২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩-নগ্নপদ প্রভাতফেরি by আহমদ রফিক
পুরো বায়ান্ন সাল শেষ হয়েছিল নিয়মভাঙা ও রক্তঝরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে—সভা-সমাবেশ, মিছিল-স্লোগান; এরপর বছর শেষে আর্মানিটোলা ময়দানে বিক্ষুব্ধ জনসভা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ময়দান মানুষে থই থই—শব্দ ব্যবহার সঠিক না হলেও এমনটাই তখনকার অনুভূতি। একটি কাগজ লিখেছিল, ‘বিশাল সামুদ্রিক জনসভা’।
ময়দানের বাইরের রাস্তার ওপর দাঁড়ানো মানুষ। ভাষার আবেগ এভাবেই জনচেতনা মথিত করেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের মনে কী ছিল, মানুষ তা ভাবতে যায়নি। যুক্তি ছাড়িয়ে আবেগ ও মুগ্ধতারই ছিল প্রাধান্য।
এমনই ছিল বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এবং তার আবেগ। ঢাকা একদা খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিল তার দুই কিংবদন্তির মিছিলের জন্য—জন্মাষ্টমী ও মহররমের মিছিল। শিশুপাঠ্য বইয়ে পর্যন্ত জায়গা করে নিয়েছিল। বায়ান্ন-তেপ্পান্নতে এসে যোগ হলো ভাষার মিছিল। ঐতিহাসিক সে মিছিল যেমন বায়ান্নর এপ্রিলে, তার চেয়ে সুঠাম ও বলিষ্ঠ মিছিল প্রথম শহীদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩) উপলক্ষে।
নবাবপুর, রথখোলা, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর হয়ে সে মিছিল শেষ হয় আর্মানিটোলা ময়দানে—এরপর জনসভা। সে মিছিলের আয়তন ও দৈর্ঘ্য এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতাদের শৃঙ্খলা রক্ষার ঘর্মাক্ত প্রচেষ্টা যিনি দেখেছেন, তাঁর ভোলার কথা নয়। পিছে পিছে সরকারি গোয়েন্দা ও পুলিশ বাহিনীর সতর্কতা, টানটান অবস্থান। তবে কোনো অঘটন ঘটেনি।
এর উদ্দীপনা ও প্রাণশক্তি কিন্তু আবছা-ভোরের প্রভাতফেরি, যা হলো নগ্নপদ ছাত্রমিছিল। সুশৃঙ্খল মিছিল গানে, স্লোগানে—গন্তব্য আজিমপুর কবরস্থান—উদ্দেশ্য, ভাষাশহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। এ কাজের কাজি বিভিন্ন ছাত্রাবাসের রাজনীতিমনস্ক ছাত্রছাত্রী। যাত্রা শুরু যার যার ছাত্রাবাস থেকে।
মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের শ্রমে হলের রাজনীতিমনস্ক ছাত্ররা যে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিল, সরকারের পুলিশ বাহিনী তা ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ধ্বংস করে ইটের শেষ টুকরোটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে চলে যায়। এরপর আসে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেখানেই তৈরি করা হয় বিলুপ্ত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের হুবহু প্রতিকৃতি—লাল-কালোয়। অর্থাৎ লাল কাগজ আর কালো কাপড় দিয়ে। জিয়া হাসান, বদরুল আলম, নুরুল ইসলাম প্রমুখ আঁকিয়ে ছাত্র ওই কাজের কারিগর।
ঢাকা হল, ফজলুল হক হলের ছাত্রদের চেষ্টায় তৈরি হয়েছিল একই ধরনের শহীদ মিনার কার্জন হল প্রাঙ্গণে। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মিনার তৈরির চেষ্টা সফল হয়নি কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে। তবু ছাত্রছাত্রীদের আবেগ কোনো বাধা মানেনি। তারা যেভাবে পারে প্রভাতফেরির মিছিলে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করেছে। সেবার এতে যোগ দিয়েছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, মিটফোর্ড স্কুল, ঢাকা হল, ফজলুল হক হল ও সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র। অবশ্য তাদের যাত্রা আলাদা আলাদা মিছিলে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের কথা ঠিক মনে পড়ছে না।
মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা যাত্রা শুরু করে সদ্য তৈরি শহীদ মিনারের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চাই’। তখনো রোদ নামেনি। আবছা-ভোরের আলোয় খালি পায়ে ধীরগতিতে হেঁটে চলা পাতলা শার্টে ফেব্রুয়ারির হালকা শীত গায়ে মেখে কখনো একুশের গানে, কখনো উদ্দীপ্ত স্লোগানে আজিমপুরের দিকে যাত্রা।
সলিমুল্লাহ হল ডানে রেখে হালকা বাতাসে গভীর গাছগাছালির পাতার শিরশিরানি শ্রুতিতে নিয়ে রেললাইন পার হতেই বাঁ দিকের রাস্তায় দূরে দেখা গেল আসছে আরেকটি ছাত্র মিছিল গানের সুরে, স্লোগানের চড়া শব্দে। আমরা তখন একটুখানি দাঁড়িয়ে—সামনে পলাশী ব্যারাকের সারি। মিছিল কাছে আসতেই চেনা গেল মিছিলের মুখে মিটফোর্ড স্কুলের ছাত্রটিকে মুখে চোঙা নিয়ে ভরাট গলায় স্লোগান দিয়ে চলেছে। স্লোগানের বিরতি পূরণ গানে। তবে গানের প্রাধান্য কম নয়।
