Rich Kingdom of BengalÕ অর্থাৎ ধনী বাংলাদেশের ছবি। আমাদের সাহিত্যের এবং কৃষ্টির অনেক উৎস অবশ্য ধনমুখী নয়, যেমন বাউল সংস্কৃতি এবং অন্যান্য হাজার রকমের সুন্দর পল্লী সঙ্গীত আর পল্লী কাব্য

বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে আসার সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বাঙালিদের একত্র করে বৈঠক বসানোর মধ্যে যেমন চিন্তার প্রসারতার পরিচয় আছে, তেমনি আছে তাতে সৎ সাহসের প্রমাণ। এই সম্মেলন এবং উৎসবের কাণ্ডারিদের অভিনন্দন জানানোর কারণ আমাদের সত্যিই আছে। এ ধরনের সম্মেলন করতে রাজনৈতিক অথবা সামাজিক কোনো সমস্যা নেই তা আমি বলছি না। তাই নজরুল ইসলামের 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' এই উপদেশের প্রয়োজন আছে, এটাও বোধহয় ঠিক। কিন্তু হুশিয়ারি করেও যে প্রশস্ত ও মহান বিশ্বাসের পরিচয় এই সম্মেলনে আছে তার স্বীকৃতি জোর গলায় দেওয়ার কারণ আছে বলে আমি মনে করি।
রাজনৈতিক নানা কারণে এবং ইতিহাসের ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলাদেশ এখন বিভক্ত। কিন্তু বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত এবং চিন্তানির্ভর সভ্যতার ঐক্যের জোর রাজনীতি থেকে কম নয়। তারই সঙ্গে আছে আমাদের সমাজ-চেতনার চিন্তামুখী আলাপ-আলোচনা। তার প্রভাব রাজনীতির ওপর পড়বে না এমনটি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু সেই নৈকট্যের ভিত্তি একমাত্র রাজনীতিতে নয়। এই বিশ্ব বাঙালির সম্মেলন সেই একতাটিকে আর একটু বড় করবে। যেমন করেছিল ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের উৎসব।
কবি জসীম উদ্দীনের অন্য প্রসঙ্গে লেখা একটি কবিতার সাহায্য নিয়ে আমরা বলতে পারি :
'কেয়া পাতার নৌকা ভরে
আনব ফুলের বাস
তোমার সনে আমার সনে
আলাপ বার মাস।'
বাঙালির সভ্যতার ভিত্তিতে যে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের সাহায্য আছে সে কথাটা এ প্রসঙ্গে বোধহয় বলা যেতে পারে, কারণ দারিদ্র্য আর অভাবতার প্রভাব আমাদের চিন্তাধারায় ইদানীং খুবই বেশি। কিন্তু এই অভাবগ্রস্ত অবস্থা বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সত্য এটা কিন্তু একেবারেই নয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তার লেখাতে সেই যুগে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে উৎপাদন এবং বাণিজ্যভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদগ্রীব ছিল সে সময়কার পর্তুগিজ, ডাচ্, ফরাসি, ইংরেজ, ডেনিস ও বহু ইউরোপীয় দেশ। ১৭০৩ সালে প্রসিদ্ধ মানচিত্রশিল্পী থর্নটন (Thornton)) খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সেদিনের বাংলাদেশি মানচিত্র। সেটিকে বলেছিলেন, ÔThe Rich Kingdom of BengalÕ অর্থাৎ ধনী বাংলাদেশের ছবি। আমাদের সাহিত্যের এবং কৃষ্টির অনেক উৎস অবশ্য ধনমুখী নয়, যেমন বাউল সংস্কৃতি এবং অন্যান্য হাজার রকমের সুন্দর পল্লী সঙ্গীত আর পল্লী কাব্য। কিন্তু তারই পাশাপাশি চলেছিল শহরমুখী বর্ধিষ্ণু সংস্কৃতির প্রসার_ প্রবন্ধ, সমালোচনা, কবিতা, কাহিনী, গান-বাজনার সুব্যবহার করে। সেই ইতিহাসটিকেও মানার প্রয়োজন আছে। কারণ, বাঙালির চিন্তাধারার সাবলীলতার মধ্যে যেমন আছে আমাদের পল্লী জীবনের সামর্থ্য, তেমনি আছে আমাদের শহুরে জীবনের সমৃদ্ধির পরিচয়।
বাঙালির চিন্তাধারার ঐতিহ্যের মধ্যে কয়েকটি দিকের ওপর নজর দেওয়ার কারণ আমাদের আছে_ আজকেও খুব বেশি করেই আছে। তার মধ্যে একটি গুণ বাঙালি সভ্যতার গ্রহণশক্তি এবং সমন্বয়প্রীতি। গত ডিসেম্বরে যখন আমি বাংলা একাডেমীতে কিছু কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম তখন আমি আলোচনা করেছিলাম আমাদের নানা উৎসের শব্দ গ্রহণ করার বাহাদুরি বিষয়ে। সংস্কৃত, পালি, ফারসি, আরবি, ইংরেজি এবং আদিবাসী নানা উৎস থেকে শব্দ গ্রহণ করতে বাংলাভাষা কোনো রকম ইতস্তত করেনি। অনেক সময় এই পরিভাষার সমৃদ্ধির মধ্যে লব্ধ অর্থের সূক্ষ্ম পার্থক্য করার সুযোগ আমরা পেয়েছি এবং এখনও পাই। শব্দচয়ন বিষয়ে সেই আলোচনায় আজ ফিরে যাব না, কিন্তু আমাদের গ্রহণশক্তির পরিচয় বিভিন্ন ধরনের উদাহরণ দিয়ে ফল্সা করা যায়। তার আরেকটি উদাহরণ বরং দিই।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকে সম্রাট আকবর নতুন একটি ক্যালেন্ডার স্থাপিত করার চেষ্টা করেছিলেন_ এই প্রচেষ্টার মধ্যে আকবরের সর্ব-সংস্কৃতির সমন্বতা করার প্রচেষ্টা ছিল। যে বছরে তিনি সিংহাসনে উঠলেন সে বছরটি মুসলিম হিজরি সনে ৯৬৩ এবং হিন্দু শক্ বর্ষপঞ্জিতে ১৪৭৮ (সেটি ইউরোপীয় মতে ১৫৫৬ সাল)। তারিখ-ইলাহি নাম দিয়ে এই ক্যালেন্ডারটি শক্ সনের সূর্যমুখী বর্ষগণন মানল; কিন্তু বছরের হিসাবটি শুরু হলো হিজরি থেকে নেওয়া ৯৬৩ দিয়ে।