সেবার প্রথম প্রভাতফেরির গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে।’ তখন পেছন দিক থেকে আসছে ঢাকা হল, ফজলুল হক হলের ছাত্ররা—দ্রুততালে গম্ভীর গলার গানে। সে গান ‘ভুলবো না, ভুলবো না’—ওই গানেই বোঝা যাচ্ছিল ওরা কোন হলের ছাত্র। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে—আজিমপুর কলোনির ফ্ল্যাটবাড়ির দরজা-জালানা দ্রুত খুলে যাচ্ছে—নারী-পুরুষ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রভাতফেরির যাত্রীদের একনজর দেখবেন বলে। কোনো কোনো ফ্ল্যাট থেকে কম বয়সী ছাত্র ছুটে এসে মিছিলে শামিল হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়ানো দু-একজন মায়ের চোখ মনে হয়েছে গানের সুরে সিক্ত। হতে পারে আমাদের ভুল। ঘুমের আমেজে চোখের পাতা ভারী। এখনো ভাবি, প্রথমটাই সত্য।
ভোরের বাতাসে বিষণ্নতার আমেজ। প্রথম প্রভাতফেরি ছাত্রদের মনে শহীদদের স্মৃতিই বড় হয়ে এসেছে প্রতিবাদী আন্দোলনের বলিষ্ঠতার তুলনায়। শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রভাতফেরির মিছিলে গাওয়া সব কটা গানই কমবেশি যেন শোকগাথা—গাজীউলের গানটা একটু ব্যতিক্রম। আবছা-ভোরে এ ধরনের গানের সুরে মন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। প্রভাতফেরির নগ্নপদ মিছিলের সে অভিজ্ঞতা কি ভুলতে পারি!
আজিমপুর কলোনি পার হয়ে কবরস্থানে ঢোকার মুখে যথারীতি সার বেঁধে দাঁড়ানো—ওই মিছিলের সারিতেই এক এক করে সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ ভাষাসংগ্রামীর কবরে ফুল বিছিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটানো। তারপর মনে বিষণ্নতার রেশ নিয়ে ঘরে ফেরা। একটি পবিত্র মন নিয়ে ফেরা। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে শহীদ মিনার ছুঁয়ে গান গেয়ে, স্লোগান তুলে খালি পায়ে মিছিলে হেঁটে যাওয়ার এই যে ছবি, সেটা এমনই এক গাঢ় তেলরঙে আঁকা যা, একুশের ইতিহাসে স্থায়ী রূপ নিয়ে জেগে আছে। এ রং মুছে যাওয়ার নয়।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধের ছাত্ররা যখন তাদের রাজনৈতিক তৎপরতার জায়গা ছেড়ে চলে গেছে, সে শূন্যতা পূর্ণ হয়েছে নতুন ছাত্রদের তরুণ পদপাতে। তখনো প্রভাতফেরির পূর্ব ছবিটাই ট্র্যাডিশন, এর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বছর আটের ব্যবধানেও দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনাবাসিক ছাত্র সাতসকালে উঠে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেছে। পরে জেনেছি সেই প্রভাতফেরি, সেই মনে, সেই স্ল্লোগান এবং শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ঐতিহ্যবাহী আবেগের তাড়নায়। বেলা করে উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে বিষণ্ন মুখে ঘরে ফেরা।
তখন শহর ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে নানা রঙা বাসন্তী ফুল চাষের রেওয়াজ ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। ফুটপাতে ফুলের দোকান—তাও ছিল না। তবু এ-বাড়ি, সে-বাড়ি থেকে কিছু না কিছু ফুল জোগাড় হয়েই যেত—ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি গভীর শ্রদ্ধায় সমাধিতে নিবেদন। ফুল না হলে প্রভাতফেরির উদ্দেশ্যটাই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
পরে একসময়, ঠিক কবে তা মনে নেই, প্রভাতফেরির গান গেয়ে, স্লোগান তুলে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার রীতিটা উঠেই গেল। এর পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক কারণ ছিল? কারণ থাকুক বা না-ই থাকুক, ভোরের শহীদ দিবসটাকে মধ্যরাতের ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে যুক্ত করা বাঙালি সংস্কৃতি-সাপেক্ষে খুব যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। এটা সাংস্কৃতিক অনাচার। প্রধান ভাষাসংগ্রামী কারোরই এ পরিবর্তন পছন্দসই নয়। এমনকি, নয় কোনো মধ্য বয়সীরও। তাঁদের দাবি, ‘আমাদের প্রভাতফেরি ফিরিয়ে দাও।’ জানি না, বর্তমান প্রজন্মের কাছে কোনটা পছন্দের—আবছা-ভোর, না মধ্যরাত।
বয়সের ভার নিয়ে ঘরে বসে ২১ ফেব্রুয়ারির ভোরে আজও দেখতে পাই—প্রাণচঞ্চল এক দঙ্গল তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রী গান গেয়ে, স্লোগান তুলে খালি পায়ে হেঁটে চলেছে। ভোরের বাতাসে মুখগুলোতে বিষণ্নতার পাশাপাশি আশ্চর্য এক দৃঢ় প্রত্যয়—তাতে প্রতিবাদী ছাপ। তখন বয়সী গলায় চিৎকার করে আমারও বলতে ইচ্ছ করে: ‘ফিরিয়ে দাও আমার একুশের নগ্নপদ প্রভাতফেরি!’ কে ফিরিয়ে দেবে? কেউ দেয় না। ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদেরই।
No comments