এই সমন্বিত ক্যালেন্ডারটি অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্য কোনো অঞ্চলে বেশিদিন চলল না। কিন্তু সেটি নতুনভাবে গ্রহণ করা হলো আমাদের সমন্বয়মুখী বাংলা সনরূপে। এর একটি আশ্বর্য ফল হচ্ছে যে, বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই সমন্বয়টি আজকেও মানেন। যেমন একজন হিন্দু পূজারি যখন তার কাজে এ বছরের ১৪১৮ সনটিকে আহ্বান জানিয়ে শুরু করেন, তখন তার বোধহয় জানা থাকে না যে এই পুজো উপলক্ষে তিনি স্মরণ করছেন মোহাম্মদের (সা.) মদিনা যাত্রার পবিত্র দিনের কথা। এই যোগাযোগটি লোকের কাছে স্পষ্ট না থাকতে পারে এই কারণে যে, ১৪১৮ সন শুধু যে হিন্দু শক্ সন থেকে ভিন্ন তা নয়, এটি মুসলিম হিজরি সন থেকেও পিছিয়ে পড়েছে, কারণ এটি চলছে সূর্য বছর গুণে ৯৬৩ সন থেকে, অন্যদিকে হিজরি চলেছে সবসময় চন্দ্রমুখী ছোট বছরের হিসেবে। চন্দ্র বৎসরের দৈর্ঘ্য ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সূর্য বৎসরের গণনায় (৩৬৫ দিনের) সেই কারণেই বাংলা সনের সঙ্গে হিজরি সনের পার্থক্য।
বাংলা সভ্যতার নানা উৎস নানাদিক থেকে এসেছে সেটি আমাদের স্বীকার করার প্রয়োজন আছে। যেমন আছে আমাদের গ্রহণশীলতা এবং সমন্বয়প্রীতির মর্যাদা দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন অক্সফোর্ডে হিবার্ট লেকচার দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, তার পারিবারিক সংস্কৃতি হিন্দু, মুসলিম ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল, তখন এই মর্যাদাটি তিনি জোর গলায় ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিলেন। কবি নজরুল ইসলাম যখন, অন্য প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন তার নিজের বিদ্রোহী প্রবৃত্তির পার্থক্য করেছিলেন, তখনও রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানিয়েই তিনি তার ভিন্ন মত প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে নজরুলের নিজস্ব চিন্তার পরিচয় আছে, কিন্তু এরই সঙ্গে আছে তার প্রশ্নপ্রবণ রবীন্দ্রশ্রদ্ধা :
'ধ্যানশান্ত মৌন তব কাব্য, রবিলোকে
সহসা আসিনু আমি ধূমকেতুসম
রুদ্রের দুরন্ত দূত, ছিন্ন হর জটা
কক্ষচ্যুত উপগ্রহ। বক্ষ ধরি তুমি
ললাট চুমিয়া মোর দানিলে আশিস।'
বাঙালি সভ্যতার মধ্যে গ্রহণশীলতা এবং প্রশ্নপ্রবণতা দুটিই আছে। আজকের এই বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে আমাদের ঐতিহ্যের নানা দিক স্মরণ করার কারণ আছে । যে গুণগুলো এক সময় বড় রকম স্বীকার পেয়েছে, তার থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে থাকলে, সেই ঐশ্বর্যগুলো ফিরে পাওয়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এটি পশ্চাৎমুখী চিন্তার পরিচায়ক নয়। নতুন চিন্তার মধ্যেও_ নজরুলের ভাষায় বিদ্রোহী চিন্তার মধ্যেও_ অতীতের ও ঐতিহ্যের স্বীকারের প্রয়োজন খুবই প্রশস্ত। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিহাস থেকেও আমাদের আজ দূরত্ব রোধ করার কারণ হয়তো আছে। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক সব সমৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক প্রসারের প্রচেষ্টাও নিশ্চয়ই চলবে। বাঙালি সম্মেলন আজ সেই সামগ্রিক প্রগতির আহ্বানেই সমবেত হয়েছে।
জসীম উদ্দীনের আরেকটি অপ্রকাশিত কবিতা থেকে দুটি কথা বলে শেষ করছি।
'কোথায় জ্যোৎস্না-পুলকিত রাতি
কোথায় পুষ্পরথ
অভাবের জালে আজিকে দৈত্য
ঘিরিয়েছে তব পথ।'
যে অভাবের জাল থেকে আমরা মুক্তি চাই, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বাঙালি সভ্যতার সব দিকের প্রসারতা আমাদের কাম্য। আমাদের প্রয়োজন_ জসীম উদ্দীনের ভাষায়_ 'জ্যোৎস্না-পুলকিত' জীবন! সেই কামনা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
[সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে প্রথম বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে সেমিনারে পঠিত]

অমর্ত্য সেন : নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.